Thank you for trying Sticky AMP!!

ওদের স্বপ্নযাত্রা কি থেমে যাবে

>

ওদের কারও বাবা দিনমজুর, কারও বাবা ফেরিওয়ালা আবার কারও বাবা বদলি বাসচালক। সামান্য আয় দিয়েই চলে সংসার। দুবেলা ঠিকমতো খাবার জোটে না। এরপরও তারা এবার এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়েছে। এই সাফল্যে ওদের খুশিই হওয়ার কথা। কিন্তু ওরা সবাই চিন্তিত কলেজে ভর্তি হওয়া নিয়ে। আজ পড়ুন সাত অদম্য মেধাবীর গল্প।

জাহাঙ্গীর আলম


না খেয়ে স্কুলে যেত জাহাঙ্গীর
জাহাঙ্গীরের মা মানসিক ভারসাম্যহীন। বাবা বদলি বাসচালক। পাঁচ মেয়ে ও এক ছেলে নিয়ে আটজনের সংসার। শিক্ষকের কাছে পড়া তো দূরের কথা, অভাবের সংসারে কখনো না খেয়ে স্কুলে যেতে হতো জাহাঙ্গীরকে। ভাতের সঙ্গে মাংস কবে খেয়েছে, তা মনে নেই জাহাঙ্গীরের। এবারের এসএসসি পরীক্ষায় বিজ্ঞান বিভাগে জিপিএ-৫ পেয়েছে সে।

ভালো ফল করায় খুশি হলেও তার দুশ্চিন্তা কলেজে ভর্তি নিয়ে। জাহাঙ্গীর চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার হাবিলাসদ্বীপ ইউনিয়নের দক্ষিণ হুলাইন গ্রামের জসিমউদ্দিনের ছেলে। জাহাঙ্গীর চলতি বছর পটিয়ার এয়াকুবদণ্ডি এইচপি উচ্চবিদ্যালয় থেকে এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নেয়। এর আগে পিইসিতে সাধারণ গ্রেডে এবং জেএসসি পরীক্ষায় ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পায় সে।

জাহাঙ্গীরের বাবা জসিমউদ্দিন বদলি বাসচালক হিসেবে চট্টগ্রাম-পটিয়া মহাসড়কে যেদিন যার গাড়ি পান, সেটাই চালান। গাড়ি না পেয়ে প্রায়ই তাঁকে বসে থাকতে হয়। এভাবে কোনোরকমে সংসার চালাচ্ছেন তিনি। সম্বল বলতে দুটি ঘর। জাহাঙ্গীরের বড় বোন নিশাত তাসনিনও একই বিদ্যালয় থেকে জিপিএ-৫ পেয়েছিলেন। বর্তমানে তিনি কক্সবাজার মেডিকেল কলেজের দ্বিতীয় বর্ষে এবং মেজ বোন নগরীর বাকলিয়া সরকারি কলেজের এইচএসসি পরীক্ষার্থী, ছোট এক বোন সপ্তম শ্রেণিতে, এক বোন দ্বিতীয় শ্রেণিতে এবং সবার ছোটটা শিশু 

শ্রেণিতে পড়ছে।

এয়াকুবদণ্ডি এইচপি উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক পার্থ সারথী সাহা বলেন, জাহাঙ্গীর আলম অত্যন্ত দরিদ্র পরিবারের সন্তান। কিন্তু ছেলেটি অনেক ভদ্র ও মেধাবী। তাকে বিদ্যালয়ে টাকা দিতে হতো না। মেধার কারণে বৃত্তির টাকা পেত। সে ক্লাসের বাইরে কখনো শিক্ষকের কাছে পড়েনি।

আজমিতা আক্তার


সেলাইয়ের কাজ করে পড়েছে আজমিতা
আজমিতা আক্তাররা তিন বোনই পড়াশোনা করে। তাদের বাবা দিনমজুর। যে আয় করেন, তা দিয়ে দুবেলার খাবারই ঠিকমতো জোটে না। পড়ার খরচ জোগাতে আজমিতা সেলাইয়ের কাজ করেছে। রংপুরের তারাগঞ্জের দরিদ্র পরিবারের এই মেয়ে এবার এসএসসিতে মানবিক বিভাগ থেকে জিপিএ-৫ পেয়েছে। এখন কলেজে ভর্তি ও পড়ার খরচ নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছে সে।

আজমিতার বাড়ি উপজেলার কুর্শা ইউনিয়নের রহিমাপুর মধ্যপাড়া গ্রামে। তিন বোনের মধ্যে আজমিতা সবার বড়। তার অন্য দুই বোন আরমিন আক্তার নবম শ্রেণি ও শারমিন আক্তার শিশু শ্রেণিতে পড়ছে। তাদের সম্বল বলতে বসতভিটার ৮ শতক জমি।

মা আমেনা বেগম অন্যের বাড়িতে কাজ করে সংসারে সহায়তা করেন। সংসারের দুর্দশা দেখে বুড়িরহাট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান সিরাজুল ইসলাম আজমিতাকে তিন বছর আগে একটি সেলাই মেশিন কিনে দেন। সেই মেশিন দিয়ে আজমিতা বাড়িতে কাপড় সেলাইয়ের কাজ করে লেখাপড়ার খরচ চালিয়েছে। বুড়িরহাট উচ্চবিদ্যালয় থেকে এসএসসিতে অংশ নিয়ে সে জিপিএ–৫ পেয়েছে।

কুর্শা ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য তুহিনুর ইসলাম বলেন, ‘আজমিতার সংসারের অবস্থা খুবই খারাপ। ফরম পূরণের সময় আমি তাকে সহায়তা করেছি। কিছুদিন আগেও তার মাকে ১০ কেজি ভিজিএফের চাল দিয়েছি।’

মো. ইসমাইল


শাকসবজি খেয়েই বড় হয়েছে ইসমাইল
ভোলার বোরহানউদ্দিন পৌরসভার ২ নম্বর ওয়ার্ডে দরিদ্র বর্গাচাষি আবদুল মান্নানের ছেলে ইসমাইল বোরহানউদ্দিন সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে চলতি বছরে বিজ্ঞান বিভাগে জিপিএ-৫ পেয়েছে। নিজের জমি মাত্র ২০ শতাংশ। আরও ৪০ শতাংশ জমি বর্গা নিয়ে কৃষিকাজ করে কোনোরকমে সাত সদস্যের পরিবারের খরচ জোগাড় করেন আবদুল মান্নান। তাঁর পাঁচ মেয়ে ও দুই ছেলে। ইসমাইলের ছোট ভাই ইসরাফিল একই স্কুলে দশম শ্রেণিতে পড়ে। ইসমাইলের স্কুলের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক শাহ মোহাম্মদ আবু নোমান জানান, ইসমাইলের মেধাশক্তি অসাধারণ।

ইসমাইলের বাবা আবদুল মান্নান ও মা জরিনা বেগম বলেন, খুব কম দিনই সন্তানদের মাছ-মাংস খাওয়াতে পেরেছেন। শাকসবজি খেয়েই সন্তানেরা বড় হচ্ছে। এত অভাবের পরও ভালো ফল করেছে ইসমাইল। যত কষ্টই হোক, ছেলেদের শিক্ষিত করে গড়ে তুলবেন তাঁরা। জমি বিক্রি করে হলেও ছেলেদের পড়াবেন।

জ্যোতি আকতার


সব সময় ক্লাসে সেরা ছিল জ্যোতি
অভাব-অনটনের সঙ্গে লড়াই করে বড় হয়েছে জ্যোতি। দুবেলা দুমুঠো ভাতও ঠিকমতো জোটেনি। সময়মতো বই-খাতা, কলম, স্কুল-পোশাক জোটেনি। শত প্রতিকূলতা পেরিয়ে এবার কাহালু উপজেলার মুরইল আদর্শ উচ্চবিদ্যালয়ের ছাত্রী জ্যোতি এসএসসিতে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে জিপিএ-৫ পেয়েছে।

তার বাড়ি বগুড়ার কাহালু উপজেলার ভালতা-নাড়ুয়া গ্রামে। তার বাবা জাহাঙ্গীর আলম পেশায় ফেরিওয়ালা। মা বিউটি বেগম গৃহিণী। বসতভিটা ছাড়া পরিবারের আর কোনো সহায়–সম্বল নেই। জ্যোতির বাবা জাহাঙ্গীর আলম স্বল্প পুঁজির ফেরিওয়ালা। শহর থেকে সিট কাপড় কিনে এনে পুরোনো একটা সাইকেলে গ্রামে গ্রামে ঘুরে তিনি ফেরি করে বিক্রি করেন।

জাহাঙ্গীর আলম প্রথম আলোকে বলেন, অনেক কষ্ট করে তিন মেয়েকে পড়াশোনা করাচ্ছেন। বড় মেয়ে উম্মে জান্নাতুল মাওয়া ইংরেজিতে অনার্স পাস করে ঢাকায় একটি কলেজে মাস্টার্স করছেন। সবার ছোট মেয়ে নাবিলা তাবাসসুম মুরইল আদর্শ উচ্চবিদ্যালয়ে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ছে।

মুরইল আদর্শ উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নুরুল ইসলাম বলেন, মেয়েটা প্রচণ্ড মেধাবী। সব সময় ক্লাসে সেরা ছিল। ভালো ফল করবে—সেই বিশ্বাস তার ওপর ছিল। শত প্রতিবন্ধতা জয় করে মেয়েটা কাঙ্ক্ষিত সাফল্য অর্জন করেছে।

রাজু ইসলাম


কুপির আলোতেই পড়েছে রাজু
বিদ্যুৎ নেই, তাই রাত জেগে কুপির আলোতেই লেখাপড়া করেছে রাজু। কেরোসিনের অভাবে প্রায়ই নিভে যেত কুপি, কিন্তু নেভেনি রাজু ইসলাম। এবারের এসএসসি পরীক্ষায় নীলফামারী সরকারি উচ্চবিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞান বিভাগে জিপিএ-৫ পেয়েছে সে। তার বাবা আলম মিয়া কৃষিশ্রমিক। বাবার সামান্য আয়ে চলে পাঁচ সদস্যের পরিবার। রাজুর দুই বোন আসমা আক্তার ও খুশি আক্তারও লেখাপড়া করছে। এখন কলেজে ভর্তি হওয়া নিয়ে চিন্তিত রাজু।

রাজুর বাড়ি নীলফামারী সদরের কুন্দপুকুর ইউনিয়নের দেবীরডাঙ্গা মুন্সিপাড়া গ্রামে। তার বড় বোন আসমা আক্তারও এবার মানবিক বিভাগ থেকে এসএসসি পাস করেছে। ছোট বোন খুশি আক্তার সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে। ৪ শতক বসতভিটাই ওদের সম্বল। রাজু ইসলাম জানায়, বেশির ভাগ সময়ে তিন বেলা পেট পুরে খাওয়া জোটেনি। অনেক দিন তাকে স্কুলে যেতে হয়েছিল অভুক্ত হয়ে। পঞ্চম শ্রেণিতে জিপিএ-৫ পেয়ে সাধারণ গ্রেডে বৃত্তি পায় সে। জেএসসি পরীক্ষায়ও জিপিএ-৫ অর্জন করে সাধারণ গ্রেডে বৃত্তি পায়। রাজু বলে, ‘বাড়িতে বিজলি বাতির আলো নেই। রাত জেগে কুপির আলোতেই পড়তে হয়েছে। প্রায়ই ফুরিয়ে যেত কুপি বাতির কেরোসিন। ফলে দিনের আলোতেই বেশির ভাগ সময়ে পড়া শেষ করতে হতো।’

সুজন মিয়া


কৃষিশ্রমিকের কাজ করত সুজন
দিনমজুর বাবা মোবারক আলীর সঙ্গে অন্যের জমিতে কৃষিশ্রমিকের কাজ করেও সুজন মিয়া বিজ্ঞান বিভাগ থেকে জিপিএ–৫ পেয়েছে। লালমনিরহাটের আদিতমারীর দুর্গাপুর ইউনিয়নের উত্তর গোবধা গ্রামের মোবারক আলী ও খায়রন নেছা দম্পতির তিন সন্তানের একজন সুজন মিয়া। পরিবারটির সম্পদ বলতে বাড়ির ভিটার ৩ শতক জমি আর কয়েকটি হাঁস–মুরগি।

বড় ছেলে খায়রুল ইসলাম সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ে অভাবের কারণে আর পড়তে পারেননি। বর্তমানে তিনি চট্টগ্রামে একটি কারখানায় শ্রমিকের কাজ করেন। বিয়ে করে সেখানেই থাকেন। সুজনের একমাত্র মেয়ে মোমেনা খাতুন অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময় তার বাল্যবিবাহ হয়ে যায়। সুজন মিয়া বাবার সঙ্গে কৃষিশ্রমিকের কাজ করেও পড়াশোনা চালিয়ে গেছে।

২০১৭ সালে একই বিদ্যালয় (গন্ধ মরুয়া বিএল উচ্চবিদ্যালয়) থেকে সুজন জেএসসিতেও জিপিএ–৫ ও সাধারণ গ্রেডে শিক্ষা বৃত্তি পায়। সুজন মিয়া বলে, ‘আমার এক ভাই আর এক বোন টাকার অভাবে পড়তে পারে নাই। আমি বাবার সাথে অন্যের জমিতে কৃষিশ্রমিকের কাজ করে এবং গ্রামের প্রাথমিক শ্রেণির শিক্ষার্থীদের পড়িয়ে আয় করে এসএসসি পর্যন্ত পড়লাম। এখন ভালো শহরে ভালো কলেজে পড়তে চাই, কিন্তু বাবার তো সামর্থ্য নেই।’

রাকিব তৌহিদুল


গ্রামের বড় ভাইদের সহায়তা পেয়েছে রাকিব
চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুর উপজেলার খোসালপাড়ার হতদরিদ্র পরিবারের রাকিব তৌহিদুল গোমস্তাপুর পাইলট উচ্চবিদ্যালয় থেকে এসএসসি পরীক্ষায় এবার জিপিএ-৫ পেয়েছে। তার বাবা রাজমিস্ত্রির সহযোগী হিসেবে কাজ করেন। রাকিবরা তিন ভাই, এক বোন। বাবার অনিয়মিত আয়ে তিন বেলা ঠিকমতো খাবারই জোটেনি। টাকার অভাবে চাঁপাইনবাবগঞ্জ পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে দ্বিতীয় সেমিস্টারে পড়ার সময় বড় ভাই মো. অনিকের লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যায়। তিনি এখন ট্রাকচালকের সহকারী হিসেবে কাজ করেন।

রাকিব জানায়, সে প্রাথমিক ও নিম্নমাধ্যমিক পরীক্ষায় বৃত্তি পেয়েছে। বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা ও বিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা কমিটির সাবেক সভাপতি মোমতাজ উদ্দিন ও গ্রামের বড় ভাইয়েরা তাকে বিনা পয়সায় পড়িয়েছেন। এ ছাড়া এলাকায় অদম্য মেধাবীদের সংগঠন ‘জিনিয়াস ওয়েল ফেয়ার এসোসিয়েশন’ও তাঁকে সহযোগিতা করেছে।

মোমতাজ উদ্দিন বলেন, ‘রাকিবদের পরিবারে তিন বেলা খাবারই জোটে না। সে প্রায় দিনই না খেয়ে স্কুলে যেত। অথচ প্রাইমারি ও জুনিয়রে বৃত্তি পেয়েছে। বিদ্যালয়ে সভাপতি থাকাকালে বিষয়টি জানতে পেরে আমি তাকে বহুদিন থেকেই বিনা পয়সায় প্রাইভেট পড়াই। উচ্চশিক্ষার জন্য তার সহযোগিতা দরকার।’

[তথ্য দিয়েছেন নিজস্ব প্রতিবেদক, চাঁপাইনবাবগঞ্জবগুড়া; প্রতিনিধি, ভোলা, পটিয়া, তারাগঞ্জ, নীলফামারীলালমনিরহাট]