Thank you for trying Sticky AMP!!

এক পরিবারে চার শহীদ

পশ্চিম তেজতুরী বাজারে শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ভাইদের কবরস্থান দেখাচ্ছেন এখতিয়ার হাসান

বাড়ির সামনে কবরের পাশে নামফলকে পাঁচ শহীদের নাম লেখা। তাঁদের মধ্যে বখতিয়ার হাসান, কামরুল হাসান, রকিবুল হাসান, ইকবাল হাসান আপন চার ভাই। অপর জন আতাউর রহমান। ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর তাঁরা শহীদ হন। চার শহীদের অন্য দুই ভাই এখতিয়ার হাসান আর ফখরুল হাসানও মুক্তিযোদ্ধা। এখতিয়ার হাসানই তাঁর পাঁচ ভাই ও আতাউর রহমানকে নিয়ে যুদ্ধে যান। আতাউর রহমান শহীদ হওয়ার পর তাঁর একমাত্র বোন খোদেজা হাসানের সঙ্গে বিয়ে হয় এখতিয়ার হাসানের। তাই আতাউরের নামও যুক্ত হয়েছে নামফলকে।

রাজধানীর ৪৫/১ পশ্চিম তেজতুরী বাজারে পাঁচতলা ভবনের সামনেই বেশ বড় একটি জায়গায় কবরের পাশে পাঁচ শহীদের নাম লেখা। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ২০০৩ সালের বীর মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকার যে গেজেট প্রকাশ করা হয়েছে তাতে ৪১৬, ৪২০ থেকে ৪২৫ নম্বরে এই পাঁচ শহীদ মুক্তিযোদ্ধার নাম রয়েছে।
এখন জীবিত দুই ভাই মুক্তিযোদ্ধা ভাতা পাচ্ছেন। এর বাইরে দেশের কোনো ইতিহাসে এ পরিবারটি নিয়ে কোনো তথ্য আছে কি না তা জানেন না এখতিয়ার হাসান। তিনি জানালেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এ বাড়িতে পাঁচজন শহীদের নামে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করতে চেয়েছিলেন। তা তিনি করে যেতে পারেননি। বঙ্গবন্ধুর কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে পরিবারের পক্ষ থেকে কখনোই কোনো আবেদন জানানো হয়নি। সন্তানদের লেখাপড়া, চাকরি বা কোনো কাজেই বাবা, চাচাদের মুক্তিযোদ্ধা সনদ ব্যবহার করতে হয়নি। পারিবারিক উদ্যোগে তেজতুরী বাজারে বাড়ির পাশের গলির নাম রাখা হয়েছে শহীদ আতাউর রহমানের ডাকা নাম অনুসারে ‘নেহাল সড়ক’।
এখতিয়ার হাসানের একমাত্র মেয়ে নাজিয়া হাসান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের বাপ, চাচা, মামা মুক্তিযোদ্ধা, এটি আমাদের জন্য সম্মানের বিষয়। এর মধ্যে কয়েকজনকে হারানোর দুঃখ তো আছেই। তবে কেউ যখন আমাদের মুক্তিযোদ্ধা পরিবার বলে তখন গর্ব হয়।’

বিভিন্ন সেক্টর থেকে যুদ্ধ শেষ করে পরিবারের সদস্য এবং আতাউর রহমান খান পশ্চিম তেজতুরী বাজারের বাড়িটিতেই ফিরে আসেন। তবে ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর পূর্বপরিকল্পিতভাবে রাজাকারের দোসররা বাড়িটিতে ঢুকে তিনজনকে গুলি করে হত্যা করে। বখতিয়ার হাসান আর রকিবুল হাসানকে ধরে নিয়ে যায়। তাঁদের লাশ পরিবার খুঁজে পায়নি। শহীদ তিনজনের সঙ্গে হারিয়ে যাওয়া দুজনের নামও লেখা হয় কবরের পাশে। তেজতুরী বাজারের বাড়িটিতে এখন থাকেন এখিতয়ার হাসান ও তাঁর পরিবার। গ্যারেজের পাশে ছোট একটি ঘরে আছে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের প্রায় ঝাপসা হয়ে যাওয়া সাদাকালো ছবি, মুক্তিযোদ্ধা সনদসহ বিভিন্ন স্মারক। মুক্তিযুদ্ধের সময়ের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সঙ্গেও পরিবারের সদস্যদের ছবি আছে। সেখানে আছে বাবা, মা, অন্য ভাইবোনদের ছবি। ৭৩ বছর বয়সী এখতিয়ার হাসানের স্মৃতি প্রায় ঝাপসা হয়ে এসেছে। স্মৃতি হাতড়ে, দেয়ালে টাঙানো ছবিগুলো দেখে তিনি মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ করেন।
এখতিয়ার হাসানের বাবার নাম আবদুল হালিম। এখতিয়ার হাসানরা নয় ভাই, তিন বোন। তাঁদের মধ্যে ছয় ভাই মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। যুদ্ধের সময় ইকবাল হাসান মাত্র স্কুলের গণ্ডি পার হন। বড় ভাই বখতিয়ার হাসানের বিয়ের কথাবার্তা চলছিল। অন্যরা ছিলেন অবিবাহিত।

এখতিয়ার হাসানের শরীরে এখন নানান রোগ বাসা বেঁধেছে। তিনি ও তাঁর অন্য ভাইয়েরা মুক্তিযোদ্ধা পরিবার হিসেবে বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানিসহ যেসব সুবিধা পাওয়া যায় তার জন্য কখনোই চেষ্টা করেননি বলে জানান। শহীদ পরিবার হিসেবে কোনো বিশেষ আর্থিক সুবিধা তাঁরা পাননি বলেও তিনি জানান।
পরিবারের এতগুলো সদস্যকে নিয়ে কেন মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিলেন—এ প্রশ্নের উত্তরে এখতিয়ার হাসান বলেন, ‘তখন একই চাউল আমাদের এখানে এক দাম, পশ্চিম পাকিস্তানে আরেক দাম। কোনো বিষয়ে ন্যায্যতা ছিল না। বঙ্গবন্ধুও যুদ্ধের ডাক দিলেন। যুদ্ধের পর কোনো বেনিফিট পাই নাই। পুরোপুরি ন্যায্যতা না পাই, দেশ তো পাইছি।’
মুক্তিযুদ্ধে এ পরিবারের যে অবদান সে ইতিহাস পারিবারিকভাবেও লিখে রাখা হয়নি। মুক্তিযুদ্ধের অনেক স্মারকই সংরক্ষণ করা হয়নি। তবে ২৬ মার্চসহ ১৪ ও ১৬ ডিসেম্বর এবং বিভিন্ন জাতীয় দিবসে পরিবারের পক্ষ থেকে দোয়া মাহফিলসহ বিভিন্ন আনুষ্ঠানিকতায় শহীদদের স্মরণ করা হয়।
ইতিহাসে সেভাবে স্থান না পাওয়া প্রসঙ্গে এখতিয়ার হাসান বেশ খানিকটা আক্ষেপ নিয়েই বলেন, ‘যেনতেনভাবে মারা যাওয়া এক জিনিস, আর একই পরিবারের এতগুলো মানুষ শহীদ হওয়া আরেক জিনিস। ঢাকার বুকে বসবাস করার পরও যদি ইতিহাসে নাম না থাকে তাহলে আর আমাদের কী বলার আছে?’ তাঁর মেয়ে তরুণ প্রজন্মের প্রতিনিধি নাজিয়া হাসান বলেন, ‘অনেকেই পরিবারটির ইতিহাস লেখার ব্যাপারে আগ্রহ দেখিয়ে আবার পিছিয়ে গেছেন। এই বাড়িটিকেও সেভাবে সংরক্ষণ করা হয়নি।’