Thank you for trying Sticky AMP!!

উন্নয়নের কোপটা কেন গাছের ওপর

দেশে নানা সমস্যা আছে। অধিকার ভূলুণ্ঠিত হয় পদে পদে, দুর্নীতি, অর্থ লুটপাট, মাদক সমস্যা, রোহিঙ্গাদের অপরাধে ইউটিলাইজ করা, মানব পাচার, প্রকল্পে দুর্নীতি, করোনাকালেও ত্রাণে দুর্নীতি–অনিয়ম, ব্যাংক খাতের নৈরাজ্য, ভোক্তাদের অধিকার হরণসহ নানা ফিরিস্তি লিখলে বেশ সময় লাগবে। কিন্তু তবুও আন্তর্জাতিক কোনো সূচকে বাংলাদেশকে খারাপ করতে দেখলে মন খারাপ হয়ে যায়। দেশের ভেতরে রাজনীতি নিয়ে যতই কামড়াকামড়ি করি না কেন, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশ মানে আমাদের সবার। আন্তর্জাতিক সূচক প্রশ্নে আওয়ামী লীগ-বিএনপির ঊর্ধ্বে থাকে বাংলাদেশ। তাই আন্তর্জাতিক কোনো সূচকে অল্প অর্জনেও তৃপ্তি থাকে অনেক, আবার কোনো খারাপ খবরে মন খারাপ হয় অনেক বেশি। ঢাকার বাতাসের মান যে খারাপ এবং দিন দিন আরও খারাপ হচ্ছে, তা প্রতি নিশ্বাসে টের পায় নগরবাসী। প্রতিদিন সবুজ কমছে, বাড়ছে দালানকোঠা, গাড়ি; বাড়ছে ধুলা আর দূষণ।
যেকোনো উন্নয়নমূলক কাজে রাস্তাঘাট, কলকারখানা নির্মাণের জন্য প্রকৃতি ও পরিবেশকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে হবে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, কতটা? এখানে একটা সীমার কথা বলেছেন লেনিন এবং তাঁর আগে মার্ক্স, অ্যাঙ্গেলস। ‘প্রকৃতির দ্বন্দ্ববাদ’ শীর্ষক গ্রন্থে ফ্রেডরিক অ্যাঙ্গেলস বলছেন, ‘প্রকৃতির ওপর আমাদের বিজয় নিয়ে নিজেদের গর্বিত ভাবার দরকার নেই। কারণ, প্রতিটি বিজয়ের পর প্রকৃতি প্রতিশোধ নেয়। প্রথম দফায় আশানুরূপ ফল পাওয়া যেতে পারে, কিন্তু দ্বিতীয় ও তৃতীয় দফায় ফলাফলটা হয় অন্য রকম, যা প্রায়ই প্রথম ফলকে বাতিল করতে পারে।’

উন্নয়নের কিছু সূচকে বাংলাদেশ খারাপ করেছে শুনলে মন খারাপ করি। আবার কোনো সূচকে দেশ ভালো করলে আনন্দ পাই। কিন্তু পরিবেশরক্ষা সূচকে বাংলাদেশ ১৮০টি দেশের মধ্যে নিচের দিকে এখন দ্বিতীয়। এমন সর্বনাশা খবরে আমি অবাক হইনি। জানা, বোঝা—তাই মন খারাপ করিনি। পরিবেশ রক্ষায় বাংলাদেশ যে খারাপ ও ঝুঁকিপূর্ণ—এটা বোঝার জন্য বিশাল জরিপ করতে হয় না। চারপাশে তাকালেই টের পাই।
সম্প্রতি প্রকাশিত যুক্তরাষ্ট্রের ইয়েল ও কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘এনভায়রনমেন্টাল পারফরম্যান্স ইনডেকক্স (ইপিআই) ২০১৮’ শীর্ষক যৌথ গবেষণায় ১০টি বিষয়কে বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। বিষয়গুলো হলো: বায়ুর মান, পানি সরবরাহ ও পয়োনিষ্কাশন, ক্ষতিকর ভারী ধাতু, জীববৈচিত্র্য ও বাসস্থান, বনায়ন, মৎস্য সম্পদ, জলবায়ু ও জ্বালানি, বায়ুদূষণ, পানিসম্পদ এবং কৃষি। ২০১৯ এর তালিকায় পরিবেশ রক্ষার বিভিন্ন সূচকে বাংলাদেশের গড় স্কোর ২৯ দশমিক ৫৫। ২০১৬ সালের তালিকায় বাংলাদেশের গড় স্কোর ছিল ৪১ দশমিক ৭৬। মানে হচ্ছে প্রায় দ্বিগুণ আকারে নিচে নামছি আমরা। ২০১৪ সালের তালিকায় ১৭৮টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৬৯। তার মানে পরিবেশ রক্ষায় বাংলাদেশের পারফরম্যান্স প্রতিবছরই খারাপ হচ্ছে। পরিবেশ রক্ষায় যে আমাদের নজর নেই, তা বোঝাতে খুব বেশি দূর যেতে হবে না।
দুই বছর আগে যশোর রোড সম্প্রসারণে বেশ কিছু শতবর্ষীসহ অন্তত আড়াই হাজার গাছ কাটার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। কিছু ব্যয় বাড়বে এই অজুহাতে এই গাছ কাটার নিষ্ঠুর সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়ে গিয়েছিল। পরিবেশবাদীদের তুমুল প্রতিবাদ আর শেষ পর্যন্ত আদালতের হস্তক্ষেপে আপাতত রক্ষা পেয়েছে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত যশোর রোড। আমরা যখন যশোর রোড নিয়ে ব্যস্ত, তখন দেশের অন্তত দুটি জায়গায় গাছ কাটা সারা হয়ে গেছে সবার চোখের আড়ালে। সাভার-মানিকগঞ্জ আঞ্চলিক মহাসড়কের উন্নয়নের জন্য প্রায় চার হাজার গাছ কেটে ফেলা হয়েছে।

কুমিল্লা একসময় ছিল পানির জলাধারের শহর। বড় জলাধারগুলোও আস্তে আস্তে মরে যাচ্ছে বা ভরাট হয়ে যাচ্ছে। সেই সবুজের দেখা পাই না। শহরের সার্কিট হাউস চত্বরে অল্প কিছু গাছ বিশালাকার গাছ ছিল। বছর কয়েক আগে সার্কিট হাউস চত্বরের সেই গাছগুলো কেটে ফেলা হয়েছে শুধু উন্নয়নের কারণে। উন্নয়নের কারণে কি করে বলি, বলতে হবে উন্নয়নের অজুহাতে। কারণ উন্নয়ন মানে গাছের ওপর চড়াও হওয়া বোঝায় না। কুমিল্লার সার্কিট হাউস ভেঙে বহুতল ভবন করা হয়েছে। এদিকে ঢাকা হতে ময়মনসিংহের দিকে গেলে দুই পাশের হতশ্রী কেটে ন্যাড়া করা গজারি বনের অপমৃত্যুর দৃশ্য। গত ২০ বছরে শিল্পগোষ্ঠী আর বনের বিট কর্তারা মিলে বিশাল ভাওয়াল বন উজাড় করেছে সীমাহীন বেপরোয়া গতিতে। এরূপ কত ভাওয়াল গজারি বন বা কুমিল্লা কাহিনি অতিক্রম হয়ে গেছে একটা আরেকটাকে চ্যালেঞ্জ দিয়ে তার সব হিসাব আমাদের দুই চোখে কি ধারণ করা যায়! উন্নয়নবিরোধী মানুষ নই কেউ। কিন্তু উন্নয়ন করতে প্রথমেই গাছের ওপর দৃষ্টি যায় কেন? কোপটা গাছের ওপর দিতে হবে কেন? গাছেরা মিছিল করতে পারে না তাই?

কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন নিয়ে অনেক রাজনীতি হয়েছে, জল ঘোলা হয়েছে। সুন্দরবন ঝুঁকির মুখে এই যুক্তিতে পরিবেশবাদীরা অনেক দিন ধরেই রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের বিরোধিতা করে আসছেন। কিন্তু সব কান্না, প্রতিবাদ হারিয়ে গেছে। কিন্তু পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় মুনাফা যেখানে একমাত্র আরাধ্য দেবতা, সেখানে পরিবেশের প্রশ্নটি অত গুরুত্বপূর্ণ নয়। আমরা দেখছি, সুন্দরবনের গা ঘেঁষে রামপালে যে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র নির্মাণে বিভিন্ন পত্রিকার রিপোর্টের সূত্রে বলা; বন বিভাগ এখন পর্যন্ত বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে ১ লাখ ৭০ হাজার ৭৬৩ দশমিক ৬২ একর বনভূমি বরাদ্দ দিয়েছে। এক বছরের মধ্যে নতুন করে আরও ১৯ হাজার একর বনভূমি চেয়ে মন্ত্রণালয়ের কাছে প্রস্তাব পাঠিয়েছে এসব প্রতিষ্ঠান। মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গাদের জন্য ৪ হাজার ৮৩৫ একর বনভূমিতে আশ্রয়শিবির গড়ে তোলা হয়েছে।’ যে দেশের সংবিধানের ১৮ক অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘রাষ্ট্র বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নাগরিকদের জন্য পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন করিবেন এবং প্রাকৃতিক সম্পদ, জীববৈচিত্র্য, জলাভূমি, বন ও বন্য প্রাণীর সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা বিধান করিবেন।’ কিন্তু সরকার সাংবিধানিক এই বাধ্যবাধকতা প্রতিপালন তো করছেই না, বরং করছে উল্টোটা। উন্নয়নের নামে বনভূমি সাবাড় করা হচ্ছে। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা-এসডিজি পূরণে বনভূমির পরিমাণ দেশের মোট ভূখণ্ডের ১৫ দশমিক ৪৩ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ২০ শতাংশ করতে হবে। কিন্তু উল্টোপথে হাঁটছি আমরা।
এই যে সেদিনের আম্পানে সুন্দরবন বুক চিতিয়ে যেভাবে দেশকে বাচাল না হলে ঢাকাও ঝড়ে ফাঁকা হয়ে যেত। আমাদের শিক্ষা হয়নি সিডর-আইলাতেও। শুধু উন্নয়নের নামে গাছের ওপর কোপ, পাহাড়ের ওপর কোপ—এসব বন্ধ না হলে দুর্যোগ যেভাবে বাড়ছে, তাতে অনেক ক্ষতির বিনিময়ে চড়া মূল্য দেওয়ার সময় খুব আসন্ন। যেভাবে দেশজুড়ে গাছ কেটে সাবাড় করা হচ্ছে, উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে বনভূমি বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে, তাতে দুই বছর পর পরিবেশ রক্ষা সূচকে ইনশা আল্লাহ আমরা নিচ দিক থেকে প্রথম হতে পারব আশা করি। দেখেশুনে মনে হচ্ছে, উন্নয়নের সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা বুঝি পরিবেশ।

পরিবেশের কথা বললেই কিছু মানুষ প্রশ্ন করে, আপনি কি উন্নয়ন চান না? অবশ্যই চাই। উন্নয়ন যেমন চাই, চাই পরিবেশ সংরক্ষণও। একটা ছাড়া আরেকটি টেকসই হয় না। টেকসই উন্নয়নের জন্য চাই পরিবেশসম্মত উন্নয়ন। টেকসই উন্নয়ন যে পরিবেশকে সঙ্গে নিয়ে সমন্বিত উন্নয়ন এ কথা অনেকেই বুঝতে চায় না। এই মুহূর্তে এই সত্য না বুঝলে অনেক দেরি হয়ে যাবে। দেরি হয়ে গেলে তখন পরিবেশের অনেক ক্ষতি হয়ে যাবে। দেরি হয়ে যাওয়ার আগেই এই বিষয়টি বোঝা দরকার। কারণ একবার গাছ কেটে ফেললে আবার আগের অবস্থায় যেতে অনেক সময় লাগবে। তাই গাছ কাটার আগে, বন বরাদ্দ দেওয়ার আগে সব কটি বিকল্প চুলচেরা বিশ্লেষণ করে দেখতে হবে।

*গবেষক,