Thank you for trying Sticky AMP!!

করোনা, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এবং অনলাইন ক্লাসের ভাবনা

পৃথিবীর ইতিহাসে বর্তমান বিশ্ব চরম সংকটকালীন মুহূর্ত পার করছে। করোনা মহামারিতে জনজীবন বিপর্যস্ত। থমকে যাওয়া এই সময়ে মানুষের চোখেমুখে শুধু আতঙ্কের ছাপ। করোনা নামক ভয় যেন সবার আষ্টেপৃষ্ঠে লেগে আছে। বিশ্বজুড়ে লকডাউন পন্থা অবলম্বনের কারণে বেশির ভাগ মানুষ ঘরবন্দী। যান্ত্রিক জীবন হয়েছে স্থবির। ঘরবন্দী অবস্থায় বেশির ভাগ মানুষের অবসরের মেয়াদ যেন কমছে না। বরং দীর্ঘ কর্মবিরতি যেন তাদের একঘেয়ে জীবনের তিক্ততা আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে প্রতিনিয়ত।

বর্তমান পরিস্থিতি আমাদের সবার জন্যই আতঙ্কের। চারদিক মৃত্যুর খবরে জনজীবন দিশেহারা। করোনার সংকট মোকাবিলায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো দীর্ঘদিন বন্ধ। অন্যান্য সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান খোলা থাকলেও যেহেতু দেশের প্রায় তিন কোটি শিক্ষার্থী শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে জড়িত, তাই এ অবস্থায় করোনা সংক্রমণ মোকাবিলায়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ না রেখে উপায় নেই। দীর্ঘদিন শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ থাকায়, এই ক্ষতি পুষিয়ে নিতে অন্যান্য দেশের মতো সরকার অনলাইন ক্লাসের দিকে নজর দিচ্ছে। প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক পর্যায়ে সংসদ টেলিভিশনের মাধ্যমে ক্লাস নেওয়া হচ্ছে। উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়েও বিচ্ছিন্নভাবে অনলাইনভিত্তিক ক্লাস কার্যক্রম শুরু হয়েছে। কিন্তু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অনলাইন ক্লাস চলমান থাকলেও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইন ক্লাস এখনো পুরোদমে শুরু হয়নি। কোথাও অফিশিয়াল বা আনঅফিশিয়ালভাবে (ব্যক্তি উদ্যোগে) শুরু হলেও বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয় এখনই অনলাইন ক্লাসে যেতে নারাজ। ঢাকা, জাহাঙ্গীরনগর, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য বিশ্ববিদয়ালয়ের দ্বিমত সেই শুরু থেকেই।

করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের এই সময় দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করা বেশির ভাগ শিক্ষার্থীদের জন্য বোঝাস্বরূপ। কারণ হিসেবে—

১.
বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বেশির ভাগ শিক্ষার্থী গ্রামীণ সমাজ থেকে উঠে এসেছে। ছুটি পেলে তারা বাসায় গিয়ে বাবা, মা কিংবা পরিবারের সঙ্গে কাজ করে সংসারে সাহায্য করে। বর্তমানে দরিদ্র কিংবা মধ্যবিত্ত পরিবারের আয়ের উৎস অনেকটাই বন্ধ। এই মুহূর্তে পরিবারের সঙ্গে কাজ করা ছাড়া উপায় নেই।

২.
নতুন প্রস্তাবিত বাজেটে টেলিযোগাযোগ খাতে ৫ শতাংশ বাড়তি কর নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। সরকারের কর আদায়ের সহজ পদ্ধতি ও নগদে আদায়ের সহজ পথ টেলিযোগাযোগ খাত। চলতি মাসে ১৬ কোটি ২৯ লাখ ২০ হাজার সক্রিয় সিম ও ১০ কোটি ১১ লাখ ৮৬ হাজার ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর কাছ থেকে ব্যবহারের আগেই রাষ্ট্রীয় কোষাগারে ১০০ টাকায় ১৫ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক, সঙ্গে ১৫ শতাংশ মূল্য সংযোজন কর, সঙ্গে ১ শতাংশ সার চার্জ মিলিয়ে ৩৩ দশমিক ৫৭ টাকা নেওয়া হচ্ছে। মোবাইল অপারেটরগুলো অতিরিক্ত শুল্ক আদায়ের জন্য জনসাধারণের ওপর চাপিয়ে দিচ্ছে। বর্তমানে বোনাসবিহীন এক জিবি ইন্টারনেটের ন্যূনতম মূল্য গড়ে ৫০–৬০ টাকার বেশি। তা ছাড়া নির্দিষ্ট মেয়াদের বাধ্যবাধকতা তো আছেই। বেশির ভাগ পরিবারে অ্যান্ড্রয়েড ফোন নেই।

৩.
শহর থেকে গ্রামে পা রাখলেই দেখা যায় লোডশেডিংয়ের প্রভাব। একটু বাতাস বা ঝড় হলেই বিদ্যুৎ থাকে না। পাহাড়ি দুর্গম এলাকাসহ অনেক জায়গায় এখনো বিদ্যুৎসেবা পৌঁছেনি। ঠিক তেমনিভাবে প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোয় মোবাইল অপারেটরগুলোর নেটওয়ার্ক সেবাও দুর্বল।

৪.
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি এবং ব্যবহারিক সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো হাতেকলমে পাঠদান ছাড়া ক্লাস নেওয়া দুরূহ। এ ছাড়া বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠদান কার্যক্রমে ভিন্নতা রয়েছে, যা অনলাইন ক্লাসে সঠিকভাবে পড়ানো সম্ভব নয়। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এখন অনলাইনে ক্লাস নেওয়ার পরিবেশ ও প্রস্তুতি, কোনোটাই নেই।

৫.
যেসব পরিবারে করোনা আক্রান্ত ব্যক্তি রয়েছে, সেসব পরিবারের শিক্ষার্থীরা মানসিকভাবে ভেঙে পড়ছে। অনলাইনে ক্লাস করার মতো মানসিকতা তাদের নেই।

অনলাইন প্রক্রিয়ার ভর্তি ও পরীক্ষা নেওয়ার ক্ষেত্রে বিশ্বের বহু খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বহু আগে থকেই পূর্ণাঙ্গ অনলাইনব্যবস্থা সফলতার সঙ্গে ব্যবহার করে আসছে। বাংলাদেশেও অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি প্রক্রিয়ার অধিকাংশ কার্যক্রম অনলাইনে করে থাকে। কিন্তু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নানা রকম সীমাবদ্ধতা রয়েছে। এ অবস্থায় শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ থাকলে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কয়েক মাসের সেশনজট সৃষ্টির আশঙ্কা দেখা দেবে। যদিও বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বলছে, পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে বন্ধের ক্ষতি পোষাতে সাপ্তাহিক ছুটিসহ অন্যান্য ছুটি কমিয়ে অতিরিক্ত ক্লাস নিয়ে এই ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া যাবে। কিন্তু করোনা সংকটকালীন এই সময়ে আমাদের অনলাইন ক্লাস চলমান থাকলে হয়তো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে সেশনজট কিংবা আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হতো না। কিন্তু এত সীমাবদ্ধতার পরে যেখানে স্বয়ং শিক্ষার্থীদের (অধিকাংশ) অংশগ্রহণ অনিশ্চিত, সেখানে এই কার্যক্রম অনেকটাই বিলাসিতা। যদি আমাদের সীমাবদ্ধতাগুলো উত্তরণের উপায় খুঁজে বের করা যায়, কিছুটা হলেও সমাধান করে সিংহভাগ শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা যায়, তবেই এই অনলাইনভিত্তিক কার্যক্রম ফলপ্রসূ হবে। অন্যথায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যাগুলোতে অনলাইন ক্লাস লোক দেখানো ছাড়া আর কিছু নয়।

*শিক্ষার্থী: চতুর্থ বর্ষ, কৃষি, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়