কুলাউড়ার ১৩টির মধ্যে ৭ ইউনিয়ন প্লাবিত
পাঁচ দিন ধরে পানিবন্দী অবস্থায় ঝুঁকি সয়ে বাড়িতেই ছিলেন ছমরু মিয়া। ঘরের মালপত্র রেখে যাবেন কোথায়! কিন্তু শেষমেশ কাঁচা ঘরটি আর রক্ষা করা সম্ভব হয়নি। আজ রোববার সকালেই ঘরটি ধসে পড়ে। তাই বাধ্য হয়েই কোমরপানি ভেঙে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে পাকা সড়কের কাছে ওঠেন। চোখের পানি মুছতে মুছতে ছমরু বললেন, ‘ভাই, ঘরটা আর টিকাইতাম পারলাম না। অখন কই যাইতাম!’ মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার হাজীপুর ইউনিয়নের উত্তর পলকি গ্রামে তাঁর বাড়ি।
কুলাউড়ার ১৩টির মধ্যে এখন সাতটি ইউনিয়ন বন্যা আক্রান্ত। আজ এর মধ্যে সকাল ১০টা থেকে বিকেল চারটা পর্যন্ত হাজীপুর ও পার্শ্ববর্তী টিলাগাঁও ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, অধিকাংশ বাড়িঘরে এখনো পাঁচ-ছয় ফুট পানি। অনেকের কাঁচা ঘরের চালা, বেড়া ধসে পড়েছে। হাজীপুরের বারইগ্রামে মনু নদের প্রতিরক্ষা বাঁধের ভাঙন দিয়ে শোঁ শোঁ করে পানি ঢুকছে। পানির তোড়ে ভেঙে পড়েছে কুণিমোড়া-কাউকাপন বাজার পাকা সড়ক। কুলাউড়া-শমশেরনগর সড়কের সালন ও কুণিমোড়া এলাকা তিন-চার ফুট পানির নিচে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, প্রশাসনের কর্মকর্তা, সেনাবাহিনী ও বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের উদ্যোগে নৌকায় করে বাড়ি বাড়ি গিয়ে ত্রাণ পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে।
হাজীপুরের রজনপুর গ্রামে মন্নান মিয়ার ঘরের ভেতর হাঁটুপানি। খাটের ওপর পরিবারের সদস্যদের নিয়ে আছেন। খাটের এক পাশে টিন দিয়ে তৈরি চুলায় রান্নার কাজ চলছে। মন্নান বলেন, ‘শুক্রবার রাইতে পানি কমতে ধরছিল। কাইল (শনিবার) দুপুর থাকি আবার বাড়া শুরু হইছে। কয় দিন যে অবস্থার মাঝে থাকমু একমাত্র ওপরওয়ালাই জানেন।’
বারইগ্রামের রিনা বেগম (৪০) বলেন, ‘ঘর ভাসাই নিছে। কিচ্ছু বাইর করতাম পারছি না। আরেক বাড়িত গিয়া আশ্রয় নিছি।’
বারইগ্রামে বন্যাদুর্গত মানুষকে ত্রাণ দিচ্ছিলেন ‘শুভেচ্ছা ক্লাব’ নামের একটি সামাজিক সংগঠনের কয়েকজন সদস্য। তাঁদের কেউ সরকারি, কেউ বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। কেউ কেউ কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করেন।
সংগঠনটির সভাপতি পুলকেশ নাগ বলেন, ‘সংগঠনের সদস্যরা চাঁদা তুলে ত্রাণের ব্যবস্থা করেছি। তিন দিন ধরে বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে শুকনো খাবার দিচ্ছি। কাল (সোমবার) স্থানীয় একজন পল্লি চিকিৎসককে নিয়ে দুর্গত এলাকায় গিয়ে চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া হবে।’
‘নির্ঝর ক্লাব’ নামের স্থানীয় আরেকটি সংগঠনের সদস্যরা উত্তর পলকি গ্রামে দুর্গত মানুষকে ত্রাণ দেন।
হাজীপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) ৩ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য আবদুল লতিফ চৌধরী তাঁর দোতলা বাড়ি দেখিয়ে বলেন, এর ঠিক পেছনে মনু নদের প্রতিরক্ষা বাঁধে ১২ জুন বিকেলে ভাঙন দেখা দেয়। পানির তোড়ে পাকা সীমানাপ্রাচীরসহ বাড়ির ভেতর থাকা দুটি ট্রাক্টর ও একটি মাইক্রোবাস ভেসে গেছে। জীবন বাঁচাতে শুধু পরিবারের সদস্যদের নিয়ে দ্রুত বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে পড়েন।
আবদুল লতিফ চৌধুরী বলেন, তাঁর এলাকাতেই অন্তত ৫০০ কাঁচা ঘর বিধ্বস্ত হয়ে গেছে। এক হাজার মানুষ এখনো পানিবন্দী।
হাজীপুর ইউপির চেয়ারম্যান আবদুল বাছিত বলেন, ৪২টি গ্রাম বন্যা আক্রান্ত। পানি নামার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। কাঁচা ঘর, রাস্তাঘাট আর আউশ ফসলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। সরকারিভাবে ১০ মেট্রিক টন চাল পাওয়া গেছে। তবে তা চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল।
কুলাউড়ার ইউএনও চৌধুরী মো. গোলাম রাব্বী বলেন, মৌলভীবাজারের জেলা প্রশাসন থেকে ত্রাণ হিসেবে ১০০ মেট্রিক টন চাল ও নগদ দেড় লাখ টাকা পাওয়া গেছে। ৩২টি আশ্রয়কেন্দ্রে ৭৮০ পরিবার উঠেছে। প্রতিদিন সবাইকে খিচুড়ি ও শুকনো খাবার দেওয়া হচ্ছে। কেউ না খেয়ে নেই।
এবারের বন্যার জন্য স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের কেউ কেউ আবার পানি উন্নয়ন বোর্ডকে (পাউবো) দায়ী করছেন।
কুলাউড়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আ স ম কামরুল ইসলাম ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, ‘জেলা প্রশাসনের সমন্বয় সভায় অনেকবার পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তাদের বলেছি, মনু নদের ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধগুলো ভালোভাবে মেরামত করতে। কিন্তু তারা কিছু স্থানে দায়সারা কাজ করে গেছে। ফলস্বরূপ এখন বাঁধ ভাঙল।’
তবে পাউবোর কর্মকর্তারা বলছেন, তাঁরা অর্থ বরাদ্দ কম পেয়েছেন। আর তাই কাজ আশানুরূপ হয়নি।
পাউবোর মৌলভীবাজার কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী রণেন্দ্র শংকর চক্রবর্তী বলেন, গত বছর অধিক ঝুঁকিপূর্ণ ও ভাঙনকবলিত বাঁধ মেরামতে অর্থ বরাদ্দ কম পাওয়া যায়। সেটা দিয়ে তাঁরা বিভিন্ন স্থানে কাজ করিয়েছেন।
রণেন্দ্র শংকর চক্রবর্তী বলেন, কুলাউড়ায় মনু নদে এখন ডেঞ্জার লেবেলে পানি রয়েছে। কুশিয়ারা নদী পানি বেশি টানতে পারছে না। তাই পানি ধীরে ধীরে কমছে।’