Thank you for trying Sticky AMP!!

খুলনা সিটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের খালেক ও বিএনপির মঞ্জুর ব্যস্ততা, চলছে ভোটারদের হিসাব

তালুকদার আবদুল খালেক ও নজরুল ইসলাম মঞ্জু। ছবি: সংগৃহীত

খুলনা সিটি করপোরেশন (কেসিসি) নির্বাচনে মেয়র প্রার্থী পাঁচজন হলেও মূল লড়াই হবে আওয়ামী লীগের তালুকদার আবদুল খালেক ও বিএনপির নজরুল ইসলাম মঞ্জুর মধ্যে। দুই দলই নির্বাচনের ফল নিজেদের অনুকূলে নিতে ব্যস্ত সময় পার করছে। আর ভোটাররা করছেন হিসাব-নিকাশ।

সাধারণ মানুষ, রাজনীতিবিদ ও নির্বাচন–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, খুলনার ভোটে বেশ কিছু বিষয় কাজ করে। প্রার্থীদের মধ্যে যিনি এগুলোকে নিজের অনুকূলে নিতে পারবেন, তিনিই জয়ী হবেন। তাঁরা বলছিলেন, খুলনা সিটি করপোরেশনের থাকা সংসদীয় দুটি আসনে কখনো আওয়ামী লীগ বা বিএনপির একক আধিপত্য ছিল না। এতে বোঝা যায়, ভাসমান ভোটার এখানে বেশি।

সরেজমিনে খুলনার ভোটার এবং নানা পর্যায়ের মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রধান দুই দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির ভোট ব্যাংকের পাশাপাশি নানা বিষয় ভোটের ফল নির্ধারণে প্রভাব ফেলবে। এসবের মধ্য রয়েছে দলীয় সংহতি, তরুণ ভোটার, নারী ভোটার, আঞ্চলিক ভোটার, ভাসমান ভোটার, আটকে পড়া পাকিস্তানিদের ভোট, সবুর খানের অনুসারীদের ভোট ও নগরের উন্নয়ন।

গণসংযোগে তালুকদার আবদুল খালেক। ছবি: সাদ্দাম হোসেন

জানতে চাইলে সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক) খুলনার সভাপতি অধ্যাপক আনোয়ারুল কাদির প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রধান দুই দলই তাদের সেরা প্রার্থীকে নির্বাচনে মনোনয়ন দিয়েছে। এখন ভোটারদের হাতে বল। তাঁরা কাকে বেছে নেবেন, সেটা তাঁদেরই বিবেচনা। নানা দিক বিচার করেই তাঁরা প্রার্থী বাছবেন বলেই আমার ধারণা।’

দলীয় সংহতি: তালুকদার আবদুল খালেক এক মেয়াদে (২০০৮–১৩) কেসিসির মেয়র ছিলেন। স্থানীয় লোকজন বলছেন, তাঁর আমলে খুলনায় দৃশ্যমান উন্নয়ন হয়েছে। তারপরও পরেরবার বিএনপির মনিরুজ্জামান মনির কাছে হেরে গিয়েছিলেন খালেক। এরপর থেকে খালেক ব্যস্ত ছিলেন তাঁর নির্বাচনী এলাকা বাগেরহাট-মংলা নিয়ে। এবারের নির্বাচনে তিনি প্রার্থী হতে অনিচ্ছুক থাকলেও নৌকার মাঝি তাঁকেই করেছে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ। অবশ্য স্থানীয় লোকজনের প্রস্তাবে তাঁর নামই ছিল সবার আগে। মহানগরের ওই এলাকা দলের সাধারণ সম্পাদক ও সাংসদ মিজানুর রহমানের নির্বাচনী এলাকা।

মিজানুর রহমানের সঙ্গে খালেকের দূরত্ব থাকলেও সাম্প্রতিক সময়ে মিজানুর রহমান কিছুটা কোণঠাসা। মিজানের বিরুদ্ধে দুদকে অনুসন্ধান চলছে। এ ছাড়া তাঁর অনুসারীদের একটি বড় অংশ ব্যবসায়ী সালাম মুর্শেদীর সঙ্গে ভিড়ে গেছে। সালাম মুর্শেদী আগামী সংসদ নির্বাচনে খুলনা–২ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেতে পারেন বলে ওই এলাকায় প্রচার রয়েছে। সালাম মুর্শেদীর অনুসারীরা খালেকের পক্ষে মাঠে নামবেন বলে দলীয় নেতা-কর্মীরা বলছেন। স্থানীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষকেরা বলছেন, মিজানের অন্য অনুসারীরা দলের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে খালেকের বিপক্ষে কাজ করার ঝুঁকি নেবেন না। এদিক থেকে খালেক ভালো অবস্থানে রয়েছেন বলে তাঁদের পর্যবেক্ষণ।

গণসংযোগে নজরুল ইসলাম মঞ্জু। ছবি: সাদ্দাম হোসেন

দলীয় সংহতির জন্য দিনরাত কাজ করছে স্থানীয় বিএনপি। কেন্দ্রের পক্ষ থেকেও এ বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। সদ্য সাবেক মেয়র মনিরুজ্জামান মনিকে মনোনয়ন না দেওয়ায় স্থানীয় বিএনপিতে মনির অনুসারীরা ক্ষুব্ধ। মনিসহ তাঁর অনুসারীদের কাজে লাগাতে অনেকটা মরিয়া মঞ্জু ও তাঁর সমর্থকেরা। এরই মধ্যে মনি মঞ্জুর পক্ষে কাজ করার ঘোষণা দিলেও তাঁর সমর্থকদের নিজের পক্ষে কাজে লাগানোই মঞ্জুর জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।

নানামুখী ভোটার
কেসিসি নির্বাচনে এবার ভোটার সংখ্যা ৪ লাখ ৯৩ হাজার ৪৫৪। আগের বছরের তুলনায় এবার ভোট বেড়েছে প্রায় ৫২ হাজার। ভোটারদের বিশ্লেষণে দেখা যায়, মহানগরীর ভোটারদের মধ্যে বস্তিবাসীদের ভোট এক লাখেরও বেশি। হিন্দু সম্প্রদায়ের ভোটার রয়েছে ৭০ হাজারের মতো। শ্রমিক আছেন প্রায় ৬০ হাজার। এ ছাড়া প্রায় ত্রিশ হাজারের বেশি আটকে পড়া পাকিস্তানির ভোট রয়েছে।

স্থানীয় বিশ্লেষকদের মতে, খুলনা মহানগরীতে দীর্ঘদিন ধরেই ভোটের ক্ষেত্রে বিএনপি এগিয়ে। খুলনা-২ নির্বাচনী এলাকায় মুসলিম লীগপন্থীদের প্রভাবের কারণে সংসদীয় কিংবা পৌর নির্বাচনে বেশির ভাগ সময়ই বিএনপি প্রার্থীরাই বিজয়ী হন। কেসিসির আরেক অংশ খুলনা-৩ নির্বাচনী এলাকায় আওয়ামী লীগের প্রভাব বেশি বলে পর্যবেক্ষণ বিশ্লেষকদের।

তাঁদের মতে, আওয়ামী লীগ বিএনপির নিজস্ব ভোট ব্যাংকের পাশাপাশি আঞ্চলিক ভোটারদের একটি বড় প্রভাব রয়েছে। বরিশাল, ঝালকাঠি, বাগেরহাট, মাদারীপুর, গোপালগঞ্জ, সাতক্ষীরা, নোয়াখালী, বৃহত্তর যশোরসহ বিভিন্ন এলাকার শিল্পশ্রমিকদের অবস্থান শিল্প এলাকায়। খুলনায়–৩ নির্বাচনী এলাকার এসব ভোটারের প্রতি নজর প্রধান দুই প্রার্থীর। এ ছাড়া গোপালগঞ্জ, সাতক্ষীরা, বাগেরহাটের ও খুলনা এলাকার অনেক মানুষই খুলনা–২ নির্বাচনী এলাকায় প্রভাবশালী হিসেবে পরিচিত। রাজনীতিতে সরাসরি যুক্ত না থাকা এসব ভোটারও নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবেন বলে ধারণা।

খুলনা সিটি করপোরেশন (কেসিসি) নির্বাচনে এবার ভোটার ৪ লাখ ৯৩ হাজার ৪৫৪। ছবি: সাদ্দাম হোসেন

বিশ্লেষকদের মতে, ১৪ দল ও আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর জাতীয় পার্টির (জেপি) সমর্থন, খালেকের রাজনৈতিক সহকর্মী ও নিজের প্রভাবের কারণে বরিশাল ও বাগেরহাটের ভোটারদের একটি অংশের সমর্থন পাবেন তিনি। এ ছাড়া ঝালকাঠি, গোপালগঞ্জ, যশোর ও নড়াইলের একটি অংশের সমর্থন পাবেন বলে মনে করেন খালেক–সমর্থকেরা।

জানা গেছে, আঞ্চলিক ভোটারদের মধ্যে মাদারীপুর ও সাতক্ষীরার একটি বড় অংশের সমর্থন রয়েছে মঞ্জুর প্রতি। এ ছাড়া খুলনায় বসবাসরত বরিশাল, ঝালকাঠি, বাগেরহাট, বৃহত্তর যশোরসহ অন্যান্য অঞ্চলের একাংশের সমর্থন পাবেন বলে মঞ্জুর সমর্থকদের প্রত্যাশা।

অন্যদিকে, কেন্দ্রীয় ২০–দলীয় জোটে বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের কিছুটা টানাপোড়েন থাকলেও স্থানীয় জামায়াতের ভোট নিশ্চিত করতে কাজ করছে বিএনপি। খুলনায় জামায়াত এখনো সংগঠিত বলে মনে করেন অনেকে। ১৯৯৪ সালে কেসিসি নির্বাচনে জামায়াতের মেয়র প্রার্থী মিয়া গোলাম পরওয়ার প্রায় ২৭ হাজার ভোট পেয়েছিলেন। পরের প্রতিটি নির্বাচনে জামায়াত বিএনপির পক্ষে সরাসরি কাজ করেছে।

খুলনার উন্নয়ন এবারের নির্বাচনে বড় প্রভাব ফেলতে পারে বলে বিশ্লেষকদের ধারণা। ছবি: সাদ্দাম হোসেন

স্থানীয় লোকজনের তথ্যমতে, খুলনায় আটকে পড়া পাকিস্তানিদের ভোট প্রায় ৩০ হাজার। অতীতে এদের বেশির ভাগই বিএনপির পক্ষে কাজ করেছেন। এবার এরা কোন পক্ষে যান সেটা এখনো বোঝা যাচ্ছে না।

নতুন প্রজন্মের ভোটারদেরও একটি বড় প্রভাব ফেলতে পারে বলে অনেকেই মনে করছেন।

সনাক খুলনার সভাপতি অধ্যাপক আনোয়ারুল কাদির মনে করেন, নতুন ভোটাররা উন্নয়ন কিংবা রাজনৈতিক দল নিয়ে ভাবে না। তারা প্রার্থীর কথা বিবেচনা করবে। ভালো প্রার্থী দেখে ভোট দিতে চাইবে। নারী ভোটাররাও একই বিবেচনা করতে পারেন। তাঁদের মতে, যিনি উন্নয়ন করতে পারবেন এবং যার কাছে সহজে গিয়ে কথা বলার সুযোগ পাবেন তাঁকেই তারা ভোট দেবেন।

উন্নয়ন
খুলনার উন্নয়ন এবারের নির্বাচনে বড় প্রভাব ফেলতে পারে বলে বিশ্লেষকদের ধারণা। তাঁদের মতে অপরিকল্পিত নগরায়ণ বন্ধ, জলাবদ্ধতা থেকে রক্ষা, ফুটপাত সংস্কার, স্বাস্থ্যসেবার সুযোগ বাড়ানো, মাদকমুক্ত শহর গড়া ইত্যাদি ভোটারদের বিবেচনায় থাকবে। পরিচ্ছন্ন-আধুনিক নগরী গড়ে তোলায় সক্ষমতাও ভোটারদের বিবেচনায় আসবে।

স্থানীয় অনেক ভোটার বললেন, তাঁরা এমন একজন প্রার্থীকে মেয়র হিসেবে দেখতে চান, যাঁর কাছে খুব সহজে যাওয়া যাবে, নিজেদের কথা বলা যাবে। এ শহরকে সুন্দর বাসযোগ্য শহর হিসেবে গড়ে তুলতে পারবেন। ভোটের এখনো ২৩ দিন বাকি থাকলে ভোটারদের মধ্যে হিসাব-নিকাশ শুরু হয়ে গেছে। আবার আশঙ্কাও রয়েছে অনেকের মধ্যে। তাঁরা চান, ভোটের ফল যা–ই হোক না কেন, সুষ্ঠু সুন্দর একটি নির্বাচন হোক। ভোটাররা যাতে নিজেরা ভোট দিয়ে তাঁদের প্রতিনিধি নির্বাচন করতে পারেন, সে প্রত্যাশা সবার।

খুলনার ভোটে বেশ কিছু বিষয় কাজ করে। ছবি: সাদ্দাম হোসেন


দুই প্রার্থী যা বলছেন
ভোটের নানা হিসাব–নিকাশ সম্পর্কে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের প্রার্থী তালুকদার আবদুল খালেক প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার আমলে আমি যেসব উন্নয়নকাজ করেছি, সেগুলো অবশ্যই ভোটাররা বিবেচনা করবেন। খুলনার উন্নয়নের স্বার্থে দলমত-নির্বিশেষে আমাকে ভোট দেবেন।’ খালেক আরও বলেন, বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া যখন খুলনা সদরের সাংসদ ছিলেন, তখনো খুলনার উন্নয়ন হয়নি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা খুলনার উন্নয়নে তাঁর আন্তরিকতা দেখিয়েছেন। তিনি মোংলায় ইপিজেড করেছেন, খুলনার কাছেই পায়রাবন্দর গড়ে তুলেছেন, শহর ও এর আশপাশে বড় বড় প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে। খুলনাকে তিলোত্তমা নগরী গড়তে নগরবাসী তাঁকেই বিজয়ী করবেন বলে খালেকের প্রত্যাশা।

বিএনপির মেয়র প্রার্থী নজরুল ইসলাম মঞ্জু মনে করেন, ‘দুঃশাসনের হাত থেকে দেশকে রক্ষা করতে তরুণ প্রজন্ম দলীয় বিবেচনায় বিএনপিকেই ভোট দিয়ে নির্বাচিত করবে।’ বিএনপির সদ্য সাবেক মেয়র মনির কথা উল্লেখ করে মঞ্জু বলেন, সরকার তাঁকে পদে পদে বাধা দিয়েছে। উন্নয়ন বরাদ্দ দেয়নি। তারপরও তিনি বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থা ও আন্তর্জাতিক সংস্থার সহায়তা কাজ করেছেন। তালুকদার আবদুল খালেকের আমলেই খুলনায় বেশি উন্নয়ন হয়েছে—এমন তথ্যের সমালোচনা করে বলেন, ‘তাদের উন্নয়ন দেখতে হলে তাকাতে হবে মাটিতে, আর আমাদের উন্নয়ন দেখতে হলে দেখতে হবে আকাশে। শুধু রাস্তাঘাট করলে উন্নয়ন হয় না মন্তব্য করে মঞ্জু বলেন, একটি শহরকে বাসযোগ্য করতে গেলে আরও অনেক কাজ করতে হয়।