Thank you for trying Sticky AMP!!

কঙ্কাল চক্রে মেডিকেল কর্মী

২০১৫ সালে কঙ্কাল পাচারের অভিযোগে গ্রেপ্তার হন শাকিল। এরপর তাঁকে অ্যানাটমি বিভাগ থেকে ছাত্রাবাসে বদলি করা হয়।

মানুষের ১২টি মাথার খুলি, ২ বন্তা হাড়গোড়সহ গ্রেপ্তার হওয়া বাপ্পী

মানুষের ১২টি মাথার খুলি, ২ বস্তা হাড়সহ গত ১৫ নভেম্বর মো. বাপ্পী (৩২) নামের এক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করে ময়মনসিংহের কোতোয়ালি থানার পুলিশ। বাপ্পীর ই–মেইল আইডি ঘেঁটে ভারত ও নেপালের কঙ্কাল ব্যবসায়ীদের সঙ্গে তাঁদের যোগসূত্র পেয়েছে পুলিশ। তাঁর কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের বরাত দিয়ে পুলিশ জানায়, এই চক্রের অন্যতম হোতা হলেন স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মচারী মো. শাকিল। তাঁর মাধ্যমেই বাপ্পী কঙ্কাল পাচারকারীদের এই চক্রে যুক্ত হন। শাকিল আগে ময়মনসিংহে কর্মরত ছিলেন, এখন তাঁকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।

পুলিশ খুঁজে না পেলেও শাকিলের খোঁজ পাওয়া গেল কাছেই ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে। প্রথম আলোর অনুসন্ধানে জানা গেছে, শাকিল আগে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের অ্যানাটমি বিভাগে চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী হিসেবে কাজ করতেন। ২০১৫ সালে প্রথম দফায় কঙ্কাল পাচারের অভিযোগে গ্রেপ্তার হন তিনি। এরপর তাঁকে অ্যানাটমি বিভাগ থেকে ছাত্রাবাসে বদলি করা হয়। এখন তিনি একটি ছাত্রাবাসের নৈশপ্রহরীর দায়িত্ব পালন করছেন। গত সোমবার রাতেও শাকিল তাঁর চাকরিস্থলে উপস্থিত ছিলেন এবং হাজিরা খাতায় সইও করেছেন। তাঁর বিরুদ্ধে কঙ্কাল চক্রে যুক্ত থাকার অভিযোগে সেই মামলাটি এখন বিচারাধীন।

২০০৪ সালে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের অ্যানাটমি বিভাগের ৪র্থ শ্রেণির কর্মচারী হিসেবে কাজ শুরু করেন শাকিল। কঙ্কাল ব্যবসায় অবৈধভাবে যুক্ততার অভিযোগে ২০১৫ সালে তিনি গ্রেপ্তার হন।

ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ ও নগরের কয়েকটি স্থানে খোঁজ নিয়ে জানা গেল, ২০০৪ সালে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের অ্যানাটমি বিভাগের ৪র্থ শ্রেণির কর্মচারী হিসেবে কাজ শুরু করেন শাকিল। কঙ্কাল ব্যবসায় অবৈধভাবে যুক্ততার অভিযোগে ২০১৫ সালে তিনি গ্রেপ্তার হন। এরপর তাঁকে বদলি করে মেডিকেল কলেজ ছাত্রাবাসের নৈশপ্রহরীর দায়িত্ব দেওয়া হয়।

মেডিকেল কলেজ সূত্রগুলো জানায়, ২০১৫ সালে গ্রেপ্তার হওয়ার পর পুলিশের কাছে কঙ্কাল চক্রের সদস্য হিসেবে মেডিকেলের কর্মচারী রাজ্জাক, সুমন ও নুরুর নাম বলেছিলেন শাকিল। পুলিশ ওই তিনজনকে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদও করেছিল। খুঁজে পেয়ে গত মঙ্গলবার এই তিনজনের সঙ্গেই কথা হলো। তাঁদের ভাষ্য, শাকিল কঙ্কাল কেনাবেচা করতেন বলে এখনো সবাই জানে। নিজেকে বাঁচাতে তখন পুলিশের কাছে তাঁদের নাম বলেছিলেন তিনি। তাঁরা এসব কাজে যুক্ত নন, পরে পুলিশের তদন্তেও তা প্রমাণিত হয়েছে।

কঙ্কাল চক্রে শাকিলের যুক্ততার বিষয়ে জানেন ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের উপাধ্যক্ষ আখতারুন নেছাও। তিনি প্রথম আলোর কাছ থেকে শাকিলের বিরুদ্ধে অভিযোগ শুনে বলেন, ‘শাকিলের বিরুদ্ধে এর আগেও এ ধরনের অভিযোগ ছিল। পরে তাঁকে বদলি করে ছাত্রাবাসে পাঠানো হয়েছিল। এবারও তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেলে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

তবে শাকিল প্রতিদিনই ছাত্রাবাসে তাঁর দায়িত্ব পালন করছেন বলে জানালেন ছাত্রাবাসের কেয়ারটেকার সাজু আহমেদ। রেজিস্টার খাতা দেখে মঙ্গলবার সাজু আহমেদ বলেন, শাকিল গত রাতেও (সোমবার) দায়িত্ব পালন করেছেন এবং তিনি ছাত্রাবাসের ভেতরেই থাকেন। শাকিলকে পাওয়া গেল না। শাকিলের সঙ্গে কথা বলার ইচ্ছার কথা জানালে কেয়ারটেকার সাজু আহমেদ বলেন, সম্প্রতি শাকিল মুঠোফোন ব্যবহার করছেন না। তবে পরে সুযোগ পেলে তিনি শাকিলের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেবেন।

শাকিলের বিষয়ে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ চিত্তরঞ্জন দেবনাথ বলেন, কঙ্কাল পাচারকারী চক্রের সঙ্গে শাকিলের যুক্ত থাকার কথা তিনি জেনেছেন। ঘটনা তদন্তে একটি কমিটি গঠন করা হবে বলে জানান তিনি।

মানুষ থেকে কঙ্কাল তৈরি

স্থানীয় সূত্রগুলো জানায়, ময়মনসিংহ অঞ্চলের বিভিন্ন গ্রামে সম্প্রতি কবর থেকে লাশ চুরির বেশ কয়েকটি ঘটনা ঘটলেও এগুলো উদ্‌ঘাটনে পুলিশের তেমন তৎপরতা দেখেননি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। এর মধ্যে চলতি বছর অক্টোবরে ত্রিশালের ভাটিপাড়া গ্রাম থেকে ৮টি, মার্চে ফুলপুরের তারাপুর গ্রামের কবরস্থান থেকে ১০টি কঙ্কাল চুরি হয়। এ ছাড়া গত বছরের অক্টোবরে পাগলা থানার টেকপাড়া গ্রামে, ২০১৮ সালে গৌরীপুর উপজেলার ভাঙ্গনামারি গ্রামে এবং ২০১৭ সালে ময়মনসিংহ সদরের খাগডহরে ও হালুয়াঘাট উপজেলার দড়িনগুয়া গ্রামে কবর থেকে একাধিক কঙ্কাল চুরি হওয়ার ঘটনা ঘটেছিল। স্থানীয় ব্যক্তিরা মনে করছেন, এসব চুরির সঙ্গে কঙ্কাল পাচারকারী চক্রের যোগসাজশ রয়েছে।

প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে বাপ্পী জানিয়েছেন, তিনি বিভিন্ন ব্যক্তির মৃত্যুর খবর পেয়ে জানাজায় অংশ নিতেন এবং কবরস্থান থেকে লাশ চুরি করতেন। তাঁদের এই চক্র কয়েকটি দলে ভাগ হয়ে পুরো কাজ সম্পাদন করত।
ফারুক হোসেন, কোতোয়ালি থানার পরিদর্শক

বাপ্পীর বিষয়ে কোতোয়ালি থানার পরিদর্শক ফারুক হোসেন বলেন, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে বাপ্পী জানিয়েছেন, তিনি বিভিন্ন ব্যক্তির মৃত্যুর খবর পেয়ে জানাজায় অংশ নিতেন এবং কবরস্থান থেকে লাশ চুরি করতেন। তাঁদের এই চক্র কয়েকটি দলে ভাগ হয়ে পুরো কাজ সম্পাদন করত। তবে একেক দলের কাজ একেক রকম। লাশ চুরি, রাসায়নিক ব্যবহার, প্রক্রিয়াজাতকরণ, কঙ্কাল আনা–নেওয়া, সরবরাহ করা—এসব একেকটি কাজ একেকজন করতেন বলে বাপ্পী পুলিশকে তথ্য দিয়েছেন।

পুলিশ জানায়, কঙ্কাল চক্রে যুক্ততার অভিযোগে বাপ্পী এর আগেও গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। ইজিবাইকচালক বাপ্পীকে দলে ভেড়ান শাকিল। কিছুদিনের মধ্যেই বাপ্পী মানবদেহের ২০৬টি হাড় যুক্ত করে পূর্ণাঙ্গ অবয়ব দিতে শেখেন। কোনো একটি স্থানে লাশ প্রক্রিয়ার পর হাড়গোড়গুলো বস্তা বা কার্টনে ভরে বাপ্পীকে দেওয়া হতো। বাপ্পী সেগুলো বাছাই করে ২০৬টি হাড়ের ‘সেট’ বানিয়ে জায়গামতো পোঁছে দিয়ে দিতেন।

থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ফিরোজ তালুকদার জানান, বাপ্পীর ই–মেইল আইডি ঘেঁটে ভারত ও নেপালের বিভিন্ন কঙ্কাল ব্যবসায়ীদের সঙ্গে তাঁদের যোগসূত্র পাওয়া গেছে। ই–মেইলে আদেশপত্র ও অর্থ লেনদেনের কিছু তথ্য পাওয়া গেছে। তাঁর ধারণা, এসব খুলি ও হাড়গোড় ভারত কিংবা নেপালে পাচার করা হতো।