Thank you for trying Sticky AMP!!

করোনা মহামারি: সাহিত্য থেকে কতটা শিক্ষা নিয়েছি

বিশ্বসাহিত্যের নানা বইয়ে মহামারির কথা তুলে ধরা হয়েছে। ছবি: সংগৃহীত

বিশ্বব্যাপী চলছে কোভিড-১৯ মহামারি। প্রতিদিন হাজারের অধিক মানুষ মারা যাচ্ছে। কার্যত বিশ্ব স্থবির হয়ে পড়েছে। কোভিড-১৯ বা করোনাভাইরাসের মতো মহামারির কথা বিশ্বসাহিত্যের অসংখ্য বইয়ে রয়েছে। আরও রয়েছে এ ধরনের মহামারি মোকাবিলায় আমাদের করণীয় সম্পর্কে। বিষয়টি স্পষ্ট হওয়ার জন্য বিশ্বসাহিত্যের কিছু বইয়ের পাঠ তুলে ধরা হলো।

অ্যারিস্টটল তাঁর পোয়েটিকস বইয়ে ট্র্যাজেডি নাটকের জন্য একটি টার্ম আলোচনা করেছেন। তা হলো ‘ক্যাথার্সিস’ যেটি মানব মনে নায়ক বা নায়িকার পতন নিয়ে ভয় ও করুণার সৃষ্টি করে। কোভিড-১৯ মহামারি বর্তমানে ক্যাথার্সিসের মতো আমাদের মনে ভয় ও করুণার সৃষ্টি করছে। শত শত লাশ দেখে ভয় হচ্ছে, একই সঙ্গে করুণাও হচ্ছে তাদের জন্য।

হোমারের ইলিয়াড
অসংখ্য বইয়ে মহামারির উল্লেখ রয়েছে। তেমনি একটি মহাকাব্য হোমারের ‘ইলিয়াড’। এই মহাকাব্যে দেখা যায় অ্যাগামেনন ক্রিসেইসকে বন্দী করার শাস্তিস্বরূপ গ্রিকদের শায়েস্তা করতে ট্রয় নগরীতে প্লেগ নামক মহামারি পাঠানো হয়েছে। সহজভাবে বলতে গেলে ইলিয়াড আমাদের বার্তা দিচ্ছে যে যখনই মানুষ পাপাচারে মশগুল হবে, তখনই স্রষ্টার কাছ থেকে মহামারি নেমে আসে। বর্তমান বিশ্ব তাকালে দেখা যাবে, কোথাও শান্তি নেই। সর্বত্র হাঙ্গামা, জোর–জুলুম, বর্ণবাদ, যুদ্ধ, মাইনর গোষ্ঠীকে দেশছাড়া করার পাঁয়তারা চলছে। তাহলে কোভিড-১৯–এর আগমন বার্তা কি আড়াই হাজার বছর আগেই দিয়ে গিয়েছিলেন হোমার?

ডেকামেরন
ইতালীয় লেখক জোবান্নি বোকাচ্চোর গল্পসংকলন ডেকামেরন (১৩৫৩) বইয়ে রয়েছে ১৪ শতকে ইতালির ফ্লোরেন্স শহরে ব্ল্যাক প্লেগ নামক মহামারিতে মৃত্যু নিয়ে গল্প। লোকজন প্লেগ থেকে রক্ষা পেতে ইতালির ফোরেন্সের বাইরে একটি বাড়িতে দুই সপ্তাহের জন্য আশ্রয় নেয়। বর্তমান করোনাভাইরাসের সঙ্গে ডেকামেরনের অবিশ্বাস্য মিল রয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, করোনা থেকে দেশকে রক্ষা পেতে বিদেশফেরতদের ১৪ দিনের হোম কোয়ারেন্টিনে থাকার জন্য। লোকালয় বা জনসমাগম এড়িয়ে সবাইকে বাড়িতে অবস্থানের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। মধ্যযুগের ডেকামেরন কি তাহলে আমাদের করোনা মোকাবিলার টেকনিক শিখিয়ে গেছে? অথচ ইতিহাস থেকে আমরা কতটা শিক্ষা নিয়েছি?

দ্য মাস্ক অব দ্য রেড ডেথ
আমেরিকান লেখক এডগার অ্যালেন পোর ছোট গল্প দ্য মাস্ক অব দ্য রেড ডেথ। এটি প্রকাশিক হয় ১৮৪২ সালে। এ ছোট গল্পে অ্যালেন পো দুর্যোগ বা মহামারি রোধে কর্তৃপক্ষের যথাযথ কার্যক্রম নিতে ব্যর্থ হবার বিষয়টি আলোকপাত করা হয়েছে। দেশে ভয়ংকর প্লেগ দেখা দেয়। লোমকূপ থেকে রক্ত বের হয়ে মানুষজন মারা যেত। প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার পরিবর্তে রাজা প্রসপারো রেড ডেথ নামক মহামারি থেকে রক্ষা পেতে তাঁর সভাসদদের নিয়ে এক আবদ্ধ মঠে আশ্রয় নেন এবং লোহার গেটটি বন্ধ করে দেন। নিশ্চিন্তে রাজা ও অন্যরা মজা মাস্তিতে মশগুল হন। ছদ্মবেশী বল নামক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। ওই অনুষ্ঠানে হইহুল্লোড়ের মধ্যে ছদ্মবেশী এক আগন্তুকের আবির্ভাব ঘটে, যে রাজাসহ বাকিদের হত্যা করে। বর্তমানে দেখা যায় ২০১৯–এর আগস্টে চীনে করোনা মহামারি দেখা দেওয়ার পরেও বিশ্ববাসী সতর্ক হয়নি। ফলে বিশ্ব এখন এর মূল্য চুকাচ্ছে। বাংলাদেশেও মহামারিটি দেখা দিয়েছে অথচ সরকার চাইলে অনেক আগেই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিয়ে ভাইরাসটি রুখে দিতে পারত।

অসংখ্য বইয়ে মহামারির উল্লেখ রয়েছে। ছবি: সংগৃহীত

দ্য প্লেগ
আলবেয়ার ক্যামুর বিখ্যাত উপন্যাস ‘দ্য প্লেগ’। আলজেরিয়ার ছোট্ট এক শহর ওরাও। সুখে-শান্তিতেই বসবাস করছিলেন সেই শহরের মানুষ। হঠাৎ একদিন শহরে ইঁদুরের উৎপাত শুরু হলো। ইঁদুরের উৎপাতে অতিষ্ঠ হয়ে মানুষও ইঁদুর মারতে শুরু করল। প্রথমে মানুষ মরা ইঁদুরগুলোকে ময়লা-আবর্জনার স্তূপে ফেলতে লাগল। একপর্যায়ে ইঁদুর মরা বাড়তে লাগল। মানুষ তখন মরে যাওয়া ইঁদুরগুলোকে মাটিতে পুঁতে ফেলতে শুরু করল। একসময় শহরের সব ইঁদুর মারা গেল। কিন্তু ইঁদুর থেকে পুরো শহরে ছড়িয়ে পড়ল এক মহামারি।

আলবেয়ার ক্যামুর বিখ্যাত উপন্যাস ‘দ্য প্লেগ’–এর কেন্দ্রীয় চরিত্র মধ্যবয়সী ডা. রিও। হঠাৎ একদিন প্রচণ্ড জ্বরে তার এক প্রতিবেশী মারা যায়। ডা. রিও গবেষণা করে বের করল যে তার প্রতিবেশী এক অজানা রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে। কিন্তু শহর কর্তৃপক্ষ বিষয়টি অস্বীকার করল। তাদের দাবি, ওই ব্যক্তি স্বাভাবিক জ্বরে মারা গেছে। শুরুতে কর্তৃপক্ষ বিষয়টি অস্বীকার করলেও পরে শহরবাসীর চাপে স্বীকার করে নেয় যে ‘প্লেগ’ নামক এক মহামারিতে মানুষ মারা যাচ্ছে। আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ল শহরের মানুষ। একসময় পুরো শহরের সব মানুষকে বন্দী করে রাখা হলো। যেটাকে এখন আমরা ‘কোয়ারেন্টিন’ বলছি। এই শহরের মানুষ বাইরে বের হতে পারবে না। আবার বাইরের মানুষও এই শহরে ঢুকতে পারবে না। মৃত্যুভয়কে উপেক্ষা করে দিনরাত পরিশ্রম করে মানুষের চিকিৎসা করতে লাগল রিও। একসময় তার স্ত্রী মারা যায় প্লেগ রোগে। কিন্তু চোখের সামনে হাজারো মানুষের মৃত্যু তাকে অনুভূতিহীন করে তোলে। দ্য প্লেগ আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় করোনাভাইরাসের কথা। আর চীনের উহান নগরীর ডাক্তাররা যেন ডাক্তার রিও।

আলবেয়ার ক্যামু ছাড়াও মহামারি নিয়ে কালজয়ী উপন্যাস লিখেছেন গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস—লাভ ইন দ্য টাইম অব কলেরা। এই উপন্যাসও শুরু হয়েছে একটি সদ্য মৃত্যুদৃশ্যের বর্ণনা দিয়ে। এ ছাড়া মহামারি নিয়ে রয়েছে স্টিফেন কিংয়ের ‘দ্য স্ট্যান্ড ( ১৯৭৮)’, দক্ষিণ আফ্রিকার লেখক ডোয়েন মেয়ারের ‘ফিভার ( ২০১৬)’। লিং মা–এর ফিকশনাল নভেল ‘সিভিয়ারেন্সে’ রয়েছে শন ফিভার নামক কাল্পনিক মহামারির কথা। মহামারি নিয়ে আরেক বিখ্যাত উপন্যাস হোসে সারামাগোর ‘ব্লাইন্ডনেস’।

এসব গল্প, উপন্যাস ও মহাকাব্য আমাদের বহু আগেই সতর্ক করে দিয়েছে। কিন্তু মানব কি সাহিত্য থেকে শিক্ষা নিয়েছে? নিলে হয়তো আজ এ মহামারিতে ভুগত না বিশ্ব। পরিশেষে সবার মনে প্রশ্ন একটাই—হে মৃত নগরী, কবে থামবে তোমার মৃত্যুর মিছিল?

*লেখক: শিক্ষার্থী, ইংরেজি বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়।