করোনা: শতাব্দীর নিষ্ঠুর উপাখ্যাননামা
>করোনাভাইরাস পাল্টে দিয়েছে আমাদের জীবনের বাস্তবতা। দেশ–বিদেশের পাঠকেরা এখানে লিখছেন তাঁদের এ সময়ের আনন্দ–বেদনাভরা দিনযাপনের মানবিক কাহিনি। আপনিও লিখুন। পাঠকের আরও লেখা দেখুন প্রথম আলো অনলাইনে। লেখা পাঠানোর ঠিকানা: dp@prothomalo.com
৮ মার্চ ২০২০। পৃথিবীর উত্তর থেকে দক্ষিণ, পূর্ব থেকে পশ্চিম—প্রতিটি প্রান্তে তখন টালমাটাল অবস্থা আগে থেকেই। সকাল হতে না হতেই দেশের সব স্যাটেলাইট চ্যানেল সরগরম হয়ে উঠল লাইভ টেলিকাস্টে। সবার চোখ তখন টেলিভিশনের পর্দায়।
‘আইইডিসিআর’ নামক প্রতিষ্ঠানটা প্রতিষ্ঠার ৪৩তম বছরে এসেও বোধ হয় এই নাদান বাঙালির চোখে আগে কখনো রেখাপাত করতে পারেনি। সেদিন আইইডিসিআরের বিশেষ সংবাদ সম্মলনে মাইক্রোফোনের সামনে এসে জরুরি কিছু বলার জন্য প্রস্তুতি নিয়ে বসে পড়লেন সম্পূর্ণ অপরিচিত এক মুখ। যাকে এর আগে এ দেশের মানুষ খুব একটা খেয়াল করেনি টেলিভিশন বা প্রচারমাধ্যমে।
অধ্যাপক মীরজাদি সেব্রিনা ফ্লোরা। পরিচয়-অণুজীবঘটিত রোগ নির্ণায়ক সংস্থা আইইডিসিআরের পরিচালক। কিছু সময় পরে কথা বলা শুরু করলেন। বলতে শুরু করলেন খুব জরুরি কিছু। অবশেষে পিনপতন নীরবতায় ঘোষণা করলেন সারা বিশ্বকে থমকে দেওয়া নীরব ঘাতকের বাংলাদেশে আগমনের দুঃসংবাদটি। হ্যাঁ, প্রাণঘাতী ভাইরাস ‘Covid-19’ তথা করোনাভাইরাস এই বাংলা মুলুকে ঢুকে পড়েছে। ইতিমধ্যে তিনজন শনাক্ত।
এর পরের ইতিহাসটা সবার জানা। পাল্লা দিয়ে জনমনে জমাট বাঁধল অস্থিরতা। সবাই ছোটাছুটি আরম্ভ করল। বিদেশ থেকে প্রবাসীরা দেশে এসে পাড়ি জমালেন। তাঁদের থেকে সংক্রমণের প্রবল আশঙ্কা থাকা সত্ত্বেও বাঙালির স্বভাবসুলভ অসচেতনতায় প্রাণঘাতী ভাইরাস ছড়িয়ে গেল গ্রাম-ইউনিয়ন ও মফস্বল এলাকায়।
শুরু হলো বিভীষিকাময় অধ্যায়। থমকে গেল টং–দোকানের চায়ের টেবিলের যত জম্পেশ আড্ডা কিংবা সড়কের ধুলাবালুতে মোড়ানো ট্রাফিক জ্যামে ব্যস্ত কোনো জনজীবন। মানুষ ঘরে বন্দী হলো। প্রতিবেশী বা পাশের বাসার ভাবিদের পরস্পরের মুখ চাওয়া–চাওয়ি ও পারিবারিক নানা সালতামামি নিয়ে খুঁনসুটিগুলো বন্ধ হয়ে গেল। মানুষ এর আগে মনে হয় এতটা অসহায় কখনোই অনুভব করেনি। প্রতিটা ঘর যেন একেকটা আস্ত কয়েদখানা।
প্রতিবেশীদের ঘরের কারও একটা কাশির আওয়াজ শুনতেই এবার দূর থেকে ব্যালকনি থেকে ব্যালকনি দিয়ে চলা যোগাযোগটাও বন্ধ হয়ে গেল। বাচ্চা ছেলেমেয়েগুলো বেশ কদিন রাতভর কার্টুনে মজে উঠল। উঠতি বয়সীরা অনলাইনে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। তৈরি হলো অন্য রকম এক আবহ। মেসেঞ্জার, জুম, ইমো, ভাইবার হয়ে গেল নিত্যদিনকার জীবনের গতিময়তার প্রধান রসদ। বহু আমুদে কাটল বেশ কটা দিন। কিন্তু আর কত! মানুষ তো আর জড় পদার্থ কিংবা বিদ্যুৎ–চালিত কোনো যন্ত্র নয় যে ২৪ ঘণ্টা একতালে অবিরত চলতে থাকবে। তারও প্রয়োজন হয় মুক্ত বাতাসের। প্রয়োজন হয় খোলা আকাশের। গ্লোবাল ভিলেজ তত্ত্বের এই যুগে তথ্যপ্রযুক্তি ও অনলাইন–নির্ভরশীলতার ভীষণ প্রয়োজনীয়তা থাকলেও মানুষ কিন্তু একান্ত অবসরটাতে সেই চিরচেনা সবুজের মাঝে, প্রকৃতির মাঝে হারাতে চায়। ভিড়তে চায় নদীকূলে। তাই তো বড়সড় কোনো ছুটি এলে পর্যটনকেন্দ্রগুলো ভরে ওঠে লোক-লোকারণ্যে। তিল ধারণের জায়গাটুকু থাকে না।
সে জায়গায় এহেন বিভীষিকাময় বন্দিদশা! যা কি না বর্তমানে হয়ে উঠেছে দুর্দমনীয়। মানুষ হাঁসফাঁস করছে প্রাণচাঞ্চল্যহীনতায়। অবিরাম ফোঁপাচ্ছে আর গোঙাচ্ছে।
এরপর নিয়ম করে প্রতিবছরের মতো এবারও ঈদ এল। কড়া নাড়ল আমাদের দরজায়। কিন্তু এক ভিন্ন আবহে, ভিন্ন পরিবেশে। এর আগে যে পরিবেশটার সম্মুখীন হয়নি গত শতাব্দীর মাঝভাগ থেকে এ শতাব্দীর এই শুরুর দিককার মানুষগুলো। চাঁদ দেখার পর ছোট শিশুদের আগের দিনগুলোর মতো সেই রাজ্যভর্তি উপচেপড়া হাসির রোল আর হইহুল্লোড়ের চিহ্নগুলো মিলিয়ে গেল। এ যেন এক ব্যতিক্রম ঈদ!
আচমকা সব যেন কে চুরি করে নিয়ে গেছে। এ রকমটা যে হবে তা তো কেউ কখনো ভাবেনি। ভুল করে বা ঘূর্ণাক্ষরেও চিন্তা করেনি। এখনো দুঃস্বপ্নের মতো মনে হয়। কী থেকে যে কী হয়ে গেল!
তারপরও এ মহাদুর্যোগকালীন ঈদের দিনগুলো ভালো কাটুক। এই কঠিন সময়ে আমাদের হেসেখেলে, পরিবারকে সময় দিয়ে, খুনসুটিতে মত্ত হয়ে, একে অপরের পাশে ছায়ার মতো মিশে থাকার ভীষণ প্রয়োজন। সাহস আর প্রেরণা জুগিয়ে চলা প্রয়োজন। কারও আকস্মিক অসুস্থতায় হতবিহ্বল না হয়ে পরিবারের সদস্যদের একে অপরকে ভরসা আর মানসিক দৃঢ়তা অর্জনের উৎসাহ–উদ্দীপনা দিয়ে আত্মিকভাবে শক্তিশালী রাখা প্রয়োজন।
আসুন, এ ভয়াবহ সময়কে প্রিয়জনকে সময় দিই। সামাজিক দূরত্ব মেনে চলি সঠিক নিয়মে। নিজেকে পরিষ্কার রাখি। অন্যদের মাঝে সচেতনতা তৈরির চেষ্টা চালাই। আশা রাখি সবার জীবনে আবার নেমে আসবে অসীম প্রশান্তির বারতা। স্রষ্টার কাছে প্রার্থনা করি, এ আঁধার কেটে যাক। আলো সন্নিকটে আসুক। এ পৃথিবী থেকে নীরব ঘাতকের বিদায়ের একটি স্বর্ণালি ভোরের আলোকোজ্জ্বল দিনের সাক্ষী হোক তামাম মানবকুল। সাক্ষী হোক সুজলা-সুফলা, শস্য-শ্যামলা এ বাংলাদেশ। সাক্ষী হোক তাবৎ দুনিয়ার প্রতিটি সচল ও ক্রিয়াশীল মানবচক্ষু।
‘এ আঁধার কেটে যাবে,
ছুটবে না আলো–আঁধারের পিছু।
এ রাঙা জ্যোতি আরও গাঢ় হবে,
আলোকিত হবে চোখ-মুখ আর সবকিছু।
এ কালরাত উবে যাবে দেখো,
কেটে যাবে শত বিষাক্ত প্রহর।
স্বপ্নাতুর দৃষ্টিতে চোখ মেলে রেখো,
মিটমিটে আলোর জাদুর শহর।।’
(নিজের কবিতা ‘ইয়াদ’ থেকে)
লেখক : শিক্ষার্থী, ঢাকা ডেন্টাল কলেজ (বিডিএস, প্রথম বর্ষ)
muzahidsiam787@gmail.com