Thank you for trying Sticky AMP!!

করোনা পরীক্ষা নিয়ে জটিলতা

প্রতীকী ছবি: ছবি: রয়টার্স

অনেকে চেষ্টা করেও করোনা শনাক্তকরণ পরীক্ষা করাতে পারছেন না। যাঁরা পরীক্ষা করিয়েছেন, তাঁদের কেউ কেউ ফলাফল জানতে পারছেন না। কয়েকটি ল্যাবরেটরিতে সংগ্রহ করা নমুনার স্তূপ বড় হচ্ছে। সরকারি কর্মকর্তা, ভুক্তভোগী মানুষ এবং ল্যাবরেটরি–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে করোনা পরীক্ষা নিয়ে এমন জটিলতার চিত্র পাওয়া গেছে।

অভিযোগ উঠেছে, সঠিক পরিকল্পনা না থাকায় করোনার পরীক্ষা নিয়ে এমন পরিস্থিতি হয়েছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সমস্যার বিশালতা অনুধাবন করতে পারেনি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর কিছুটা দেরিতে পরীক্ষা সম্প্রসারণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তারা নমুনা সংগ্রহের পদ্ধতি এবং নমুনার মানের ব্যাপারে তেমন গুরুত্ব দেয়নি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিষয়গুলো দ্রুত পর্যালোচনা করতে হবে এবং সেই অনুযায়ী পদক্ষেপ নিতে হবে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা করোনা পরিস্থিতিকে বৈশ্বিক মহামারি হিসেবে ঘোষণার আগে থেকেই রোগ শনাক্তকরণ পরীক্ষার ব্যাপারে জোর দিয়ে আসছে। সংস্থাটি বলছে, চিকিৎসা ও সংক্রমণ প্রতিরোধে রোগ শনাক্ত হওয়া দরকার।

পরীক্ষা নিয়ে জটিলতা

রাজধানীর মোমিনবাগের একটি পরিবারের তিন সদস্যের কয়েক দিন ধরে জ্বর, গলাব্যথা। পরিবারের সদস্যরা একাধিকবার সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) দেওয়া ফোনে যোগাযোগ করেছেন। নমুনা সংগ্রহের জন্য যাওয়ার কথা বললেও আইইডিসিআরের পক্ষে কেউ গতকাল সোমবার পর্যন্ত যাননি।

গত সপ্তাহে মিরপুর ১১–এর একটি পরিবারের একজন নারী সদস্য করোনার উপসর্গ নিয়ে মারা যান। ওই পরিবারের একাধিক সদস্য এখনো জ্বরে ভুগছেন। আইইডিসিআরের সঙ্গে তাঁরা যোগাযোগ করেও কোনো পরীক্ষা করাতে পারেননি।

পরীক্ষার জন্য নমুনা দিতে না পারার এ রকম উদাহরণ আরও আছে। অন্যদিকে নমুনা দিয়েছেন, কিন্তু ফলাফল জানতে পারছেন না, এমন উদাহরণ আছে অনেক।

রাজধানীর হাতিরপুল ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের একটি বাসা থেকে ১৪ এপ্রিল এক ব্যক্তির নমুনা সংগ্রহ করেন আইইডিসিআরের টেকনোলজিস্টরা। নমুনা সংগ্রহের পর তাঁকে একটি পরিচিতি নম্বর (আইডি–৬০৯৯) দেওয়া হয় এবং বলা হয়, দু–এক দিনের মধ্যে ফলাফল জানানো হবে। গতকাল ২৭ এপ্রিল পর্যন্ত তাঁকে ফলাফল জানায়নি আইইডিসিআর।

>বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নমুনা সংগ্রহ, পরীক্ষা পরিচালনা, ফল জানানো এবং শনাক্ত ব্যক্তিকে দ্রুত চিকিৎসার আওতায় আনার বিষয়গুলো পর্যালোচনা করতে হবে।

এই দুই ধরনের অভিযোগ অনেক মানুষের কাছ থেকে পাওয়া যাচ্ছে। এ ব্যাপারে আইইডিসিআরের পরিচালক অধ্যাপক মীরজাদী সেব্রিনা প্রথম আলোকে বলেন, কাজের চাপের কারণে কিছু সমস্যা হচ্ছে। কিছু ক্ষেত্রে নমুনা সংগ্রহের বা সনদ তৈরির সময় ব্যক্তির তথ্যে ভুল হয়ে যায় (যেমন নামের অক্ষরে বা টেলিফোন নম্বরে)। তখন যোগাযোগে সমস্যা হয়।

এ ব্যাপারে জনস্বাস্থ্যবিদ মুশতাক হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, কোভিড–১৯ রোগী নন এমন ব্যক্তির জন্য পরীক্ষা ও পরীক্ষার ফলাফল জরুরি হয়ে পড়েছে। কারণ, এ বিষয়ে সনদ না থাকলে তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করা হচ্ছে না। অন্যদিকে দ্রুত পরীক্ষার ফল জানা গেলে সংক্রমণ প্রতিরোধের কাজ এগিয়ে যায়।

 পরীক্ষার ফল নিয়ে সন্দেহ

রাজধানীর উত্তরায় নিজের মাকে হাসপাতালে ভর্তি করাতে পারছিলেন না চিকিৎসক ছেলে। হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলো কোভিড–১৯ শনাক্তকরণ পরীক্ষার ফল দেখতে চেয়েছিল। রাজধানীর একটি ছোট ক্লিনিকে রেখে তাঁর মায়ের নমুনা পরীক্ষা হয়। ১২ এপ্রিল আইইডিসিআরে দেওয়া সনদে দেখা যায়, মা করোনায় আক্রান্ত নন।

চিকিৎসক ছেলে প্রথম আলোকে বলেন, ‘সনদ পাওয়ার পরপরই মাকে আমরা রাজধানীর একটি বড় হাসপাতালে ভর্তি করাই। মাকে তারা লাইফ সাপোর্টে নিয়ে যায়।’ কিন্তু হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ দ্রুত আইইডিসিআরকে দিয়ে পরীক্ষা করায়, যা পরিবারের সদস্যরা জানতেন না। ১৩ এপ্রিল আইইডিসিআরের দেওয়া সনদে দেখা যায়, তিনি করোনায় আক্রান্ত। ওই চিকিৎসক প্রশ্ন করেছেন, ‘এক দিনের ব্যবধানে কি এটা সম্ভব?’

ওই হাসপাতাল চিকিৎসকের মাকে আর রাখেনি। বাধ্য হয়ে তাঁকে উত্তরার কুয়েত বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতালে স্থানান্তর করেন ছেলেরা। তিনি ভালো হয়ে উঠছিলেন। সরকারি ওই হাসপাতাল নমুনা পরীক্ষা করায়। ২২ এপ্রিল আইইডিসিআরের সনদ বলছে, তাঁর শরীরে করোনা ছিল না। ১০ দিনের ব্যবধানে এটা কি হওয়া সম্ভব?

এ ব্যাপারে আইইডিসিআরের পরিচালক বলেছেন, রোগতাত্ত্বিক বিবেচনায় এটা হওয়া সম্ভব। এটা নির্ভর করে ‘ভাইরাল লোডের’ ওপর।

 নমুনার স্তূপ

গতকালের নিয়মিত সংবাদ বুলেটিনে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক নাসিমা সুলতানা বলেন, সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছিল ৪ হাজার ১৯২টি। আর ওই সময় নমুনা পরীক্ষা হয়েছিল ৩ হাজার ৮১২টি। অর্থাৎ পরীক্ষার জন্য বিভিন্ন ল্যাবরেটরিতে ৩৮০টি নমুনা জমা ছিল। এর আগের দিন জমা হয়েছিল ২০৪টি।

এই জমে থাকা নমুনা জনমনে বিরূপ প্রভাব ফেলছে। নারায়ণগঞ্জের সিভিল সার্জন কার্যালয় জানিয়েছে, তাদের প্রায় ৩০০ নমুনার ফলাফল গতকাল পর্যন্ত তারা জানতে পারেনি।

চট্টগ্রামের ইনস্টিটিউট অব ট্রপিক্যাল অ্যান্ড ইনফেকসাস ডিজিজ (বিআইটিআইডি) হাসপাতালের ল্যাবরেটরিতেও নমুনার স্তূপ বড় হচ্ছে। চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, ফেনী, লক্ষ্মীপুর, রাঙামাটি ও খাগড়াছড়ি জেলার নমুনা এই ল্যাবে পরীক্ষা করা হয়। কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, এই ল্যাবে ২৪ ঘণ্টায় গড়ে ১৯০টি নমুনা পরীক্ষা করা হচ্ছে। কিন্তু সংশ্লিষ্ট জেলাগুলো থেকে দৈনিক নমুনা আসে আরও অনেক বেশি। গত শনিবার ওই ল্যাবে পরীক্ষা হওয়ার অপেক্ষায় ছিল ১ হাজার ১০০ নমুনা। গতকালও অপেক্ষাধীন নমুনা ছিল প্রায় ১ হাজার ৪০০।

তবে এতে কোনো সমস্যা হবে না বলে দাবি করেছেন অধ্যাপক নাসিমা সুলতানা। তিনি বলেন, সংগৃহীত নমুনাগুলো বিশেষ তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করা হচ্ছে। যাঁরা আগে নমুনা দিচ্ছেন, তাঁদের পরীক্ষা আগে হচ্ছে।

কিন্তু অনেকে যোগাযোগ করে দিনে দিনেই পরীক্ষা করাতে পারছেন। অল্প সময়ে পরীক্ষার ফলও জানতে পারছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আইইডিসিআরের একজন কর্মকর্তা বলেছেন, প্রভাবশালীদের অনুরোধ রাখতে গিয়ে নমুনা সংগ্রহ ও ফল জানাতে জটিলতা হচ্ছে।

 মান নিয়ে প্রশ্ন

নমুনার মান নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। গতকাল একটি ল্যাবরেটরি থেকে প্রথম আলোকে জানানো হয়েছে, মানসম্পন্ন নমুনা আসছে না। অর্থাৎ নমুনা সংগ্রহ, নমুনা পাত্রজাত করা এবং নমুনা পাঠানোর ক্ষেত্রে ত্রুটি থাকছে।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, করোনা শনাক্তের পরীক্ষার জন্য নাক ও গলার লালার নমুনা সংগ্রহ করতে হয় বিশেষ কাঠির (সোয়াব স্টিক) মাধ্যমে। এই নমুনা বিশেষ তাপমাত্রায় পাত্রে রেখে তা ল্যাবরেটরিতে পাঠাতে হয়। কাজটি করেন মেডিকেল টেকনোলজিস্টরা। নমুনা সংগ্রহের জন্য প্রশিক্ষণ দরকার হয়।

কিন্তু মাঠপর্যায়ে পর্যাপ্তসংখ্যক টেকনোলজিস্ট নেই। বাংলাদেশ মেডিকেল টেকনোলজিস্ট অ্যাসোসিয়েশন জানিয়েছে, ১০ বছর ধরে টেকনোলজিস্ট নিয়োগ বন্ধ রেখেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। উপজেলা পর্যায়ে বা গ্রামে কারা নমুনা সংগ্রহ করছেন, তার সঠিক উত্তর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট শাখা থেকে পাওয়া যায়নি। তবে কিছু ক্ষেত্রে চিকিৎসকেরা নিজেরাই নমুনা সংগ্রহ করছেন বলে জানা গেছে।

ল্যাবরেটরি থেকে অভিযোগ এসেছে, লালা সংগ্রহের সময় সব ক্ষেত্রে সোয়াব স্টিক ব্যবহার করা হচ্ছে না। লালা রাখার পর পাত্রের মুখ ঠিকমতো আটকানো হচ্ছে না। এমন নমুনা পরীক্ষা করা যাচ্ছে না। বাদ দিতে হচ্ছে।

অবশ্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কর্মকর্তা বলেছেন, সংগৃহীত কিছু নমুনা বাদ পড়ে যাচ্ছে। এটা তাঁরা ‘সিস্টেম লস’ হিসেবে বিবেচনা করছেন।

 পরীক্ষার ব্যবস্থা

এ বছরের জানুয়ারির শেষ সপ্তাহে রোগ শনাক্তকরণ পরীক্ষা শুরু করেছিল আইইডিসিআর। তখন আইইডিসিআর বলেছিল, মানসম্পন্ন ল্যাবরেটরি দেশে যথেষ্ট নেই। তাই যন্ত্র থাকলেও সবাইকে পরীক্ষার অনুমতি দেওয়া হবে না। কারণ, সুরক্ষার ব্যবস্থা না থাকলে ল্যাবরেটরির মাধ্যমে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা আছে।

কিন্তু সেই সময়েও আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি) ছাড়াও আরও অন্তত দুটি প্রতিষ্ঠান ছিল, যাদের মানসম্পন্ন ল্যাব ছিল। কিন্তু সে সময় তাদের ব্যবহার করা হয়নি। এখন অনেককেই পরীক্ষা চালানোর অনুমতি দিচ্ছে সরকার। এদের সুরক্ষাব্যবস্থা নিয়ে অনেকেরই সংশয় আছে।

অধ্যাপক নাসিমা সুলতানা প্রথম আলোকে বলেন, এখন ২৫টি ল্যাবে পরীক্ষা হচ্ছে। আগামী পাঁচ দিনের মধ্যে আরও ৫টি ল্যাব পরীক্ষা শুরু করবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনটি বিভাগ যুক্ত হলে পরীক্ষার আওতা অনেক বেড়ে যাবে। তিনি বলেন, ‘আপাতত আমাদের লক্ষ্যমাত্রা দিনে পাঁচ হাজার নমুনা পরীক্ষা করা।’

এখন প্রশ্ন উঠেছে, মানসম্পন্ন নমুনা কারা সংগ্রহ করবে? স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদ একসময় বলেছিলেন, গ্রামের কমিউনিটি ক্লিনিকের কর্মীদের (সিএইচসিপি) দিয়ে এই কাজ করবেন, কিন্তু সম্ভব হয়নি।

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে ভাইরাস বিশেষজ্ঞ ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক নজরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, নমুনা সংগ্রহ করা জানতে হবে, সঠিকভাবে সংগ্রহ করতে হবে। এসব কাজে আরও সজাগ হতে হবে। তিনি বলেন, ‘প্রতিটি ল্যাবরেটরি হতে হবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্ধারিত মান অনুযায়ী। তা না হলে সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়বে, পরীক্ষা নিয়েও প্রশ্ন উঠবে।’