Thank you for trying Sticky AMP!!

ইয়াবা, অভিযান ও থানাপর্ব

মঙ্গলবার রাতে বাস থেকে আবদুর রশিদকে (ডানে) আটক করে পুলিশ। তখন তাঁকে ইয়াবা পাচারের মূল অভিযুক্ত বলা হলেও এখন ভিন্ন সুর পুলিশের। ছবিটি লোহাগাড়া থানা থেকে তোলা । প্রথম আলো

কক্সবাজারের টেকনাফ থেকে যাত্রী নিয়ে ঢাকা অভিমুখে ছুটে চলেছে সেন্ট মার্টিন পরিবহনের বিলাসবহুল বাসটি। যাত্রীদের বেশির ভাগই পর্যটক, আছেন টেকনাফের কিছু স্থানীয় বাসিন্দাও। কক্সবাজার পর্যন্ত অন্তত ১০টি স্থানে সীমান্তরক্ষী ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তল্লাশি। না, কোথাও সন্দেহজনক কিছু মেলেনি। তবে কক্সবাজার পেরিয়ে লোহাগাড়ায় আসতেই স্থানীয় পুলিশ থামাল বাসটি। এরপর নির্দিষ্ট একজন যাত্রীর কাছে গিয়ে পুলিশের প্রশ্ন: আপনার ব্যাগ কই?
এরপরই শুরু হলো সত্যিকারের এক ‘নাটক’। ঘড়ির কাঁটায় তখন রাত ১২টা। সন্ধ্যা থেকে বারবার তল্লাশিতে সময়ক্ষেপণ হওয়ায় যাত্রীরা কিছুটা বিরক্ত। কিন্তু অভিযান চালাতে আসা পুলিশের সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) মোহাম্মদ শামীম বাসযাত্রীদের উদ্দেশে বলেন, ‘আমাদের কাছে সুনির্দিষ্ট তথ্য-প্রমাণ রয়েছে।’ ততক্ষণে তিনি একটি মোবাইল ফোনের নম্বরে কল দিয়েছেন। যে যাত্রীর সামনে গিয়ে তিনি দাঁড়িয়েছিলেন, বেজে উঠল তাঁর ফোনটি। এএসআই শামীম যাত্রীটির নাম জানতে চাইলেন। জবাব এল: ‘রশিদ আহমেদ’। পুলিশের পরের প্রশ্ন:‘ব্যাগ কই?’ যাত্রী পান চিবুতে চিবুতে জানালেন, ‘কোনো ব্যাগ নেই।’ পুলিশ বাসের সুপারভাইজার শান্তর কাছে ওই যাত্রীর ব্যাগ কোথায় জানতে চাইলে তিনি মলিনমুখে জানালেন, জানা নেই।
একদল পুলিশ সদস্য ততক্ষণে পুরো গাড়িতে তল্লাশি শুরু করেছেন। যাত্রীরা একে একে তাঁদের ব্যাগ খুলে দেখালেন। কিন্তু দৃশ্যত নিশ্চিত পুলিশ সদস্যরা তার পরও খুঁজে চললেন। পরপর দুবার খোঁজা হলো। কিন্তু মিলল না কিছুই। শেষ পর্যন্ত বাসের চালককে তাঁর আসন থেকে উঠতে বললেন এএসআই শামীম। চালক উঠলে তাঁর আসনের ডালা খুললেন শামীম। সেখানে পাওয়া গেল অনেকগুলো আচারের প্যাকেট। সেগুলো খুলে দেখেই সন্তুষ্টির চিহ্ন ফুটল পুলিশ কর্মকর্তার মুখে। বাসের যাত্রীদের মধ্যেও উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ল। ইয়াবা পাওয়া গেছে! এএসআই শামীম সবার সামনে দুজন যাত্রীকে সাক্ষী করে জব্দ তালিকা করলেন।
এরপর বাসের চালক ও যাত্রী রশিদ আহমেদকে নিয়ে থানায় ঢুকল পুলিশ। এএসআই গাড়ির সুপারভাইজারকে বললেন, নতুন চালক পাঠানোর জন্য কোম্পানিকে বলতে। চালকের জন্য অপেক্ষা করতে করতে গল্পে মেতে উঠলেন যাত্রীরা। সহযাত্রী হিসেবে এ প্রতিবেদকও তাঁদের সঙ্গে যোগ দিলেন। ইয়াবার মতো ভয়ংকর মাদক কীভাবে সমাজকে নষ্ট করে দিচ্ছে, তা নিয়ে উদ্বেগ ঝরে পড়ছিল যাত্রীদের কণ্ঠে। পুলিশ আদৌ এই আসামিদের ধরে রাখবে, নাকি টাকা নিয়ে ছেড়ে দেবে, তা নিয়েও চলল আলোচনা। এর মধ্যেই পুলিশ আবার গাড়িতে এসে ধরে নিয়ে গেল আরেক যাত্রীকে। জানা গেল, তাঁর নাম বিপ্লব কুমার ঘোষ। আগে আটক যাত্রী রশিদ আহমেদ নাকি থানায় এই বিপ্লবকে তাঁর সহযোগী হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
রাত তখন দুইটা। লোহাগাড়া থানায় ঢুকে দেখা গেল, রশিদ পুলিশের সামনে সিগারেট টানছেন। মোবাইল ফোনে একের পর এক কথা বলছেন।
চালানটি কীভাবে ধরলেন—জানতে চাইলে এএসআই শামীম এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘বিকেল তিনটায় সোর্সের মাধ্যমে আমরা নিশ্চিত হই, এই গাড়িতে ইয়াবা যাচ্ছে। তল্লাশি করে আচারের মধ্যে এক হাজার ইয়াবা পেলাম। পাচারকারীরা এগুলো দেড় লাখ টাকায় কিনেছে। খুচরা ক্রেতাদের কাছে আরও বেশি দরে বিক্রি হয়।’
ইয়াবাগুলো কোথায় পেলেন—জানতে চাইলে রশিদ আহমেদ বলেন, ‘আমি ব্যবসা করি না। টেকনাফের কেফায়েত ও রুস্তম নামের দুজন আমাকে এগুলো দিয়েছে। আমি চালককে দিয়েছি।’
ইয়াবা রাখতে কেন রাজি হলেন জানতে চাইলে আটক চালক নাসিরউদ্দিন হতাশ কণ্ঠে বলেন, ‘আমাকে বলেছে এর মধ্যে আচার আছে। রাখতেই হবে। আমার কিছু করার ছিল না।’ এএসআই শামীমও বললেন, এই রুটের প্রায় সব গাড়িতেই এখন ইয়াবা পাচার হয়। চালক রাজি না হলে তাঁকে হুমকি দেওয়া হয়, গাড়ি ভাঙচুর করা হয়।
রশিদ আহমেদের সহযোগী হিসেবে গ্রেপ্তার বিপ্লব কুমার ঘোষের সঙ্গে এ প্রতিবেদক কথা বলতে চাইলে থানার উপপরিদর্শক আবদুল আউয়াল বললেন, বিপ্লব বোধ হয় দোষী নয়। কাজেই তাঁকে জড়ানোর কিছু নেই।
রাত আড়াইটার কিছু পরে নতুন চালক এসে গাড়ির স্টিয়ারিং ধরলেন। যে গাড়ির চট্টগ্রাম পৌঁছানোর কথা রাত একটায়, সেটি পৌঁছাল ভোরে।
বুধবার বিকেলে এ প্রতিবেদক জানার চেষ্টা করলেন ইয়াবা উদ্ধারের ঘটনাটির অবস্থা। খোঁজ নিয়ে জানা গেল, হাতেনাতে ধরা পড়া মূল অভিযুক্ত রশিদ আহমেদ বিশাল অঙ্কের টাকা খরচ করে ছাড়া পেয়ে যাচ্ছেন। আসামি হচ্ছেন গাড়ির চালক নাসিরউদ্দিন ও বিপ্লব।
টেকনাফে খোঁজ নিয়ে জানা গেল, রশিদ আহমেদের বড় ভাই মোহাম্মদ হোসেন টেকনাফ পৌরসভার ৪ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগের সভাপতি। তিনি থানা-পুলিশকে টাকা দিয়ে ভাইকে ছাড়িয়ে নিতে চাইছেন। গতকাল বুধবার বিকেলে তাঁর ভাইয়ের সহযাত্রী পরিচয় দিয়ে যোগাযোগ করা হলে মোহাম্মদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘ভাইকে ছাড়িয়ে আনার সব চেষ্টাই করছি। নেতারাও লোক পাঠাচ্ছে থানায়। পুলিশ এখন টাকা চাইছে।’
কে এবং কত টাকা চাইছে—জানতে চাইলে মোহাম্মদ হোসেন বলেন, পুলিশের দালালরা যোগাযোগ করছে। কমপক্ষে নাকি পাঁচ লাখ টাকা দিতেই হবে। এর আগেও তো কয়েকবার আপনার ভাই গ্রেপ্তার হয়েছে, তখন কীভাবে ছাড়িয়েছেন? হোসেনের উত্তর, ‘তখনো টাকা দিছি’। সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে এবার জানতে চাইলাম, ‘আপনার ভাই কত দিন ধরে ইয়াবা ব্যবসা করছে?’ এবার হোসেনের উত্তর, ‘আমার ভাই ব্যবসায়ী নয়।’
রশিদকে কেন ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে জানতে চাইলে এই অভিযানের মূল নেতৃত্বদানকারী এএসআই মোহাম্মদ শামীম বলেন, ‘ঊর্ধ্বতন সব কর্মকর্তার সামনে বিপ্লব নিজের দোষ স্বীকার করেছেন। তাঁর কাছ থেকে কাগজপত্রও পাওয়া গেছে। চালকের সহযোগিতায় তিনিই ইয়াবা পাচার করছিলেন।’
তাহলে পুলিশ কীভাবে রশিদের মোবাইল নম্বর পেল—এ প্রশ্নের জবাবে এএসআই শামীম বললেন, বিপ্লবই তার নম্বর দিয়েছিল বিভিন্ন জায়গায়।
ঘুষের বিনিময়ে রশিদকে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে কি না—সরাসরি এ প্রশ্ন করা হলে লোহাগাড়া থানার ওসি মোহাম্মদ শাহজাহান প্রথম আলোকে বলেন, এই ধরনের অভিযোগ একেবারেই ভিত্তিহীন। রশিদকে তাহলে কেন ছেড়ে দিচ্ছেন—জানতে চাইলে ওসি বলেন, তাঁর সঙ্গে ইয়াবা ব্যবসায়ীদের সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়নি। মোবাইল নম্বর পাওয়া, এর আগেও গ্রেপ্তার হওয়া, বিপ্লবের সঙ্গে যোগাযোগ—এত কিছুর পরও রশিদকে নির্দোষ মনে হচ্ছে কেন জানতে চাইলে পুলিশ কর্মকর্তা মোহাম্মদ শাহজাহান বলেন, ‘আমি তাহলে ভালো করে খোঁজখবর নিচ্ছি। মাদকের মামলার ব্যাপারে আমরা ভীষণ সিরিয়াস।’