Thank you for trying Sticky AMP!!

করোনাকালে পাশে যখন 'ভার্চ্যুয়াল প্রতিবেশী'

বৃহত্তর খিলগাঁওবাসীর এক সদস্য মপটি কেনার জন্য সাহায্য চেয়ে পোস্ট দেন। ছবি: বৃহত্তর খিলগাঁওবাসীর সৌজন্যে

‘দু–এক দিনের মধ্যে হোলসেলে যাবেন, এমন কেউ কি এই দুধটা কিনে এনে সাহায্য করতে পারবেন। উপকৃত হব।’ দুধের টিনের ছবি দিয়ে ১৪ এপ্রিল বিসিসি–বসুন্ধরা কমিউনিটি ক্লাবে এমন একটি সাহায্য চেয়ে পোস্ট দিয়েছিলেন ফারহানা লাকি। তাঁর বাসা ঢাকার বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায়। এলাকাবাসী হিসেবে তিনি ওই গ্রুপটিতে সম্প্রতি যোগ দিয়েছে।

করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে এলাকাটি লকডাউন হওয়ায় তিনি বাসা থেকে বের হতে পারছিলেন না। দোকানপাট বন্ধ। হোলসেল বলে যেটি তিনি উল্লেখ করেছেন, সেটি যমুনা ফিউচার পার্কের বেজমেন্টে স্থাপিত বড় আকারের একটি সুপার শপ ‘হোলসেল ক্লাব লিমিটেড’। সেখানে বিদেশি ব্র্যান্ডের দুধের টিনটি পাওয়া যায় জানলেও সুপারশপটি খোলা কি না বা খোলা থাকলেও বুঝতে পারছিলেন না লকডাউনের মধ্যে কীভাবে সেটি নিয়ে আসবেন।

পোস্ট দেওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যে আবদুল্লাহ তাহসিন নামের একজন সেখানে কমেন্ট করে জানান তিনি সাহায্য করতে পারবেন। ওয়াদিয়াহ হোসেইন নামের আরেকজন জানান, হোলসেল হোম ডেলিভারি দিচ্ছে। আদনান ইয়াজদি নামের আরেকজন হোম ডেলিভারির পুরো প্রক্রিয়া ও ফোন নম্বর দিয়ে দেন।

ফারহানা লাকি প্রথম আলোকে জানান, পোস্ট দেওয়ার পরপরই কয়েকজন সাড়া দেন। তিনি অর্ডার দিয়ে বিকেলের মধ্যেই দুধের টিন পেয়ে যান।

বৃহত্তর খিলগাঁওবাসী নামের এলাকাভিত্তিক আরেকটি গ্রুপে একটি মপের ছবিসহ সাকিব আনজুম নামের একজন পোস্ট দিয়ে সাহায্য চান। ২০ এপ্রিলের পোস্টে তিনি লেখেন, ‘এই দুর্যোগ মুহূর্তে ওয়ালটনের এই মপটির (ঘর মোছার জন্য ব্যবহৃত) সন্ধান কেউ দিতে পারলে উপকৃত হব এবং কৃতজ্ঞ থাকব।’ তিনিও সাহায্য পেয়েছিলেন বলে জানা গেছে।

এলাকার বাসিন্দাদের মধ্যে এমন অনলাইনভিত্তিক কমিউনিটি ক্লাবগুলো জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। সদস্যদের মধ্যে স্থানীয় তথ্য তাৎক্ষণিকভাবে পাওয়ার বড় একটি মাধ্যম হয়ে উঠেছে কমিউনিটি ক্লাবগুলো। তৈরি হয়েছে ‘ভার্চ্যুয়াল প্রতিবেশী'। গৃহকর্মী, ড্রাইভার, নিরাপত্তাকর্মী বা আশপাশের দোকানে বিক্রয়কর্মী নিয়োগের মতো কাজের ব্যবস্থাও হচ্ছে এই ‘ভার্চ্যুয়াল প্রতিবেশী'দের বিভিন্ন পোস্টের মাধ্যমে। কেউ সন্তানের জন্য টিউটর চাইছেন। বা কোনো টিউটর শিক্ষার্থী খুঁজছেন বলে জানাচ্ছেন। কেউ নির্দিষ্ট পণ্য কোথায় পাওয়া যাবে জানতে চাইছেন। এভাবে এক সদস্য অন্যজনের প্রয়োজন মেটাচ্ছেন। গ্রুপের অ্যাডমিনরা জানান, করোনাভাইরাসের এই সময়ে গ্রুপগুলোয় সদস্যদের অংশগ্রহণ অনেক বেড়ে গেছে। লকডাউনের কারণে অনেকে ঘর থেকে বের হতে না পেরে তথ্যের জন্য নির্ভর করছেন গ্রুপগুলোর ওপর। কোনো কোনো গ্রুপ গঠনই হয়েছে এই পরিস্থিতিকে কেন্দ্র করে। তাঁরা অনলাইনে একত্র হয়ে এলাকাভিত্তিক সামাজিক কাজেও জড়িয়ে পড়ছেন।

এমন একটি এলাকাভিত্তিক গ্রুপ বিডব্লিউসিসি–বসুন্ধরা ওমেন্স কমিউনিটি ক্লাব ২০১৮ সালের ৩ মার্চ গঠন করা হয়। এটার সদস্যসংখ্যা সাড়ে চার হাজার। একই বছরের ৭ ডিসেম্বর বিসিসি বসুন্ধরা কমিউনিটি ক্লাব গঠন করা হয়। এটার সদস্যসংখ্যা পাঁচ হাজার ৩৬১ জন। এপ্রিলের শুরুতে ছিল ৩ হাজার ৫০০।

গ্রুপের অ্যাডমিন তোহফাতুল জান্নাত প্রথম আলোকে বলেন, মূলত এলাকার নারীদের মধ্যে তথ্য আদান–প্রদান ও সহযোগিতার জন্য শুধু নারী বাসিন্দাদের জন্য একটি গ্রুপ খোলেন তিনি। এই গ্রুপটির সদস্যদের মধ্যে যাঁরা ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা ছিলেন, তাঁরা বছরে মেলাসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে একত্র হতে থাকেন। গ্রুপটটির কার্যকারিতা আরও ব্যাপক পরিসরে করার লক্ষ্যে নারী ও পুরুষ সদস্যদের যৌথ একটি গ্রুপ খোলা হয়। দুটি গ্রুপকে একটি পেজের মাধ্যমেও যুক্ত করা হয়।

তিনি বলেন, করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে গ্রুপের সদস্যসংখ্যা আগের চেয়ে অনেক বেড়ে গেছে। গত ২০ দিনে সদস্যসংখ্যা প্রায় দুই হাজার বেড়েছে। লকডাউন সময়ে পোস্টের সংখ্যা ও কমেন্ট বেড়ে সদস্যদের মধ্যে অংশগ্রহণও বেড়েছে। এলাকার কোন ব্লকে কোভিড–১৯ আক্রান্ত রোগী রয়েছে, এলাকার কোন ব্লক শুরুতে লকডাউন হয়েছে এসবের প্রকৃত তথ্য শেয়ার হয়েছে গ্রুপে।

তোহফাতুল জান্নাত আরও জানান, দৈনন্দিন প্রয়োজন ছাড়াও এলাকার একটি নারী নির্যাতনের ভিডিও গ্রুপে শেয়ার হয়ে ওই নারী উপকৃত হয়েছিলেন, সহানুভূতি পেয়েছিলেন। ওই ভিডিওটি ১০ লাখের বেশি রিচ হয়েছিল।

রাজনীন ইসলাম, মো. আরিফুল্লাহ খান, এম কে জিৎ সহ বিসিসি–বসুন্ধরা কমিউনিটি ক্লাবের কয়েকজন সদস্য জানান, স্থানীয় তথ্য চাওয়ার ও পাওয়ার ভালো একটি প্ল্যাটফর্ম এটি। সহজে বসুন্ধরার আশপাশের কোথায় কোন জিনিস পাওয়া যেতে পারে, তা অন্য সদস্যদের কাছ থেকে সহজে জানা যায়। কিছু তথ্য জেনে পরিস্থিতি বুঝে সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়। এ ছাড়া গ্রুপের মাধ্যমে এলাকার বড় একটি অংশের সঙ্গে যোগাযোগ তৈরি হচ্ছে। বন্ধুত্বও হচ্ছে।

বৃহত্তর খিলগাঁওবাসী গ্রুপের অ্যাডমিন মো. মশিউর রহমান প্রথম আলোকে জানান, লকডাউনের কারণে সাকিব আনজুম নামের ওই পোস্টদাতা সদস্যের বাসায় এখন গৃহের কাজের সহকারীকে ছুটি দিয়েছেন। ঘরের মেঝে নিজেদেরই মুছতে হয় বলে মপ কিনতে চেয়ে পোস্ট দিয়েছিলেন। পোস্টটি দেখে একজন ব্যবসায়ী জানান, তাঁর দোকানে মপটি আছে। ওই ব্যবসায়ী নির্দিষ্ট সময় উল্লেখ করে জানান, তিনি দোকান খুলে মপটি বের করে রাখবেন। পোস্টদাতা যেন ওই সময়টায় এসে নিয়ে যান।

বৃহত্তর খিলগাঁওবাসীর এক সদস্য মপটি কেনার জন্য সাহায্য চেয়ে পোস্ট দেন। ছবি: বৃহত্তর খিলগাঁওবাসীর সৌজন্যে

মশিউর রহমান জানান, বেশ অনেক দিন থেকেই এলাকাবাসীদের পক্ষ থেকে এমন একটি অনলাইনভিত্তিক গ্রুপ করার আলোচনা হচ্ছিল। তবে করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে গ্রুপটি দ্রুত গঠনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। ২ এপ্রিল তিনি গ্রুপটি খোলেন। বর্তমান পরিস্থিতির কারণে গ্রুপটির সদস্যরা বিভিন্ন সামাজিক কার্যক্রম শুরু করেছেন। তিনি জানান, খিলগাঁও কুমিল্লা হোটেলের পেছনের বস্তিতে চার শ পরিবারের মধ্যে ত্রাণ দেওয়া হয়েছে। এতে গ্রুপের ৫০ জন সদস্য অর্থ দিয়েছেন। ২০০ খাবারের প্যাকেট বিতরণ করা হয়েছে। ১২টি ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জাম (পিপিই) পিপলস হাসপাতালে দান করা হয়েছে। এ ছাড়া জাগরণী ক্রিকেট একাডেমিতে স্থাপিত অস্থায়ী মেডিকেল ক্যাম্পের মাধ্যমে এলাকাবাসীকে চিকিৎসা–সংক্রান্ত ফ্রি পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। এই স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রমে রয়েছেন চারজন চিকিৎসক ও কয়েকজন স্বাস্থ্যকর্মী। নিবন্ধনের মাধ্যমে রোগীদের জন্য এমন সেবা তাঁরা প্রতি সপ্তাহে দেওয়ার পরিকল্পনা করেছেন। এ ছাড়া এলাকার একজন ব্যবসায়ী নির্ধারিত মূল্যে জরুরি অ্যাম্বুলেন্স সেবা দিতে রাজি হয়েছেন।

বৃহত্তর খিলগাঁওবাসী গ্রুপের সদস্য চিকিৎসক মুজাহিদুল হক মেডিকেল ক্যাম্পটি পরিচালনা করছেন। আট মাস আগে তিনি লন্ডন থেকে দেশে ফেরেন। আবার চলে যাওয়ার প্রস্ততি নিচ্ছেন। তবে এর ফাঁকেই বর্তমান পরিস্থিতিতে ফ্রি চিকিৎসা পরার্মশ সেবায় যোগ দিয়েছেন।

প্রথম আলোকে মুজাহিদুল হক বলেন, করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে ঢাকাজুড়ে তাঁদের একটি টিম স্বেচ্ছাসেবকের কাজ করছেন। তিন দিন আগে বৃহত্তর খিলগাঁওবাসী চিকিৎসাসেবা কার্যক্রমে যোগ দিয়েছেন।তিনি বলেন, ডায়াবেটিস, হৃদ্‌রোগ, কিডনিসহ কিছু অসুস্থতা রয়েছে, যেগুলোতে নিয়মিত বিরতিতে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হয়। এখন অনেক রোগীরা বাসা থেকে বের হতে পারছেন। তাঁরা নিয়মিত যেসব চিকিৎসকের কাছে যান, তাঁদের অনেকেই প্রাইভেট প্র্যাকটিস করছেন না, সেসব রোগী খুব বিপাকে পড়েছেন। তিন দিন আগে এমন ১৮ জন রোগীকে ক্যাম্পে ফ্রি পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। তিনি জানান, তাঁর ফোন নম্বরটি হটলাইন নম্বর হিসেবে রাখা হয়েছে। রোগীদের বলা হয়েছে তাঁরা ফোনে বা অনলাইনেও তাঁর কাছ থেকে পরামর্শ নিতে পারবেন।

সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, দুর্যোগকালীন অনলাইনভিত্তিক কমিউনিটি ক্লাবগুলোর মাধ্যমে মানুষের দোরগোড়ায় সেবা পৌঁছানো সম্ভব। একটি পোস্টেই একজন পেতে পারেন এই সেবা।