Thank you for trying Sticky AMP!!

করোনা ভ্যাকসিন আবিষ্কারে বাংলাদেশের জয় হোক

বিজ্ঞানের ছাত্র হিসেবে বিশ্বাস করি, মানুষ যে পৃথিবীতে অন্য অনেক প্রাণীর মতো বিলুপ্ত হয়ে যায়নি, তার অন্যতম কারণ মানুষ জ্ঞান–বিজ্ঞানকে প্রতিনিয়ত কাজে লাগিয়ে বাধা–বিপত্তিকে জয় করছে। আর এই কারণেই বিজ্ঞানের প্রতি ভরসা আমাদের চিরন্তন। আজ সারা বিশ্ব আকুল হয়ে তাকিয়ে রয়েছে ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে শুরু হওয়া ভয়ংকর কোভিড-১৯ বা করোনাভাইরাসের গ্রাস থেকে কীভাবে মুক্তি পাবে।

করোনার কারণে উদ্ভূত মহামারির মরণছোবল আমাদের আর্থসামাজিক ব্যবস্থাকে শুধু বিপর্যস্ত করছে না, ব্যক্তিজীবনকেও করে তুলেছে বিষময়। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সামাজিক বন্ধন, উৎপাদন, শিল্প-সংস্কৃতি, সবকিছুই আজ মহাসংকটে। মোটামুটি আমরা এক স্থবির পৃথিবীর যুগসন্ধিক্ষণে। কিন্তু এই মহাসংকটকে রুখতে আর করোনা থেকে পূর্ণ নিস্তার পেতে হলে বিজ্ঞান-প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে ভাইরাসের প্রতিষেধক ভ্যাকসিনের আবিষ্কার আর এর প্রয়োগের যে বিকল্প নেই, এটি আমরা নিশ্চিত করে বুঝেছি। তাই একটি শুভক্ষণের আশায় আমরা অনেকটা উদ্‌গ্রীব।

বিশ্বের অনেক দেশই কোভিড-১৯ প্রতিষেধক আবিষ্কারের জন্য লড়াই চালিয়েও যাচ্ছে। সম্প্রতি বাংলাদেশের একটি বায়োটেকনোলজি কোম্পানির তরুণ এক বিজ্ঞানী ড. আসিফ মাহমুদ করোনা প্রতিষেধক নিয়ে তাঁদের কাজ করবার গল্প শোনালেন। আসিফদের সেই গল্পে দৃঢ়তা রয়েছে, এই মহাসংকটে দুর্দশাগ্রস্ত মানুষের প্রতি তাঁদের অনুকম্পা রয়েছে, তা তাঁর অভিব্যক্তি থেকে আমাদের মনে হয়েছে।

ভ্যাকসিন আবিষ্কার মোটেও সহজ কাজ নয়। এর জন্য প্রয়োজন শক্ত রিসার্চ আর ডেভেলপমেন্ট ভিত, সুদক্ষ বিজ্ঞানী, অত্যন্ত কঠিন নিয়ম–নীতি, স্বচ্ছতা আর আর্থিক সংগতি। ভ্যাকসিন উন্নয়ন বা আবিষ্কারের জন্য সুনিপুণভাবে কতগুলো প্রয়োজনীয় ধাপকে মেনে চলতে হয়। যেকোনো একটি ধাপের বিচ্যুতি পুরো কাজকে ভন্ডুল করে দিতে পারে। একটি ভাইরাসের ভ্যাকসিন তৈরির জন্য বিজ্ঞানীরা জেনে নেন ভাইরাসটির জীবনরহস্য। আর সঙ্গে যথাযথ বায়োইনফরমেটিকস। প্রয়োজন হয় ভাইরাসটিকে রোগী বা হোস্টের দেহ থেকে পৃথক করে সেটিকে অন্য মাধ্যমে জন্মানো, যাতে ল্যাবরেটরিতে কাজের জন্য সহজে ভাইরাসটি পাওয়া ও কাজে লাগানো যায়, ভ্যাকসিন ডিজাইন আর ক্যান্ডিডেট ভ্যাকসিন তৈরি করা, ইঞ্জিনিয়ারড ম্যামালিয়ান সেল থেকে অ্যান্টিজেন তৈরি করা, অ্যান্টিজেনে উৎপাদন করা, তারপর অ্যান্টিবডি শোধন করা এবং এগুলো প্রাণী ও মানুষের দেহে পরীক্ষা করার জন্য উপযুক্ত করা। যখন বিজ্ঞানীরা অ্যান্টিবডির গুণগত মান সম্পর্কে নিশ্চিত হন, তখনই পরের ধাপগুলোয় এগোতে পারেন। আর প্রাণীর দেহে এর কার্যকারিতা নির্ণয়ের জন্যও চাই মোক্ষম প্রাণী বা অ্যানিমেল মডেল নির্ধারণ করা। প্রাণীর দেহের পরীক্ষায় ভ্যাকসিনের ঝুঁকিহীন কার্যকারিতা প্রমাণিত হলেই ভ্যাকসিনটি ক্লিনিক্যাল পরীক্ষার জন্য নির্বাচিত হয়। আর তিনটি ধাপে ক্লিনিক্যাল পরীক্ষা সংগঠিত করা হয় এটির স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য।

ভ্যাকসিন নিয়ে এই কাজগুলো অনেক কারণেই ঝুঁকিপূর্ণ। আর এর জন্য প্রয়োজন জৈব-নিরাপত্তা বা সংবেদনশীল (containment) ল্যাবরেটরির। এই গবেষণাকাজগুলোয় ঝুঁকি এড়াতে সরকারের নির্ধারিত নিয়মনীতি পালন করাও অত্যাবশ্যক। সুখের বিষয় হলো বাংলাদেশের গ্লোব বায়োটেক কোম্পানি সফলভাবে প্রথম ধাপের অনেকগুলো কাজ সমাধা করেছে বলে জানিয়েছে। এই বিশাল কর্মযজ্ঞের নেপথ্যে রয়েছেন দুজন দক্ষ ও অভিজ্ঞ বায়োটেকনোলজিস্ট ড. কাঁকন নাগ এবং ড. নাজনিন সুলতানার নেতৃত্ব আর বেশ কজন মেধাবী বিজ্ঞানী।

বাংলাদেশের বিজ্ঞানীরা প্রাণীর দেহে প্রাথমিক পরীক্ষায় ভ্যাকসিনটির সফল কার্যকারিতা পেয়েছেন বলে জানিয়েছেন। বাংলাদেশের এমন একটি সফলতার সংবাদকে অভিনন্দন জানাতে দ্বিধা করার কোনো কারণ নেই। তারপরও মনে হয়েছে, গবেষণার অনেক অপরিপক্ব অবস্থায় এই প্রতিষ্ঠান তাদের সাফল্যের কথা জানিয়েছে মিডিয়াতে। এই বায়োটেক কোম্পানিটির বিজ্ঞানীরা পরিকল্পনা করেছেন, অচিরেই সরকারের সব রেগুলেটরি নিয়ম মেনে ভ্যাকসিনটির কার্যকারিতা প্রাণী মডেলে শুরু করবেন। প্রাণী মডেলে থেকে ক্লিনিক্যাল পরীক্ষায় ভ্যাকসিনটির কার্যকারিতা প্রমাণিত হোক, এই প্রত্যাশা আমাদের সবার।

বাংলাদেশে এই ধরনের সাহসী পদক্ষেপ একেবারে নতুন। এ ধরনের কাজে সফলতা শতভাগ হবে—এটা কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারে না। আর সারা বিশ্বে যেসব দেশ, গবেষণা ও ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান করোনার ভ্যাকসিন আবিষ্কারের দৌড়ে অংশগ্রহণ করেছে, তারা এই বিষয়কে মাথায় রেখেই কাজে নেমেছে। তাই গ্লোব বায়োটেকের উদ্যোগকেও এভাবেই বিবেচনা করতে হবে।

প্রশ্ন করা যেতে পারে, বিশ্বের অনেক দেশই তো করোনা ভ্যাকসিন আবিষ্কারের কর্মযজ্ঞে অনেক এগিয়ে রয়েছে। ভ্যাকসিন আবিষ্কার হলে তো তাদের কাছ থেকেই ভ্যাকসিন সংগ্রহ করা যেতে পারে। এ অবস্থায় বাংলাদেশের ভ্যাকসিন নিয়ে কাজ করার প্রয়োজন কী রয়েছে? আমরা মনে করি, অবশ্যই নিজেদের জন্য করোনা প্রতিষেধক ভ্যাকসিন আবিষ্কারের কর্মযজ্ঞে বাংলাদেশের অংশগ্রহণের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। যে দেশ বা যারাই করোনার প্রতিষেধক আবিষ্কার করুক না কেন, নিজেদের চাহিদা না মিটিয়ে তারা অন্য দেশের চাহিদা মেটাবে, এ চিন্তা অনেকটাও অমূলক। বাণিজ্যিকভাবে বিপুল পরিমাণের ভ্যাকসিন তৈরিতে প্রয়োজন রয়েছে অনেক সময়ের। বাণিজ্যিকভাবে অন্যের কাছ থেকে ভ্যাকসিন কিনতে গেলেও প্রয়োজন পড়বে অঢেল অর্থের।

আরেকটি বিষয় অবশ্যই বিবেচনা করতে হবে যে করোনাভাইরাস প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হচ্ছে, অর্থাৎ এর জেনেটিক কোডের পরিবর্তন ঘটছে। মিউটেড বা পরিবর্তিত ভাইরাসটির তীব্রতা বা ব্যাপকতারও তারতম্য ঘটছে। এ জন্য সময় আর এলাকাভিত্তিক করোনাভাইরাস ভ্যাকসিনের প্রয়োজনীয়তাকে বিবেচনায় আনা দরকার। একটি অনন্য প্রতিষেধক ভ্যাকসিন পরিবর্তিত অবয়বের করোনাভাইরাসকে দমন করতে পারবে, এটা নিশ্চিত করে বলা যায় না। এ জন্য আমাদের নিজেদের মতো করে ভ্যাকসিন নিয়ে কাজ করতে হবে। তা ছাড়া আমাদের এও মনে হয়েছে, বাংলাদেশে এখনো ভ্যাকসিন ডিপ্লোমেসিতে তেমন এগোতে পারেনি।

আমাদের দেশকে করোনা মহামারির মহাদুর্যোগ থেকে বাঁচাতে একটি সফল কার্যকর ভ্যাকসিনের তৈরির জন্য সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা খুবই জরুরি। সরকারের সংস্থাগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে এই মহৎ কর্মযজ্ঞে যে বিশাল আর্থিক আর অবকাঠামোগত সক্ষমতার প্রয়োজন রয়েছে, তা নিশ্চিত করার জন্য। স্বাস্থ্য, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়কে দেশের এ ক্লান্তিলগ্নে এই মহৎ কাজে স্বতঃস্ফূর্ত সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে।

ভ্যাকসিন আবিষ্কার একটি জটিল কাজ, অত্যন্ত ব্যয়বহুল কর্মযজ্ঞ। তারপরও আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানে মনে হয়েছে, ভ্যাকসিন আবিষ্কারের আর উন্নয়নের মূলনীতিগুলো আরও সঠিকভাবে মেনে দক্ষতার সঙ্গে কাজ করলে আমাদের প্রতিভাবান বিজ্ঞানীরা চলমান মহাদুর্যোগ থেকে পরিত্রাণের জন্য করোনা প্রতিষেধক আবিষ্কারে সফল হবেন। বাংলাদেশের বিজ্ঞানীদের এই ভ্যাকসিন আবিষ্কারের পরবর্তী ধাপ প্রাণীতে ভ্যাকসিনটির ঝুঁকিহীন কার্যকারিতা প্রমাণ গুরুত্বপূর্ণ। তারপর রয়েছে ক্লিনিক্যাল পরীক্ষা, যেটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এ কাজগুলো এগিয়ে নিতে হলে শীর্ষ খবর হওয়ার চেয়েও বিজ্ঞানকে গুরুত্ব দিতে হবে সর্বাঙ্গে। আমাদের বিশ্বাস, প্রতিভাবান বিজ্ঞানীরা এটিকে গুরুত্ব দেবেন। কাঁকন, নাজনিন আর আসিফদের প্রত্যয়ের জয় হোক, এটা আমাদের অন্তরের কামনা।

*লেখক বিজ্ঞানী, কলামিস্ট