Thank you for trying Sticky AMP!!

খাবার ও বিশুদ্ধ পানির তীব্র সংকট

এই দুই জেলা এখনো সারা দেশ থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন। অনেক এলাকাতেই মুঠোফোনের নেটওয়ার্ক নেই, বন্ধ ইন্টারনেট সেবাও।

  • ১৫ জেলার ৭৩টি উপজেলায় কমবেশি বন্যার পানি ঢুকে পড়েছে। গতকাল পর্যন্ত বন্যার পানিতে ডুবে ১০ জনের মৃত্যুর খবর জানিয়েছেন প্রথম আলোর প্রতিনিধিরা।

সিলেট বিভাগের বিস্তীর্ণ এলাকা এখনো বন্যার পানির নিচে। সেখানকার জনপদ যেন একেকটি বিচ্ছিন্ন দ্বীপ। যোগাযোগব্যবস্থার কিছুটা উন্নতি হলেও এখনো লাখো মানুষ পানিবন্দী। অনেক স্থানে খাওয়ার পানি ও খাদ্য পৌঁছায়নি। গতকাল দুপুরে কোম্পানীগঞ্জের থানাবাজার এলাকায়

সিলেট ও সুনামগঞ্জে ভয়াবহ বন্যার চার দিন পার হলো। এখনো বেশির ভাগ এলাকা বিদ্যুৎহীন। ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক হয়ে এলেও সড়কপথ পানিতে তলিয়ে আছে। বিভাগীয় শহর সিলেট থেকে শুরু করে জেলা শহর সুনামগঞ্জ এখনো সারা দেশ থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন।

এমন পরিস্থিতিতে বন্যায় আটকে পড়া মানুষদের নিরাপদ আশ্রয় পুরোপুরি নিশ্চিত করা যায়নি। বন্যাকবলিত এলাকায় খাবার ও সুপেয় পানির সংকট দূর করতে পারেনি স্থানীয় প্রশাসন। হাসপাতাল, ব্যাংকসহ বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানে পানি ঢুকে পড়ায় সেবা বন্ধ আছে। সিলেট শহর ছাড়া প্রায় এলাকাতেই মুঠোফোনের নেটওয়ার্ক নেই, বন্ধ ইন্টারনেট সেবাও। তবে গতকাল রোববার সুনামগঞ্জ শহরের উঁচু দালানের ছাদ থেকে অনেকে ইন্টারনেট সংযোগ পেয়েছেন। আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন।

এদিকে চার দিন পর গতকাল সকালে সিলেট ও সুনামগঞ্জে সূর্যের দেখা মেলে। সিলেটে দিনভর এক-দুবার বৃষ্টি হলেও থেমেছে ভারী বৃষ্টি। এ অবস্থায় দুই শহরের পানি কিছুটা কমে এলেও উপজেলাগুলোতে বন্যা পরিস্থিতি স্থিতিশীল আছে। তবে নদ-নদী দিয়ে ভারতের উজান থেকে পাহাড়ি ঢল আসা অব্যাহত থাকায় শঙ্কা কাটেনি মানুষের। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তথ্য বলছে, সিলেটের সব কটি নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত আছে। প্রধান দুই নদী সুরমা ও কুশিয়ারার পানি তিনটি পয়েন্টে বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

আশ্রয়কেন্দ্রসহ বন্যাকবলিত এলাকায় ত্রাণ বিতরণ চলছে। তবে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকায় জলযানের সংকটে বিভিন্ন স্থানে ত্রাণ পৌঁছানো সম্ভব হচ্ছে না। এ ছাড়া অনেক মানুষ আসতে থাকায় আশ্রয়কেন্দ্রের সংখ্যাও বাড়ানো হচ্ছে।
মো. মজিবর রহমান, সিলেটের জেলা প্রশাসক

Also Read: দেড় ঘণ্টার পানিতে তলিয়ে গেল সিলেট নগরের বাকিটুকুও

সিলেট ও সুনামগঞ্জ ছাড়াও নেত্রকোনা, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, জামালপুর, লালমনিরহাট, নীলফামারী, রংপুর, শেরপুর, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া গতকাল পর্যন্ত বন্যাকবলিত হয়ে পড়েছে বলে প্রথম আলোর প্রতিনিধিদের পাঠানো তথ্যে জানা গেছে। এই ১৫ জেলার ৭৩টি উপজেলায় কমবেশি বন্যার পানি ঢুকে পড়েছে। গতকাল পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন স্থানে বন্যার পানিতে ডুবে ১০ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে।

খাবারের কষ্টে মানুষ

মায়ের বুকের দুধের পাশাপাশি লেই (আটা বা ময়দা জ্বাল দিয়ে বানানো খাবার) খেত দেড় বছরের শিশু রুনা আক্তার। তিন দিন ধরে সে খাবারও ঠিকমতো পাচ্ছে না শিশুটি। সে পরিবারের সঙ্গে সিলেট সদর উপজেলার বাদাঘাট মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ আশ্রয়কেন্দ্রে আছে। বুকের দুধে পেট ভরছে না তার, ক্ষুধায় সারাক্ষণ কান্নাকাটি করছে রুনা।

শুধু রুনা নয়, আশ্রয়কেন্দ্রে ঠাঁই নেওয়া অন্য শিশুদেরও একই অবস্থা। আশ্রয়কেন্দ্রে যে খাবার দেওয়া হয়, তা বড়দের উপযোগী। শিশুদের উপযোগী কোনো খাবার না থাকায় তাদের কষ্ট হচ্ছে। খাবারের জন্য শিশুরা কান্নাকাটি করছে।

সিলেটের কোম্পানীগঞ্জের তেলিখাল উচ্চবিদ্যালয় আশ্রয়কেন্দ্রে ঠাঁই নিয়েছেন শিমুলতলা গ্রামের বাসিন্দা সেলিম আহমদ। তিনি জানান, চার দিন আগে তাঁরা ৪০০ মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে এসে উঠেছেন। মাত্র একবেলা চিড়া, মুড়ি ও গুড় পেয়েছেন। এখন খাবার ও সুপেয় পানির অভাবে তাঁরা ভুগছেন। এ ছাড়া তিন তলাবিশিষ্ট এ আশ্রয়কেন্দ্রের ১২টি কক্ষে তাঁরা ৪০০ মানুষ গাদাগাদি করে থাকছেন। কারও ঠিকমতো ঘুম হচ্ছে না। ঘুম ও খাবারের অভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন অনেকে। আশ্রয় পেয়েও যেন তাঁরা এখন আশ্রয়হীন।

জেলা প্রশাসন এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, সিলেট জেলায় ৪৯৭টি আশ্রয়কেন্দ্রে ২ লাখ ৩০ হাজার ৬৩২ মানুষ আশ্রয় নিয়েছে। এ ছাড়া গবাদিপশু ঠাঁই নিয়েছে ৩১ হাজার। এ বিষয়ে সিলেটের জেলা প্রশাসক মো. মজিবর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, আশ্রয়কেন্দ্রসহ বন্যাকবলিত এলাকায় ত্রাণ বিতরণ চলছে। তবে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকায় জলযানের সংকটে বিভিন্ন স্থানে ত্রাণ পৌঁছানো সম্ভব হচ্ছে না। এ ছাড়া অনেক মানুষ আসতে থাকায় আশ্রয়কেন্দ্রের সংখ্যাও বাড়ানো হচ্ছে।

আটকে পড়া মানুষদের উদ্ধারে সেনাবাহিনী ও নৌবাহিনী কাজ করছে। গত শনিবার পর্যন্ত সেনাবাহিনীর সদস্যরা দুই জেলার অন্তত দুই হাজার আটকে পড়া মানুষকে উদ্ধার করেছেন।
মুহাম্মদ মোশাররফ, সিলেটের বিভাগীয় কমিশনার
পাঁচ দিন আগে আশ্রয়কেন্দ্রে এসেছেন নেহারুন বেগম। গতকাল কোম্পানীগঞ্জের তেলিখাল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে

সিলেট-কোম্পানীগঞ্জ মহাসড়কের পাশেই গৌরীনগর গ্রাম। বন্যার পানিতে এ গ্রামও তলিয়ে গেছে। তবে গ্রামের সামনে দিয়ে যাওয়া মহাসড়কের অনেকটা অংশ উঁচু থাকায় সেখানে বন্যার পানি ওঠেনি। এ অবস্থায় গ্রামের চল্লিশোর্ধ্ব মো. শাহজাহান সড়কে থাকা একটি ট্রাকে মা, স্ত্রী, মেয়ে ও ভাইকে নিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন। বৃষ্টি থেকে বাঁচতে ট্রাকে ত্রিপল টানিয়েছেন। এরপর তিন দিন ধরে তাঁরা এখানেই আছেন। এই কটি দিন কেবল শুকনো খাবার খেয়েই কাটিয়েছেন তাঁরা। কোনো ত্রাণ পাননি।

সুনামগঞ্জ শহরের মোহাম্মদপুর এলাকার বাসিন্দা বীর মুক্তিযোদ্ধা জয়নাল আবেদীন (৭২) বলেন, অনেকে তিনতলা, চারতলা ভবন শহরের মানুষদের জন্য ছেড়ে দিয়েছেন। বাড়িঘরে আটকা পড়া মানুষদের স্থানীয় অনেকে উদ্ধার করে নিয়ে এসব ভবনে ঠাঁই দিয়েছেন। যাঁদের খাওয়ানোর সামর্থ্য আছে, তাঁরা আশ্রয়গ্রহণকারীদের খাওয়াচ্ছেনও। তবে খাবার শেষ হয়ে এসেছে। দ্রুত পানি না কমলে পরিস্থিতির ভয়াবহতা আরও বাড়বে।

Also Read: সুনামগঞ্জ শহরে এখনো হাঁটুপানি

গতকাল রাত সোয়া আটটায় কথা হয় সিলেটের বিভাগীয় কমিশনার মুহাম্মদ মোশাররফ হোসেনের সঙ্গে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বন্যা শুরুর পরপরই মুঠোফোনের নেটওয়ার্ক ও যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যান তাঁরা। এতে প্রশাসনও পরিস্থিতি মোকাবিলায় কিছুটা হিমশিম খেয়েছে। তবে যোগাযোগ এখন বেড়েছে। তাই দুই জেলার সব বন্যাকবলিত এলাকায় ত্রাণ পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে। খাবার ও সুপেয় পানির হাহাকার দ্রুতই দূর হবে।

পানিতে আটকে পড়া মানুষ দুর্ভোগে

সুনামগঞ্জ শহরে কোথাও দাঁড়ানোর মাটি নেই। পানি কিছুটা কমে এলেও এখনো চার থেকে ছয় ফুট পানিতে তলিয়ে আছে শহর। দোকানপাট, অফিস-আদালত, সব জায়গায় পানি আর পানি। নৌকা ছাড়া যাতায়াতের কোনো সুযোগ নেই। স্কুল-কলেজ, মসজিদ, অফিস-আদালত, বাড়ির ছাদ, উঁচু সেতুসহ শহরের বহুতল ভবনগুলোতে হাজারো মানুষ আশ্রয় নিয়েছে। কোনো কোনো স্থানে এক ঘরে ২০ থেকে ৩০ জন মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন।

সুনামগঞ্জের মোহাম্মদপুর এলাকার একটি ভবনের মালিক সালাউদ্দিন মাহবুব বলেন, ‘আশ্রয় হারিয়ে অনেকে এসেছেন। এভাবে বিপদ হঠাৎ করে আসবে, এটা তো কল্পনায়ও ছিল না। মানুষ তো আগাম বুঝতে পারেনি। কয়েক ঘণ্টায় এমন গজব নামবে, কেউ ভাবতেই পারেনি। একেক ভবনে প্রচুর মানুষ থাকায় ঘুমহীন কাটাচ্ছেন অনেকে। খাবার আর বিশুদ্ধ পানির সংকট তো আছেই।’

সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা সদরের বাসিন্দা আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, পানিবন্দী হয়ে আটকে আছেন। বাসার মালামাল সরাতে গিয়ে চার দিন আগে বৃষ্টির পানিতে ভেজার কারণে প্রচণ্ড জ্বর উঠেছিল। হাসপাতাল পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় চিকিৎসকও দেখাতে পারেননি। ওষুধের দোকানও খোলা নেই।

সিলেটের বিভাগীয় কমিশনার মুহাম্মদ মোশাররফ প্রথম আলোকে বলেন, আটকে পড়া মানুষদের উদ্ধারে সেনাবাহিনী ও নৌবাহিনী কাজ করছে। গত শনিবার পর্যন্ত সেনাবাহিনীর সদস্যরা দুই জেলার অন্তত দুই হাজার আটকে পড়া মানুষকে উদ্ধার করেছেন।