Thank you for trying Sticky AMP!!

কোচিং-বাণিজ্য বন্ধে সরকারের নীতিমালা বৈধ

ফাইল ছবি

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের কোচিং–বাণিজ্য বন্ধে সরকারের করা নীতিমালা বৈধ ঘোষণা করে রায় দিয়েছেন হাইকোর্ট। ২০১২ সালে ওই নীতিমালা করা হয়েছিল। এই নীতিমালায় সরকারি-বেসরকারি বিদ্যালয়, কলেজ ও মাদ্রাসার কোনো শিক্ষক তাঁর নিজ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীকে কোচিং করাতে বা প্রাইভেট পড়াতে পারবেন না বলা রয়েছে।

বিচারপতি শেখ হাসান আরিফ ও বিচারপতি রাজিক আল জলিলের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ আজ বৃহস্পতিবার এ রায় দেন।

কোচিং–বাণিজ্য বন্ধে পদক্ষেপ নিতে আট বছর আগে একটি রিট করেছিলেন এক অভিভাবক। আর নীতিমালার প্রণয়নের পর এর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে সাত বছর আগে আরেকটি রিট করেন পাঁচ শিক্ষার্থীর অভিভাবক। কোচিং–বাণিজ্যে জড়িত শিক্ষকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে দুদকের সুপারিশ, নীতিমালা ও কারণ দর্শাতে দেওয়া চিঠির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে কয়েকজন শিক্ষক গত বছর পৃথক তিনটি করেন। পৃথক এই পাঁচ রিটের চূড়ান্ত শুনানি শেষে বৃহস্পতিবার রায় দেওয়া হয়।

নীতিমালা সারবত্তাসম্পন্ন আইন
বিভিন্ন আইন ও তথ্যাদি পর্যালোচনা করে আদালত বলেন, এই নীতিমালা একটি সারবত্তাসম্পন্ন আইন। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী আচরণবিধি ও রেগুলেশন দিয়ে পরিচালিত হয়ে থাকে। সরকারের অনুমোদন ছাড়া বিধি অনুসারে তাঁরা কোনো ব্যবসা ও অন্যান্য লাভজনক কাজ করতে পারেন না। সরকারি স্কুল ও কলেজের শিক্ষকেরা পাবলিক সার্ভেন্ট। শৃঙ্খলা বিধি তাঁদের কোচিং–বাণিজ্য সমর্থন করে না, যা বিধিতে পেশাগত অসদাচরণ হিসেবে দেখা হয়েছে। এমনকি জাতীয় শিক্ষা নীতিতে কোচিং–বাণিজ্য নিষেধ করা রয়েছে। ওই সব বিধিবিধানে কোচিং–বাণিজ্যকে অনুমোদন দেয় না। যা নীতিমালার মাধ্যমে এর প্রতিফলন হয়েছে।

ঘোষিত রায়ে বলা হয়, আধুনিক বিশ্বে বিভিন্ন সার্কুলার ও পরিপত্র দিয়ে প্রশাসনিক দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়। সরকার প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য প্রয়োজনে সময়–সময় পরিপত্র, নীতিমালা, গাইডলাইন, সার্কুলার, বিজ্ঞপ্তি জারি করতে পারে, তবে তা কারও মৌলিক অধিকার ও আইনে স্বীকৃত অধিকারকে খর্ব করতে পারবে না। প্রশাসনিক কাজ চালাতে গিয়ে সরকারকে এ ধরনের সার্কুলার জারি করতে হয়। সব ক্ষেত্রেই সংসদের কর্তৃত্বে তা হতে হবে তেমন নয়। এ ক্ষেত্রে আইন রিট আবেদনকারী শিক্ষকদের কোচিং–বাণিজ্যে সংশ্লিষ্ট থাকার অধিকার দেয়নি। নীতিমালার মাধ্যমে রিট আবেদনকারী শিক্ষকদের মৌলিক অধিকারও খর্ব করা হয়নি। তবে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকসংশ্লিষ্ট প্রবিধান দিয়ে নিয়ন্ত্রিত হয়। 

দুদকের এখতিয়ার আছে, তবে অগ্রাধিকার ঠিক করা উচিত
দুদক কোচিং–বাণিজ্যের অভিযোগ অনুসন্ধান ও তদন্ত করতে পারে কি না, এই প্রসঙ্গও রায়ে আসে। আদালত বলেন, দুদক সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী ও শিক্ষকদের ক্ষেত্রে দুদক তদন্ত করতে পারে। তবে বেসরকারি শিক্ষকের বিষয়ে অনুসন্ধান ও তদন্ত করতে পারে না। দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধান ও তদন্তে দুদকের অগ্রাধিকার তালিকা থাকা উচিত, যেখানে দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনার জন্য দুদকের জনবলের সংকট রয়েছে। কাস্টম হাউস, ভূমি অফিস ও আদালত প্রাঙ্গণ যেখানে দুর্নীতির সম্পৃক্ততার ইস্যু রয়েছে, সেখানে এ ধরনের শৃঙ্খলাসংক্রান্ত বিষয়ে দুদকের সম্পৃক্ততা সমীচীন নয়। দুর্নীতির ইস্যু বলতে যা বোঝানো হয়, তাতে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কোনো শিক্ষক যথাসময়ে স্কুলে গেলেন কি গেলেন না, তা অনুসন্ধান ও তদন্তের তালিকার তলানিতে থাকা উচিত।

পৃথক পাঁচটি রিটের পরিপ্রেক্ষিতে হওয়া রুলের ওপর হাইকোর্টে একসঙ্গে শুনানি হয়। রিট আবেদনকারী শিক্ষকদের পক্ষে শুনানি করেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এম আমীর–উল ইসলাম ও তানিয়া আমীর, সঙ্গে ছিলেন আইনজীবী ইয়াদনান রফিক রসি। রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মোখলেছুর রহমান। এ ছাড়া অ্যামিকাস কিউরি হিসেবে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এ এফ হাসান আরিফ ও ফিদা এম কামাল আদালতে মতামত তুলে ধরেন। চূড়ান্ত শুনানি শেষে ২৭ জানুয়ারি রায় ঘোষণার জন্য ৭ ফেব্রুয়ারি দিন রাখেন। এর ধারাবাহিকতায় আজ রায় হয়। বেঞ্চের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি শেখ হাসান আরিফ দুপুর সোয়া ১২টা থেকে মাঝে এক ঘণ্টা বিরতি দিয়ে বিকেল চারটা পর্যন্ত ওই রায় ঘোষণা করেন।

নীতিমালার পূর্বাপর
কোচিং–বাণিজ্য বন্ধে নির্দেশনা চেয়ে ২০১১ সালে আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ অভিভাবক ফোরামের (মতিঝিল-বনশ্রী শাখা) তৎকালীন চেয়ারম্যান জিয়াউল কবির দুলু হাইকোর্টে একটি রিট করেন। প্রাথমিক শুনানি নিয়ে ওই বছরের ৭ অক্টোবর হাইকোর্ট রুল দেন। এমপিওভুক্ত শিক্ষক ও সরকারি শিক্ষকদের কোচিং দেওয়া নিষিদ্ধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না এবং এই ঘোষণা গেজেট আকারে প্রকাশের কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না রুলে তা জানতে চেয়ে রুল দেওয়া হয়। এই রুল অকার্যকর ঘোষণা করা হয় রায়ে।

এরপর ২০১২ সালের ২০ জুন সরকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের কোচিং–বাণিজ্য বন্ধে ওই নীতিমালা করে। ওই নীতিমালা উদ্দেশ্য প্রণোদিত দাবি করে ২০১২ সালের ৮ আগস্ট অপর রিটটি করেন অভিভাববক সমিতির তৎকালীন সভাপতি মিজানুর রহমানসহ পাঁচ অভিভাবক। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৩ সালের ২৯ জানুয়ারি হাইকোর্ট নীতিমালা প্রশ্নে রুল দেন। এই রুল খারিজ হয়।

এমপিওভুক্ত চার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ৭২ জন শিক্ষক ও সরকারি চারটি বিদ্যালয়ের ২৫ জন শিক্ষক কোচিং–বাণিজ্যে যুক্ত বলে দুদক প্রমাণ পেয়ে জানিয়ে ২০১৭ সালের ৪ ডিসেম্বর দুদকের পক্ষ থেকে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বরাবর চিঠি পাঠানো হয়। গত বছরের জানুয়ারিতে বিভিন্ন সরকারি স্কুলের ২৫ শিক্ষককে ঢাকার বাইরে বিভিন্ন জেলায় বদলির আদেশ দেওয়া হয়। গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে কোচিং–বাণিজ্যে জড়িত থাকার অভিযোগে রাজধানীর নামকরা চার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ৭২ শিক্ষককে কারণ দর্শাতে বলে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি)।

শিক্ষকদের তিন রিট
এ অবস্থায় ওই নীতিমালা ও কারণ দর্শানোর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের পদার্থবিদ্যা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ফারহানা খানম রিট করেন। একই বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্ট রুল দেন। কারণ দর্শানোর নোটিশ স্থগিত করা হয়। রায়ে ওই কারণ দর্শানোর চিঠি অবৈধ ঘোষণা করা হয়।

রিট আবেদনকারীপক্ষ জানায়, কারণ দর্শনো ও বদলির আদেশের বিরুদ্ধে শাজাহান সিরাজসহ সরকারি ল্যাবরেটরি হাইস্কুলের আট শিক্ষক গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে একটি রিট করেন। প্রাথমিক শুনানি নিয়ে গত ১২ বছরের ফেব্রুয়ারি ওই কারণ দর্শানোর চিঠি ও বদলির আদেশের প্রশ্নে রুল দেন। বদলির আদেশ স্থগিত হয়। পরে ওই আদেশ আপিল বিভাগে স্থগিত হয়। আজ এই রুল খারিজ হয়।

এ ছাড়া মতিঝিল সরকারি বালক উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষক মুহাম্মদ কবির চৌধুরী নীতিমালা, কারণ দর্শানো ও বদলির আদেশের বৈধতা নিয়ে গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে আরকেটি রিট করেন। গত ২৮ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্ট নীতিমালা, কারণ দর্শানো ও বদলি আদেশ প্রশ্নে রুল দেন। কারণ দর্শানোও স্থগিত করেন। আজ এই রুল খারিজ হয়।