Thank you for trying Sticky AMP!!

লকডাউনেও নারায়ণগঞ্জের কলকারখানা খোলা। ট্রলার না পেয়ে অতিরিক্ত যাত্রী হয়ে নৌকায় উঠছেন শহরে কাজ করতে যাওয়া শ্রমিকেরা। বৃহস্পতিবার সকালে বন্দর ঘাট থেকে তোলা

কারখানা খোলা রেখে ট্রলার বন্ধ, ভোগান্তিতে হাজারো শ্রমিক

বুধবার রাত ১০টা। খাবারের খালি বাক্স ও বাজার থেকে কেনা শাকসবজি সামনে রেখে নারায়ণগঞ্জের সেন্ট্রাল ফেরিঘাটের এক কোণে বসে আছেন আম্বিয়া বেগম (৫৩)। ঘাটে তখনো হাজারো ঘরমুখো মানুষের ভিড়। নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে হঠাৎ ট্রলার বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্তে তারা সবাই নদীর ঘাটে আটকা পড়েছে।

আম্বিয়া কাজ করেন শীতলক্ষ্যা নদীর পশ্চিমপারের নয়ামাটি হোসিয়ারি পল্লিতে। লকডাউনেও কারখানা খোলা। বাধ্য হয়েই বুধবার সকালে বন্দরের রুপালি আবাসিক এলাকা থেকে কাজে এসেছিলেন। রাত আটটায় কারখানা ছুটির পর ঘাটে এসে জানতে পারেন, প্রশাসনের পক্ষ থেকে নদী পারাপারের ট্রলার বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। আর তাতেই ঘাটে আটকা পড়েছেন কয়েক হাজার শ্রমিক। প্রায় দেড় ঘণ্টা যাবৎ বসে থাকা ক্ষুব্ধ আম্বিয়া বলেন, ‘ট্রলারে পার হই দুই টেহায়। হাতে দুই টেহাই আছে। এহন নৌকায় ৪–৫ টেহার ভাড়া ১০ টেহা। ১৫ জনের নৌকায় উঠতাছে ৩০ জন। এই শইলে ধাক্কাধাক্কি করতে পারি না। বইসা আছি। ভিড় কমলে মাঝিগো হাত–পায়ে ধইরা নদী পার হমু।’ বলতে বলতে ফুঁপিয়ে কেঁদে ফেলেন আম্বিয়া। বিড়বিড় করেন, ‘বাইত যামু কহন, রানমু কহন, খামু কহন? সকালে আবার কামেই আমু কেমনে?’

আম্বিয়া যখন কাঁদছেন, বন্দর ঘাটে ভিড় করা লোকজন তখন ছোটাছুটি করছে। ঘাটে নৌকা ভিড়লেই ঝাঁপিয়ে পড়ছে। ধাক্কাধাক্কি করে ১৫ জন ধারণক্ষমতার নৌকায় উঠছে ৩০–৩৫ জন। যারা নৌকায় ওঠার লড়াইয়ে হেরে যাচ্ছে, তারা আবার নতুন কোনো নৌকার দিকে ছুটছে। নারী, শিশু, বৃদ্ধদের কেউ কেউ আম্বিয়ার মতো ঘাটেই বসে ছিল। মানুষের ভিড় কমার অপেক্ষা তাদের।

লকডাউনেও নারায়ণগঞ্জের কলকারখানা খোলা। ট্রলার না পেয়ে অতিরিক্ত যাত্রী হয়ে নৌকায় উঠছেন শহরে কাজ করতে যাওয়া শ্রমিকেরা। বৃহস্পতিবার সকালে বন্দর ঘাট থেকে তোলা

রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আম্বিয়াদের অপেক্ষা শেষ হলেও বন্দর থেকে নারায়ণগঞ্জের কারখানাগুলোতে আসা লাখো শ্রমিকের ভোগান্তি শেষ হয়নি আজ বৃহস্পতিবার সকালেও। ট্রলার বন্ধ থাকায় মঙ্গলবার রাতের মতোই মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে নদী পার হয়েছেন বন্দরের লক্ষাধিক শ্রমিক। বুধবার রাতের পর বৃহস্পতিবার সকাল আটটা থেকে সাড়ে নয়টা পর্যন্ত শীতলক্ষ্যা নদীর বন্দর ঘাট এলাকা ঘুরে এসব মানুষের ভোগান্তির চিত্র দেখা গেছে। ঘাটে সারি সারি ট্রলার অলস পড়ে আছে। যাত্রীরা পার হচ্ছেন মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে। বন্দরঘাটে আসা বিসিক শিল্পনগরীর শ্রমিক গিয়াস উদ্দিন বলেন, ‘প্রশাসন একদিকে লকডাউন দিচ্ছে, আবার কারখানাও খোলা রাখছে। ট্রলার বন্ধ করে দিলে, রিকশা না চললে আমরা কারখানায় যাব কীভাবে? হয় কারখানা বন্ধ করুক, না হয় শ্রমিকদের স্বাস্থ্যবিধি মেনে যাতায়াতের ব্যবস্থা করুক।’

নগরীর কালীর বাজারের একটি ওষুধ ফার্মেসির মালিক মহিউদ্দিন মোল্লা। এ ধরনের সিদ্ধান্তকে হঠকারী অভিহিত করে তিনি বলেন, প্রশাসনের সব জায়গায় সমন্বয়হীনতা। প্রায় দেড় বছর হয়ে গেল এখনো তারা নদী পারাপার বিষয়ে স্থায়ী কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারছে না। গত বছর লকডাউন শুরুর পর থেকেই বিভিন্ন সময় হুটহাট সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে। একদিন নদী পারাপার বন্ধ থাকে, আবার আরেক দিন সবকিছুই ঠিকঠাক চলে। একটা স্থায়ী সিদ্ধান্ত হলে মানুষ বিপদ থেকে মুক্তি পায়।

লকডাউনেও নারায়ণগঞ্জের কলকারখানা খোলা। ট্রলার না পেয়ে নৌকায় উঠছেন শহরে কাজ করতে যাওয়া শ্রমিকেরা। বৃহস্পতিবার সকালে বন্দর সেন্ট্রাল ফেরিঘাট থেকে তোলা

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২২ জুন সকাল থেকে নারায়ণগঞ্জে লকডাউন শুরুর পর থেকেই বিভিন্ন সময় শীতলক্ষ্যা নদী পারাপারে নিষেধাজ্ঞা দেয় নারায়ণগঞ্জের প্রশাসন। এ সময় বন্দর, ৫ নম্বর খেয়াঘাট, বরফ কল ও নবীগঞ্জ ঘাটে হাজারো মানুষ ভোগান্তির শিকার হয়। জানতে চাইলে বন্দর খেয়াঘাটের ইজারাদার দিদার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘মঙ্গলবার বেলা আড়াইটার দিকে একজন ম্যাজিস্ট্রেট এসে ট্রলার বন্ধ রাখার নির্দেশ দেন। এ সময় ম্যাজিস্ট্রেটের সামনেই অতিরিক্ত যাত্রী নিতে গিয়ে একটি নৌকা কাত হয়ে যাত্রীরা নদীতে পড়ে যায়। আমরা তাঁকে অনুরোধ করেছি, তাঁরা যেন বাস্তবতা অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেন।’ গত বছর লকডাউনের পর থেকেই শীতলক্ষ্যা নদী পারাপার নিয়ে প্রশাসন সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে দাবি করে তিনি বলেন, প্রতিদিন অন্তত দেড় লাখ মানুষ বন্দর ঘাট পার হয়। নৌকা ও ট্রলার চালু থাকলে স্বাস্থ্যবিধি মেনে ভোগান্তি ছাড়াই ২৫–৩০ জন পার হওয়া সম্ভব। ভোগান্তি ঠেকাতে প্রয়োজনে ঘাটে অতিরিক্ত নৌকা ও ট্রলার এনে ২৪ ঘণ্টা সেগুলো চালু রাখার দাবি জানান তিনি।

নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২২ জুন থেকে শুরু হওয়া লকডাউনে নারায়ণগঞ্জের অন্তত তিন হাজার শিল্প কারখানা চালু রয়েছে, যার অধিকাংশই নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলায়। শীতলক্ষ্যার পশ্চিমপারের এসব কারখানায় নদীর পূর্বপারের বন্দর উপজেলায় বসবাসকারী অন্তত দুই লক্ষাধিক শ্রমিক কাজ করেন। কোনো প্রকার সেতু না থাকায় নৌকা ও ট্রলারই এসব শ্রমিকের নদী পারাপারের একমাত্র ভরসা।

লকডাউনেও নারায়ণগঞ্জের কলকারখানা খোলা। ট্রলার না পেয়ে নৌকায় উঠছেন শহরে কাজ করতে যাওয়া শ্রমিকেরা। বৃহস্পতিবার সকালে বন্দর সেন্ট্রাল ফেরিঘাট থেকে তোলা

লকডাউনে নৌযান চলাচলে বিধিনিষেধ থাকায় ট্রলারগুলো বন্ধ করা হচ্ছে বলে জানান নারায়ণগঞ্জের জেলা প্রশাসক মোস্তাইন বিল্লাহ। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, যাত্রীদের ভোগান্তি কমিয়ে আনতে বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে নয়টা থেকে পুনরায় ট্রলার চালু করা হয়েছে। শীতলক্ষ্যা পারাপারে স্থায়ী কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে কি না, জানতে চাইলে বলেন, ‘মন্ত্রী পরিষদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ীই আমরা ব্যবস্থা নেব। নদীতে যাত্রী পারাপার বিষয়ে এখনই স্থায়ী কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া যাচ্ছে না। আমরা স্বাস্থ্যবিধি মেনে নৌকাগুলোয় ৫ জন ও ট্রলারগুলোয় ১৫ জন যাত্রী পারাপারের নির্দেশ দিয়েছি।’

জেলা প্রশাসকের এ কথার পর সরেজমিনে সকালের পর বন্দরঘাটে কিছু কিছু ট্রলার চলতে দেখা গেছে। তবে নবীগঞ্জ ঘাটে আজ দুপুর পর্যন্ত কোনো ট্রলার চলতে দেখা যায়নি।