Thank you for trying Sticky AMP!!

ঐশী সমাজের গভীর ক্ষতের প্রতীকী রূপ

ঐশী রহমান সমাজের গভীর ক্ষতের প্রতীকী রূপ। তাঁর ঘটনা সমাজের মধ্যে থাকা দীর্ঘদিনের একটি গভীর ক্ষতকেই কেবল সামনে এনেছে। একে বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা হিসেবে দেখলে চলবে না। এ ঘটনা দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মাদকাসক্ত, হতাশা, বিপথগামী যেমন চোখে আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছে; তেমনি অনেক পরিবারের, বিশেষ করে বাবা-মায়ের অসচেতনতা ও সন্তান লালন-পালনে ব্যর্থতাকেও সমানভাবে সামনে এনেছে।
পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) কর্মকর্তা মাহফুজুর রহমান ও তাঁর স্ত্রী স্বপ্না রহমান হত্যার দায়ে তাঁদের একমাত্র মেয়ে ঐশী রহমানকে ফাঁসির দণ্ড দিয়েছেন আদালত। ঐশী গত বছরের ১৬ আগস্ট তাঁর বাবা-মাকে রাজধানীর চামেলীবাগের বাসায় হত্যা করেন।
বাবা-মাকে হত্যা এবং রায়ে মৃত্যুদণ্ড হওয়ার ঘটনাকে সমাজবিজ্ঞানী ও মনোবিজ্ঞানীরা সবার জন্যই সতর্কবার্তা হিসেবে দেখছেন। এই সতর্কবার্তা কিশোর-কিশোরী ও তরুণ-তরুণীদের জন্য যেমন প্রযোজ্য, তেমনি পরিবার তথা বাবা-মায়ের জন্যও প্রযোজ্য। তা ছাড়া বাংলাদেশে পারিবারিক বন্ধন যে অনেক ক্ষেত্রেই ক্ষয়ে যাচ্ছে, সেটাও প্রমাণ করছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও সমাজবিজ্ঞানী মাহবুবা নাসরীন প্রথম আলোকে বলেন, একটি মেয়ে তাঁর বাবা-মাকে হত্যা করেছেন। এ জন্য তাঁর সর্বোচ্চ শাস্তি হয়েছে। এটা একটা ঘটনা। কিন্তু খুঁজে বের করতে হবে এটা কেন ঘটল। এখানে সমাজের একটি চিত্র ফুটে উঠেছে। এখানে বড় ব্যর্থতা পরিবারের। কেননা, ঐশী একটি সচ্ছল পরিবারের সন্তান। কিন্তু এটা স্পষ্ট, তাঁর বাবা-মা ঠিকমতো তাঁকে লালন-পালন করতে পারেননি। একটি মেয়ের আচরণগত পরিবর্তন তাঁরা ধরতে পারেননি, তিনি কাদের সঙ্গে মেশেন তার খোঁজ নেননি। সর্বোপরি তাঁকে যে টাকা দেওয়া হচ্ছে, সেটা তিনি কোথায় ব্যয় করছেন, তা বাবা-মায়ের জানা ছিল না। এটা খারাপ লক্ষণ। সন্তানকে একেবারে ছেড়ে দিয়ে মানুষ করা যায় না। তাঁকে আগলে রাখতে হয়, বন্ধুর মতো পাশে দাঁড়াতে হয়। এ ঘটনা প্রমাণ করে যে কেবল আর্থিক চাহিদা পূরণ করলে, ভালো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়ালে বাবা-মায়ের দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না।
মাহবুবা নাসরীন বলেন, ঐশীর যে বয়স, সেটা ‘রোমান্টিসিজমের’, ‘ফ্যান্টাসির’। বাবা-মাকে এই বয়সের সন্তানের জন্য বাড়তি যত্ন নিতে হবে। তিনি কোন চ্যানেল বেশি দেখেন, সেটাও তাঁদের লক্ষ রাখতে হবে।
ঐশীর ফাঁসির দণ্ডের পর এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নানা আলোচনা হচ্ছে। অনেকেই বলছেন, এ দায় কি কেবল ঐশীর? নাকি পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রেরও দায় আছে? সর্বোচ্চ শাস্তি না দিয়ে লঘু শাস্তি দেওয়া যেত কি না, তা নিয়ে অনেকেই মন্তব্য দিয়েছেন।
তবে সমাজবিজ্ঞানী, মনোবিজ্ঞানী, আইনজীবীরা মনে করেন, আদালতকে আইনের মধ্য থেকেই রায় দিতে হয়। তাই এ রায় কী হয়েছে, সেটা এখন না ভেবে এ ঘটনার মাধ্যমে সমাজ কী শিক্ষা পেল, সেটাকে গুরুত্ব দেওয়া দরকার। ভবিষ্যতে যেন এমন ঘটনা না ঘটে, সেটাও খেয়াল রাখা দরকার।
আইনজীবী শাহদীন মালিক বলেন, মাদক এখন সমাজের সব স্তরে ছড়িয়ে পড়েছে। একসময় যেটা শহরে পাওয়া যেত, এখন তা গ্রামেও ছড়িয়ে গেছে। হাত বাড়ালেই এটা পাওয়া যাচ্ছে। তিনি বলেন, এর বিস্তার রোধ করতে হবে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে মাদক, হতাশা থেকে রক্ষা করতে হবে। কেননা, এ ঘটনা কোনো বিরোধ থেকে হয়নি।
আলাপকালে কয়েকজন আইনজীবী বলেন, ঐশীর ফাঁসি হোক এটা হয়তো অনেকেই চাননি। এর কারণ, ঐশীর বয়স অনেক কম। নিম্ন আদালত ফাঁসির রায় দিয়েছেন। এরপর হাইকোর্ট, সুপ্রিম কোর্টে মামলা যাবে। তখন হয়তো আদালত অপরাধের পাশাপাশি অনেক কিছু বিবেচনায় এনে শাস্তি কমাবেন। তবে ওই আইনজীবীরা এ-ও বললেন, এমন ঘটনা কেন ঘটল, সেটা খুঁজে দেখা বেশি জরুরি। আর কোনো সন্তানের ক্ষেত্রে যেন এমনটা না ঘটে, সেটা পরিবারকে লক্ষ রাখতে হবে।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের অধ্যাপক তাজুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, এখানে পরিবার, সমাজ, প্রশাসন ও রাষ্ট্রের ব্যর্থতা আছে। প্রথমত, পরিবার সন্তানের সঙ্গে ঠিকমতো যোগযোগ রাখতে পারেনি। তাঁর সমস্যা ধরতে পারেনি। সমাজও পারেনি। এর কারণ, এখন ছেলেমেয়েরা অনেক ক্ষেত্রে ‘এলাকার মুরব্বিদের’ কথা শোনে না। নিজেদের পরিবারের প্রভাব, রাজনৈতিক প্রভাব দেখাতে পছন্দ করে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ব্যর্থতা হলো, তারা ঐশীর সমস্যা পরিবারকে বলেনি। ঐশীর ফাঁসির আদেশ সম্পর্কে তিনি বলেন, এর ইতিবাচক দিক আছে। এটা অন্যদের কাছে এই বার্তা দেবে যে অপরাধ যেই করুক না কেন, সে ছাড়া পাবে না।