Thank you for trying Sticky AMP!!

কবি আর তাঁর স্মৃতির শহর

শামসুর রাহমান

‘এ শহর ক্ষুধাকেই নিঃসঙ্গ বাস্তব জেনে ধুলায় গড়ায়;/ এ শহর পল্টনের মাঠে ছোটে, পোস্টারের উল্কি-ছাওয়া মনে/ এল গ্রেকো ছবি হয়ে ছোঁয় যেন উদার নীলিমা,/ এ শহর প্রত্যহ লড়াই করে বহুরূপী নেকড়ের সাথে।’

১৯৭০ সালে ঘাতকের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যে মুক্তিকামী শহরের বিপন্ন ও লড়াকু ছবি আঁকেন শামসুর রাহমান, তাঁর ‘এ শহর’ কবিতায়, ১৯৭৯ সালে স্বাধীন স্বদেশের সেই প্রিয় ঢাকা শহরকে নিয়ে তিনি লিখলেন এক অনুপম আত্মকথন স্মৃতির শহর (প্রথম প্রকাশক শিশু সাহিত্য বিতান, চট্টগ্রাম। বর্তমান প্রকাশক প্রথমা প্রকাশন)। কবির ৫০ বছর বয়সে প্রকাশিত এই বই খুঁজে ফিরেছে প্রায় ৫০০ বছর পুরোনো কিন্তু তাঁর চোখে চিরনতুন এক শহরকে। গৎবাঁধা স্মৃতিকথা বা ইতিহাসের বদলে যেনবা রূপকথার কাঠামোতে তুলে ধরেছেন কবি তাঁর প্রাণের প্রহরময় শহর ঢাকাকে।

ব্যঙ্গমা আর ব্যঙ্গমির গল্প শুনতে গিয়ে কবি উল্টো তাদের জিজ্ঞেস করেন, ‘আমার গল্প শুনবে তোমরা?’

‘কী তোমার পরিচয়?’

‘ছড়া কাটি, কবিতা বানাই। ভালোবাসি আমার শহরকে, যেখানে আমি জন্মেছি।’

‘সেই শহরের গল্প শোনাতে পারবে তুমি?’

‘চেষ্টা করে দেখতে পারি।’

বলা যায়, সে চেষ্টারই ফল ছোট্ট এক রূপছবিময় বই স্মৃতির শহর, যার সম্পর্কে ঢাকাপ্রেমী কথাকার আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের পর্যবেক্ষণ: ‘জীবনের স্তরে স্তরে প্রবেশ করতে, তার পাতালের কালি কুড়িয়ে আনতে, তার সকল রহস্যময়তা খুলে দেখার জন্য বারবার তিনি মাধ্যম করেছেন এই শহরকে। স্মৃতির শহর-এ কিন্তু ঢাকা তাঁর বক্তব্য প্রকাশের একটি মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হয়নি, ঢাকা এখানে উত্তীর্ণ হয়েছে সম্পূর্ণ বিষয়বস্তুতে, ঢাকাই তাঁর বক্তব্য।’ (স্মৃতির শহরে কবির জাগরণ)

শহর ঢাকা শামসুর রাহমানের অভেদাত্মা। বইজুড়ে বারবার এসেছে আলো-আঁধারের কথা; এই শহরের পটে আলোয় ঝিকমিক তারা যেমন রুপোলি চকলেট হয়ে ধরা দেয় কবির কৈশোরে, তেমনি বেলা শেষে অন্ধকার ‘আম্মার মতো আদর করে’ নিয়ে চলে ঘুমের দেশে।

কবির জন্ম-গলি মাহুতটুলী। বলছেন তিনি, মাহুতটুলীতে তিনি কোনো হাতিশালা দেখেননি। তবে এখান থেকে ক্রমেই ঢুকে পড়েছেন ঢাকার সদর অন্দরে। দেখলেন কত প্রকারের মানুষ আর একেকটা মানুষের ভেতরে কত ছবি, কত গান!

এই যেমন শবরি আমের গাছওয়ালা বাড়ির মালিক তেলবিক্রেতা বুড়ি। তেলের কারবার বন্ধ করে যে একসময় শুরু করে পিঠার সওদাপাতি। এমনিতে রুক্ষ-খিটখিটে বুড়ি পাখির জন্য প্রতি দুপুরে দুমুঠো ভাত-তরকারি দরজার ওপরে ঝুলে থাকা টিনে ছিটিয়ে দিত—এই গল্প শোনার পর বুড়ির সংবেদী সত্তা ফুটে ওঠে পাঠকের চোখে।

স্মৃতির শহর

সআলো-আঁধারির মতো রঙের ছটায়ও ভাস্বর এই বই। সিতারা মসজিদের বিবরণে গম্বুজ আর কবুতরের যে দৃশ্য অক্ষরে আঁকেন কবি, তা যেকোনো খরা-চোখে বইয়ে দিতে পারে রঙের ফোয়ারা: ‘অবাক হয়ে দেখতাম, কবুতরগুলো গলা ফুলিয়ে, মাথা দুলিয়ে চলাফেরা করছে গম্বুজ থেকে গম্বুজে। কখনো একসঙ্গে জড়ো হচ্ছে, কখনো আবার ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ছে। কখনো মনে হয়, ওরা যেন গুচ্ছ গুচ্ছ ফুল, আবার কখনো মনে হয়, একজন দরবেশ মসজিদের গম্বুজে ছিটিয়ে দিচ্ছেন রুপোলি পানি আর সেই পানির ফোঁটা থেকে জন্ম নিচ্ছে নানান কবুতর।’

পোগোজ ইশকুল আর তার ক্লাস-পরীক্ষার আঙিনা থেকে কিশোর শামসুর শাঁখারীবাজারে গিয়ে দেখেন শাঁখের কাজ, পরাক্রমী সময় যার বুকে বসায় করাত। মহররমে হোসেনি দালান শোকার্ত দাঁড়িয়ে থাকত, যেন সেই কারবালার মাঠ। তাজিয়া মিছিলে রক্তের ছড়াছড়ির চেয়ে কবির ভালো লাগে আলোর অলংকার পরা রাতের হোসেনি দালান। আর তখনই মন্দিরেতে কাঁসর ঘণ্টা বাজল ঢং ঢং। ইশকুলে সরস্বতীপূজার উৎসব। রাঙা পায়ের নিচে পদ্ম আর সাদা একটা হাঁস। হাতে বীণা। সরস্বতীর বাহন হাঁস আর তাদের বাড়ির পোষা হাঁস তখন থেকে এক হয়ে যায় যেন। তাই একদিন স্কুল থেকে ফিরে যখন জানল তার সামনের প্লেটে অপেক্ষা করছে তারই প্রিয় হাঁসের রান্না করা মাংস, তখন আর খাওয়া হয় না তার, বরং:

‘সরস্বতীর শাদা হাঁস যেন উড়ে এল আমার কোলে ওর শাদা ডানা মেলে। হাঁস আমাকে নিয়ে চলেছে, ওর ধবধবে পিঠের ওপর বসিয়ে নিয়ে চলেছে ঢাকা শহরের অনেক ওপর দিয়ে। সরস্বতীর হাঁস জাদুর গালিচা হয়ে গেছে যেন।’

ঢাকা মানে শামসুর রাহমানের স্মৃতিতে কেবল দালানকোঠা বা ঘটনা-ঘনঘটা নয়, ঢাকা মানে মূলত হরেক রঙের মানুষ, যাদের রঙে শহরটা রঙিন ছিল ভীষণ। সেই নৌকো-নদীনালা-মেঘমেঘালি-পাখপাখালির ছবি আঁকিয়ে নঈম মিঞা, সেই নাম না-জানা ভিস্তি, ঢাকাবাসীর পানির বন্দোবস্ত করতে যে, ‘আসত ভরা, ফোলা ফোলা মশক পিঠে বয়ে, ফিরে যেত মস্ত চুপসে যাওয়া, হাওয়া নেই বেলুনের মতো মশকটা কাঁধে ঝুলিয়ে। মশকটাকে ওর শরীর থেকে আলাদা কিছু বলে ভাবতে পারতাম না। মনে হতো, ওটা বুঝি ওর শরীরেই গজিয়ে উঠেছে।’

আমার ঢাকা

আর কে নয় এই বইয়ের চরিত্র! ঘোড়ার গাড়ি, বাকরখানি, বুড়িগঙ্গার বুকে নবাব সিরাজের পরিবারের সলিলসমাধি, পরীবিবির স্মৃতিবাহী লালবাগ কেল্লা, আহসান মঞ্জিলের নবাবি খুশবু, রামমোহন রায় লাইব্রেরি ও রিডিং রুম, মেরাসিনের গান, এমনকি বড় কাটরা-ছোট কাটরার পুরোনো ইটের ফাঁকের শেওলা আর ধুলাবালিও তো স্মৃতির শহর-এর সোচ্চার চরিত্র, সবারই কণ্ঠে এই জাদুশহরের কিসসা।

শামসুর রাহমান ভিক্টোরিয়া পার্কের পাশ দিয়ে পথ চলতে গিয়ে বলেন বইয়ের দোকান ‘বৃন্দাবন ধর এন্ড সন্স’-এর কথা, তাই বলে ভোলেন না ভিক্টোরিয়া পার্ক, অর্থাৎ পুরোনো আন্টাঘর ময়দানের গাছে গাছে সিপাহি বিদ্রোহের বীরদের ফাঁসিতে ঝোলানোর রক্তাক্ত ইতিহাস। ইতিহাসের সড়ক ধরে হাঁটতে হাঁটতে ঢুকে পড়েন ১৯৪৩ সালের এক দুর্ভিক্ষ-রাতের গল্পে। চৌদ্দ বছরের তিনি, রুটি-আলুভাজা খেতে বসেছেন, হঠাৎ: ‘ভূত দেখার মতো চমকে উঠলাম। জানালায় একজোড়া চোখ আর কী দৃষ্টি সেই চোখে। রাজ্যির ক্ষুধা এসে যেন জড়ো হয়েছে সেই একজোড়া চোখের ভেতরে৷ মুখে একরত্তি মাংসের চিহ্ন নেই, হাড় আর চামড়া একাকার হয়ে গেছে। তারপর কী ঘটল কিছুই মনে করতে পারলাম না। দেখলাম, আমার বাসন খালি। আটার রুটি দেখলেই আমার সেই ভুতুড়ে সন্ধ্যাটির কথা মনে পড়ে যায়। আমার সামনে ভেসে ওঠে একজোড়া চোখ, যে চোখে জ্বলে উঠেছিল সারা বাংলাদেশের ক্ষুধা।’

শামসুর রাহমান বলেছেন ছোরার ছায়ায় তাঁর ও এই শহরের বেড়ে ওঠার গল্প। এই শহরের বুকে বোন নেহারের মৃত্যু তাঁর কবিসত্তার জন্ম দিয়েছে, নির্জন দুর্গের অন্ধকার থেকে বের করে এনেছে আলোপৃথিবীর উদাত্ত অঙ্গনে।

স্মৃতির শহর বইয়ের বহু বছর পর প্রিয় ঢাকাকে নিয়ে লেখা কিছু কবিতা ও গদ্য স্থান পেয়েছে আমার ঢাকা (প্রথমা প্রকাশন) বইয়ে। অন্তঃসম্পদে ও শোভায় এ যেন স্মৃতির শহর-এর সম্পূরক বই৷ পাতা ওলটাই আমরা আর কবিহীন ঢাকায় ঘনীভূত আঁধারে খুঁজতে থাকি কোথায় তাঁর শৈশবের বাতিওয়ালা! গুলিস্তানের দিকে এক চক্কর দিতে গিয়ে দেখি নূর হোসেন স্কয়ারে ‘বুক তাঁর বাংলাদেশের হৃদয়’ বলে শামসুর রাহমান দাঁড়িয়ে, শাহবাগের নিঝুম স্থাপত্য পেরোতে গিয়ে দেখি সেখানেও শামসুর রাহমান; বলছেন, ‘নিঝুম স্থাপত্য আজ মিলনের প্রতিবাদী মুখ’, তারপর দুঃসহ যানজট ঠেলে আসাদ গেট অতিক্রম করতে করতে শোনা যায় শামসুর রাহমানের দৃপ্ত উচ্চারণ ‘আসাদের শার্ট আজ আমাদের প্রাণের পতাকা।’

শামসুর রাহমান এভাবে তাঁর সত্তার ছায়া বিস্তার করতে থাকেন এই স্মৃতির শহরজুড়ে।

শুভ জন্মদিন কবি, আপনাকে।

পিয়াস মজিদ : কবি ও প্রাবন্ধিক