Thank you for trying Sticky AMP!!

করোনায় নেত্রকোনায় গ্রামের হালচিত্র

ভোররাতে মোরগের ডাকে ঘুম ভাঙে। মুয়াজ্জিনের আজানের সুর স্পষ্ট ভেসে আসে কানে। পাখিদের কিচিরমিচির শব্দে চারপাশ মুখরিত থাকে। গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে রাতের আকাশে সুন্দর চাঁদ দেখা যায়। উঠোনভর্তি জ্যোৎস্না থাকে। ঝোপঝাড়ে জোনাক পোকাদের আনাগোনা দেখা যায়। নিস্তব্ধ পরিবেশে ঝিঁঝি পোকাদের ডাকের আওয়াজ শোনা যায়। সকালে বাড়ির সামনের রাস্তায় দাঁড়ালে দেখা যায় কৃষক নিজের উৎপাদিত শাকসবজি নিয়ে বাজারে যাচ্ছেন। কেউ বাজার করে নিয়ে আসছেন। এমন পরিবেশে থেকে আপনি যে এক অসুস্থ পৃথিবীতে আছেন, সেটা ভুলেই যাবেন। কিন্তু এমন না যে ভয় এখানে আসেনি। সবাই জানে শহরে, বাইরের পৃথিবীতে কিছু একটা ঘটছে। করোনা নামের মহামারি গ্রাস করে বেড়াচ্ছে।

গ্রামের মানুষজনের অনেকেই বিষয়টাকে নিছক মজা হিসেবে দেখছেন। করোনা নিয়ে মজা করছেন, হাসি-তামাশা করছেন। অনেকেই আবার আল্লাহর ওপর ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিন্তে চলাফেরা করছেন। বেশির ভাগ মানুষের ধারণা, এখানে এই রোগ আসতে পারবে না। এলেও তাঁদের কিছু হবে না। কিংবা হলে দেখা যাবে ভাগ্যে থাকলে বাঁচবেন, না হয় মরবেন। মনে হচ্ছে নিছক ছেলেখেলার একটা জিনিস এটা তাঁদের কাছে। যেটা মূলত চিন্তার বিষয়।

শহর থেকে ট্রাকভর্তি, লঞ্চভর্তি মানুষ আসছে গ্রামে। তারপর আবার মিশছে সবার সঙ্গে। বেড়াতে যাচ্ছে। চায়ের দোকানগুলো জমজমাট। দোকানের ঝাঁপ লাগিয়ে দিব্যি একসঙ্গে গাদাগাদি করে বসে মানুষ চা খাচ্ছে। দল বেঁধে বাজারে যাচ্ছে, আড্ডা দিচ্ছে। বেশির ভাগ মানুষ মুখে দরজির দোকানে বানানো কাপড়ের মাস্ক পরছে। আবার মাস্ক খুলে রাস্তায় থুতু ফেলছে অবাধে। একেক সময় একেক ধরনের গুজব রটছে। গ্রামের সাধারণ মানুষ সেগুলো বিশ্বাসও করছে। এমন একটা ঘটনা বলি, খালার বাড়ির পাশের ঘরের এক নারীর জ্বর। ওনার স্বামী চিকিৎসকের কাছ থেকে জ্বরের ওষুধ আনতে যাবেন। কিন্তু তাঁকে ওষুধ আনতে আটকে দিয়ে ওই নারী বললেন, ‘ওষুধ আনতে চিকিৎসকের কাছে যাবে না, গেলে তোমাকে পুলিশে খবর দিয়ে ধরিয়ে দেবে আর আমাকে নিয়ে গিয়ে ইনজেকশন দিয়ে মেরে ফেলবে।’ মানে গুজব রটেছে, সর্দি-জ্বর হলে ইনজেকশন দিয়ে মেরে ফেলা হচ্ছে। শুধু ওই গ্রাম না, আশপাশের অনেক গ্রামে এমন কথা ছড়িয়েছে। তারপর আবার এক আত্মীয় ফোন করে খবর জানালেন, আদা, লং, দারুচিনি একসঙ্গে খেলে নাকি করোনা ধরবে না। পরিবারের সবাইকে খাওয়াতে বলছে। কেউ কেউ আবার স্বপ্নে নতুন নতুন ফর্মুলা পেয়ে যান। ‘লালসালু’ গল্পের চরিত্রগুলো যেন এখানে এখনো জীবন্ত। গণমাধ্যমের খবর পৌঁছাচ্ছে না। খবরের কাগজ প্রকাশ হচ্ছে, কিন্তু এখানে নেই। কেউ কেউ ফেসবুকের গুজবে কান দিচ্ছেন। সত্য-মিথ্যা যাচাই করার উপায় নেই।

সবচেয়ে বড় ভয় মুরব্বিদের নিয়ে। তাঁরা আল্লাহর গজব বলে কোনো কথাই কানে তুলছেন না। একটা ধর্মীয় গোঁড়ামি নিয়ে যেভাবে চলতেন, সেভাবেই চলছেন, কোনো নিয়মনীতি তোয়াক্কা করছেন না। দরিদ্ররা আবার বলছেন, ‘খাবারের টাকা নাই, হাত ধোয়ার জন্য সাবানের টাকা কই পাব। এসব আমাদের জন্য না। বড়লোকদের অসুখ। শহুরে অসুখ...।’

জীবিকার জন্য রীতিমতো করতে হচ্ছে যুদ্ধ। কাজ নেই কোথাও। ঘরের হাঁড়িতে আগুন না জ্বলার মতো অবস্থা। কেউ কেউ অভুক্ত থাকছে। বলার মতো কেউ নেই। কে শুনবে তাদের কথা। সরকারি ত্রাণের কিছু তাদের দুয়ারে পৌঁছাবে কি না, তা-ও সন্দেহ। উত্তরণের উপায় কী, তা-ও জানা নেই তাদের। সংকটের সময়টাতে চোখে সরষে ফুল দেখার মতো অবস্থা। এখানে কোনো স্বেচ্ছাসেবী আসে না। সাবান, স্যানিটাইজার মাস্ক নিয়ে কেউ আসে না। আসে না কেউ খাবার নিয়ে...।

গ্রামে এখন সচেতন মানুষ নেই, এটা বললে ভুল হবে। অনেকেই নিয়মনীতি মেনে চলছেন। তবে সিংহভাগ আছেন নিজেদের মতো করে। বাড়তি কোনো সচেতনতা নেই। অনেকেই জ্বর-সর্দি হলে সেটা নিয়ে চুপচাপ ঘরে বসে আছেন। নিচ্ছেন সাধারণ চিকিৎসা।

ভয় হয় এই নিরীহ, সরল মানুষগুলোকে নিয়ে। করোনার প্রভাব যদি গ্রামগুলোতে এসে হানা দেয়, তাহলে কী ঘটবে। আক্রান্ত মানুষের আহাজারিতে ভারী হয়ে উঠবে ধুলামুক্ত বিশুদ্ধ বাতাস। এদের কী হবে?

লেখক: নিশ্চিন্তপুর, বারহাট্টা, নেত্রকোনা। শিক্ষার্থী, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি।