Thank you for trying Sticky AMP!!

করোনা তাঁদের বাবা কেড়ে নিয়েছে

যুক্তরাষ্ট্রে সেমিনারে যোগ দিতে গিয়েছিলেন ডা. রাফায়েল মুরসালীন (বাঁয়ে)। বাবা অধ্যাপক আবুল মোকারিমও ছিলেন সঙ্গে। ছবি: সংগৃহীত, গত বছর নারায়ণগঞ্জের একটি কমিউনিটি সেন্টারে পারিবারিক অনুষ্ঠানে বাবা বিকাশ সাহার সঙ্গে (ডানে) হাসিমুখে অনির্বাণ সাহা। ছবি: সংগৃহীত, মজিবুর রহমান, এএসআই আবদুল খালেক, সফিউদ্দিন আহমেদ

সালমান ফারসি এবার ছয় বছরে পড়েছে। তার মন খুব খারাপ। বারবার কান্নাকাটি করছে, আর মাকে জিজ্ঞেস করছে, ‘আমার আব্বা বুড়া অয় নাই, তো মারা গ্যালো ক্যান? তোমার অব্বা বুড়ো অইয়াও তো বাঁইচ্যা আছে?’ মা ফাতেমা বেগম কী করে ছেলেকে বোঝাবেন জীবন-মৃত্যুর রহস্য! মেয়ে দুটো একটু বড়। ওরা প্রশ্ন করে না, শুধু কাঁদে। ওদের বাবা আবদুল খালেক পুলিশের এএসআই। দায়িত্ব পালন করছিলেন ঢাকার মিরপুরে। করোনায় আক্রান্ত হয়ে গত ৩০ এপ্রিল তিনি মারা যান। রেখে যান ১৩ বছরের খাদিজা আক্তার, ১১ বছরের সামিয়া আক্তার ও সালমান ফারসিকে।

আজ ২১ জুন, বাবা দিবস। প্রতিবছর জুনের তৃতীয় রোববার বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দিবসটি পালন করা হয়। অনেক প্রচলিত কথা—বাবা বটবৃক্ষের মতো। তিনি আশ্রয়, ছায়া, অভয়। পরিবারের কান্ডারি। সন্তানদের আদর্শ। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া সব সন্তানের কাছে তার বাবাই শ্রেষ্ঠ বাবা। শ্রদ্ধা, ভয়, গোপন অভিমান আর ভালোবাসায় মিশে থাকা বাবার সঙ্গে সন্তানদের সম্পর্কের যে রসায়ন সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বয়ে চলে নদীর বাঁকের মতো, তার তুলনা হয় না।

এবার সেই বাবা দিবস এল এক ভিন্ন পরিপ্রেক্ষিতে। বিশ্বজোড়া প্রাণঘাতী করোনার সংক্রমণে অনেকে বাবা হারিয়েছেন। কারও বাবা লোকান্তরে গেছেন পরিণত বয়সে, আবার কেউ অকালে পিতৃহীন হয়েছে সালমান ফারসিদের মতো। তবে যিনি যে বয়সেই বাবাকে হারিয়ে থাকুন না কেন, এই বিয়োগব্যথা সবারই সমান। এই শোক সান্ত্বনাহীন।

বাবা দিবসকে কেন্দ্র করে কথা হলো সম্প্রতি করোনায় বাবাকে হারানো সন্তানদের সঙ্গে। তাঁরা পিতৃবিয়োগের বেদনার সঙ্গে বলেছেন বাবার আদর, অনুপ্রেরণা, আদর্শ, মধুর স্মৃতি আর আক্ষেপের কথা।

নতুন জামা নিয়ে আসতেন বাবা

>

 বাবা দিবস আজ। এবার দিবসটি এল ভিন্ন পরিপ্রেক্ষিতে। করোনার সংক্রমণে অনেকেই বাবা হারিয়েছেন। এই শোক সান্ত্বনাহীন।

এএসআই আবদুল খালেকের বড় মেয়ে খাদিজা আক্তার অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে। তারা বরিশাল শহরে ভাড়া বাড়িতে থাকত। বাবা বরিশাল পুলিশ লাইনসেই ছিলেন। দুই বছর হলো ঢাকায় বদলি হয়েছেন। ওদের জন্য নতুন জামা, মিষ্টি, ফল হাতে করে বাড়িতে আসতেন এক-দেড় মাস পরপর। শেষবার এসেছিলেন ৫ ফেব্রুয়ারি। তখন সবার জন্য নতুন জামা এনেছিলেন। ছোট মেয়ে সামিয়ার জামাটি মাপে একটু ছোট হয়েছিল। বাবা বলেছিলেন, পরেরবার আসার সময় ওর জন্য আরেকটি জামা আনবেন। মাপও নিয়েছিলেন। কিন্তু মার্চ মাস থেকে ঢাকায় লকডাউন শুরু হয়। তারপর আসতে পারেননি। ফোনে এসব বলতে বলতে কান্নায় কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে যায় সামিয়ার। ওর মা ফাতেমা বেগম জানান, তাঁর শ্বশুর-শাশুড়ি নেই। স্বামীর মৃত্যুর পর তিন শিশুসন্তান নিয়ে বরগুনায় তাঁর বাবার বাড়িতে উঠেছেন।

বাবার আদর্শ অনুসরণ করব

করোনাকালে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পালন করছেন প্রথম সারির সৈনিকের ভূমিকা। অধ্যাপক আবুল মোকারিম কাজ করছিলেন ধানমন্ডির ইবনে সিনা হাসপাতালের জ্যেষ্ঠ কনসালট্যান্ট হিসেবে। তাঁর বড় ছেলে সহকারী অধ্যাপক রাফায়েল মুরসালীন ও পুত্রবধূও এখানে কর্মরত। তিনি বলছিলেন, ‘আমরা তিনজন একই হাসপাতালে চিকিৎসকের দায়িত্ব পালন করছিলাম। করোনা সংক্রমণের পর থেকে সপ্তাহে সাত দিন কাজ করি। আব্বাকে বলেছিলাম, আপনার বয়স হয়েছে, তা ছাড়া কিছু শারীরিক সমস্যাও আছে। বাড়িতেই থাকুন। তিনি রাজি হলেন না। বললেন, “এই দুঃসময়েই যদি মানুষের পাশে না থাকি, তবে চিকিৎসক হলাম কেন? আর তোমরা ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতে যাবে, আমি বাড়িতে বসে থাকব, তা হবে না।” বাবা আক্রান্ত হয়েছিলেন ৩ মে। আগের দিন পর্যন্ত টানা কাজ করেছেন। ১২ মে তিনি ইন্তেকাল করেন।’

রাফায়েল বলেন, বাবার ইচ্ছাতেই তাঁর চিকিৎসক হওয়া। ধানমন্ডিতেই তাঁদের বাড়ি। বলছিলেন, ‘আমাদের গ্রামের বাড়ি কিশোরগঞ্জে। গ্রামের লোকজন অসুস্থ হলে সোজা আমাদের বাড়িতে চলে আসত। বাবা তাদের চিকিৎসা করতেন। দরকার হলে হাসপাতালে পাঠাতেন। ফলে প্রায়ই আমাদের বাড়িতে বিভিন্ন ধরনের রোগী থাকত। মনে হতো বাড়িটাই যেন হাসপাতাল। মানুষকে সেবা করার বাবার এই আদর্শ অনুসরণ করার চেষ্টা করে যাব।’

বাবা ছিলেন বন্ধুর মতো

নারায়ণগঞ্জ শহরের দেওভোগ মহল্লার বিকাশ সাহা রাজধানীর কুর্মিটোলা হাসপাতালে মারা যান গত ১৯ এপ্রিল। তাঁর বড় দুই মেয়ে পাপড়ি সাহা ও তৃষা সাহার বিয়ে হয়ে গেছে। ছেলে অনির্বাণ সাহা তোলারাম কলেজে স্নাতক শ্রেণির শিক্ষার্থী। তিনি বলছিলেন, বাবার মৃত্যুর শোক তো আছেই, আচমকা পরিবারের দায়িত্বও তাঁর কাঁধে এসে পড়েছে। বাজারে বাবার একটি লুঙ্গির দোকান আছে। সেটিই পরিবারের আয়ের উৎস। তিনিই এখন দোকানে বসছেন। খুব বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল বাবার সঙ্গে। সিপিবির রাজনীতি করতেন। সারা দিন কী করেছেন, বাড়ি ফিরে অনেক রাত অবধি সেসব নিয়ে গল্প করতেন। রাতে বাবার সঙ্গে এই গল্প করার সময়টিই খুব মিস করছেন অনির্বাণ। বাড়িতে এলেই বাবার নানা স্মৃতি মনে পড়ে যাচ্ছে।

বাবা ছিলেন খুব গোছানো

গাজীপুরের স্কুলশিক্ষক সফিউদ্দিন আহমেদ ছিলেন খুব গোছানো স্বভাবের মানুষ। তাঁর তিন ছেলেমেয়ের মধ্যে বড় রায়হান আহমেদ শিক্ষা অধিদপ্তরের চাকুরে। তিনি বাবার গুণের কথা উল্লেখ করে বলছিলেন, ‘জমিজমা ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় সব কাগজপত্র, হিসাব আব্বা সুন্দর করে গুছিয়ে রেখে গেছেন, বৈষয়িক বিষয়াদি নিয়ে আমাদের আত্মীয়স্বজন বা কারও সঙ্গে যাতে কোনো সমস্যা না হয়।’ ৫ জুন তিনি ইন্তেকাল করেছেন ঢাকার সিএমএইচে। সব সময় তিনি সবার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করেছেন, নির্ঝঞ্ঝাট থাকতেন। এই শিক্ষা দিয়ে গেছেন সন্তানদের।

ছেলের কৃতিত্ব জানতে পারেননি বাবা

ইমরান হোসাইনের এলএলবি পরীক্ষার ফল প্রকাশ হয়েছে কয়েক দিন আগে। পাস করেছেন। তাঁর সারা জীবনের আক্ষেপ থাকবে বাবা মুজিবুর রহমান খবরটি জেনে যেতে পারলেন না। অথচ বাবার আগ্রহেই তিনি আইন পড়া শুরু করেছিলেন। ইমরান জানান, গত ৭ এপ্রিল কুর্মিটোলা হাসপাতালে তাঁর সামনেই বাবা শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন। ইমরান নিজেও করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন। এখন সুস্থ। তিনি বলছিলেন, আনুষ্ঠানিকভাবে বাবা দিবস পালন করা হয়নি, বরং বাবাই তাঁর সব জন্মদিনে কিছু না কিছু উপহার দিয়েছেন। কখনো দিনটি ভোলেননি। এখন থেকে জন্মদিনে বাবা না থাকার কথাই মনে পড়বে বড় বেদনার স্মৃতি হয়ে।