Thank you for trying Sticky AMP!!

খুলনা অঞ্চলে অঘোষিত পরিবহন ধর্মঘট চলছে

মেহেরপুরে টানা দুই দিন পরিবহন ধর্মঘট চলছে। পৌর বাস টার্মিনাল, মেহেরপুর, ১৯ নভেম্বর। ছবি: আবু সাঈদ

নতুন সড়ক পরিবহন আইন বাস্তবায়নের প্রতিবাদে খুলনা অঞ্চলের খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, যশোর, ঝিনাইদহ, চুয়াডাঙ্গা ও মেহেরপুরসহ আশপাশের জেলায় আজ মঙ্গলবারও পরিবহন শ্রমিক এবং চালকদের অঘোষিত ধর্মঘট চলছে। এতে দুর্ভোগে পড়েছেন যাত্রীরা।

এই সুযোগে ইঞ্জিনচালিত স্থানীয় যান মাহেন্দ্র, মিনি পিকআপ, মাইক্রোবাসসহ ছোট গাড়িগুলো কয়েকগুণ ভাড়া বাড়িয়ে দিয়েছে। এসব যানে ঝুঁকি নিয়ে যাত্রীরা গন্তব্যে যাচ্ছেন।

খুলনা: সকালে খুলনা থেকে কোনো সড়কপথে গাড়ি ছেড়ে যায়নি। চালক ও মালিকদের ‘কর্মবিরতিতে’ বাস চলাচল বন্ধ থাকায় বিপাকে পড়েছেন হাজার হাজার মানুষ। গতকাল সোমবার শুধু অভ্যন্তরীণ রুটে গাড়ি চলাচল বন্ধ ছিল। সকালে খুলনার অভ্যন্তরীণ ও দূরপাল্লার কোনো যানবাহন চলাচল করেনি।

কয়েকজন শ্রমিক নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, যশোর, ঝিনাইদহসহ আশপাশের প্রায় সব জেলাতেই অভ্যন্তরীণ সড়কপথে বাস চলাচল বন্ধ রয়েছে। আর শ্রমিকদের বাধার মুখে ঢাকাগামী পরিবহন চলাচল বন্ধ করে দিয়েছেন।

খুলনা আঞ্চলিক শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক আবদুর রহিম বকস বলেন, প্রথম দিন শুধু খুলনা আর যশোরের শ্রমিক ও মালিকেরা বাস চলাচল বন্ধ রাখলেও দ্বিতীয় দিনে খুলনা ও এর আশপাশের সব জেলাতেই বাস চলাচল বন্ধ রয়েছে। গাড়ি ও চালকদের কাগজপত্র হালনাগাদ না থাকায় মালিক ও চালকেরা স্বেচ্ছায় গাড়ি চালানো বন্ধ রেখেছেন। বর্তমানে স্বল্প পরিসরে ট্রাক চলাচল করলেও এমন পরিস্থিতিতে কাল বুধবার থেকে চালকেরা ট্রাক না চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

আন্দোলনরত কয়েকজন চালক বলেন, নতুন আইনে দুর্ঘটনার জন্য চালকদেরই দায় নিতে হচ্ছে। পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানা দিতে হবে। চালকেরা কাউকে ইচ্ছা করে হত্যা করেন না। এরপরও তাঁদের শাস্তি হবে। এ আইন মেনে নেওয়া যায় না। যার প্রতিবাদে এ কর্মবিরতি।

সকালে খুলনা মহানগরীর সোনাডাঙ্গা বাস টার্মিনাল ও রয়্যালের মোড়ে বাসগুলো সারি সারি দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে। যাত্রীরা এসে বাস চলাচল সম্পর্কে খোঁজখবর নিচ্ছেন। কিন্তু বাস চলাচল কখন শুরু হবে, কেউ তা বলতে পারছেন না।

সাতক্ষীরা: কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনালে সকাল থেকে কোনো বাস ছেড়ে যায়নি। বন্ধ রয়েছে অভ্যন্তরীণ সড়কপথে সব বাস চলাচলের পাশাপাশি ঢাকাগামী পরিবহন (যাত্রীবাহী বাস)।

যাত্রীবাহী বাস বন্ধ থাকলেও ২-১টি বিআরটিসি বাস চলাচল করতে দেখা গেছে। বাস চলাচল বন্ধ থাকায় বিপাকে পড়েছেন দূর-দূরান্তের যাত্রীরা। ইজিবাইক, মাহেন্দ্র, ভ্যানসহ বিভিন্ন যানবাহনে যাতায়াত করছেন যাত্রীরা।

ঢাকায় শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষায় অংশ নিতে যাবেন সাতক্ষীরা শহরের আবদুল রহমান, শরিফুল ইসলামসহ আরও অনেকে। তাঁরা জানান, গতকালও সাতক্ষীরা থেকে ঢাকাগামী যাত্রীবাহী বাস চলাচল করেনি। আজ সকালে ঢাকা বাস টার্মিনালে গিয়ে শোনেন কোনো বাসা ছাড়বে না। ফলে তাঁরা বিপাকে পড়েছেন।

খুলনায় চিকিৎসা নিতে যাবেন দেবহাটা উপজেলার কুড়া গ্রামের আমিনা বিলকিস। মহেন্দ্রতে চড়ে সাতক্ষীরা পর্যন্ত এসেছেন। কিন্তু সাতক্ষীরা থেকে আর খুলনা যেতে না পেরে বাস টার্মিনালে বসে রয়েছেন। অথচ গতকালই তাঁর চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়ার কথা ছিল।

বাসচালক কবীর হোসেন ও লৎফর রহমান জানান, নতুন আইন সংশোধন না হলে তাঁরা বাস চালাবেন না। আইনে চালকদের একতরফাভাবে শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে। যে জরিমানার বিধান করা হয়েছে, তা গরিব একজন চালকের পক্ষে কখনো পরিশোধ করা সম্ভব না।

সাতক্ষীরা বাস টার্মিনাল মোটর শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি আমজাদ আলী জানান, নতুন আইন সংশোধন না হওয়া পর্যন্ত কোনো শ্রমিক বাস চালাতে চান না। কেন্দ্রীয় শ্রমিক ফেডারেশন থেকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। চিঠিতে ধর্মঘটের কথা উল্লেখ নেই। তবে মৌখিক নির্দেশনায় শ্রমিকেরা বাস চালানো বন্ধ রেখেছেন। তিনি দাবি করেন বাস মালিক সমিতি বা শ্রমিক ইউনিয়ন ধর্মঘট করার জন্য বলেনি। সাধারণ শ্রমিকেরা বাস চালাচ্ছেন না। তাঁরা তাঁদের কথা শুনছেন না। ২১ ও ২২ নভেম্বর শ্রমিকদের নিয়ে কেন্দ্রীয় শ্রমিক ফেডারেশন মতবিনিময় করে সরকারের কাছে দাবি পেশ করবে।

সাতক্ষীরা বাস টার্মিনাল মোটর শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক জাহিদুর রহমান জানান, সাতক্ষীরার অভ্যন্তরীণ রুটগুলোতে বাস চলাচল স্বাভাবিক করার চেষ্টা চালানো হলে সাধারণ শ্রমিকেরা বাস চালাবে না বলে জানিয়ে দিয়েছেন।

সাতক্ষীরা বাস–মিনিবাস মালিক সমিতির সাবেক সভাপতি সাইফুল করিম বলেন, শ্রমিকেরা স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে ধর্মঘটে লিপ্ত হয়েছেন। তাঁরা নতুন আইনের আতঙ্কে বাস চালাতে চান না। নতুন আইনে দুর্ঘটনা ঘটলে একতরফাভাবে বাসচালক ও শ্রমিকদের কঠোর ব্যবস্থার বিধান করা হয়েছে। এটা তাঁরা মানছেন না। সরকারের কাছ থেকে আইন সংশোধনের আশ্বাস পেলে শ্রমিকেরা সড়কে ফিরে যাবেন।

চুয়াডাঙ্গা: আজ পরিবহন শ্রমিকেরা দ্বিতীয় দিনের মতো কর্মবিরতি পালন করছেন। ফলে অভ্যন্তরীণ ও দূরপাল্লার সব ধরনের যাত্রীবাহী বাস ও পণ্যবাহী ট্রাক চলাচল বন্ধ রয়েছে। এতে যাত্রী ও ব্যবসায়ীরা বিপাকে পড়েছেন।

অভ্যন্তরীণ পথে বাস না পেয়ে অনেকে ইজিবাইক ও অবৈধ যানবাহনে চলাচল করছে। চুয়াডাঙ্গা জেলা বাস-ট্রাক সড়ক পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি এম জেনারেল ইসলাম দাবি করেন, শ্রমিক ইউনিয়ন কোনো ধর্মঘট ডাকেনি। পরিবহন শ্রমিকদের কর্মবিরতির কারণে যানবাহন চলাচল বন্ধ রয়েছে ।

মেহেরপুর: রাজ্জাক শেখ গাংনী উপজেলার কসবা ভাটপাড়ার বাসিন্দা। তাঁর মেয়ে নবজাতক সন্তানকে নিয়ে দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলেন সদরের টিএনটি ট্রাফিক মোড়ে। বিরক্তি নিয়ে তিনি বলেন, বাস বন্ধ থাকায় বিকল্প কিছু খুঁজে পাচ্ছেন না। দু-একটি ইজিবাইক চলছে তাতে ভাড়া অনেক।

কয়েকজন শ্রমিকনেতা বলেন, নতুন সড়ক পরিবহন আইনটি শ্রমিকবন্ধব হয়নি। এই আইনে বাস–ট্রাকের চালকেরা পরিবহন চালাতে প্রচণ্ড ভয় পাচ্ছেন। কয়েকটি ধারা সংশোধন করার দাবিও তুলেছেন তাঁরা। তা না হলে পরিবহন ধর্মঘট চলতে থাকবে।

সরেজমিনে পৌর বাস টার্মিনালে দেখা যায়, সারি সারি বাস দাঁড়িয়ে রয়েছে। বাসের সহকারী ও চালকেরা নেই টার্মিনালে। কয়েকটি চায়ের দোকানে ক্যারমবোর্ড খেলছিলেন ট্রাক মেরামত করা শ্রমিকেরা। তাঁরা জানান, গতকাল বাস চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর আজ মঙ্গলবার বাস ও ট্রাকের চালক সহকারী কেউই আসেননি।

পরিবহন চালক মনোয়ার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, নতুন পরিবহন আইন করে সড়কে শৃঙ্খলা ও দুর্ঘটনারোধ করা সম্ভব হবে না। সড়ক প্রশস্ত ও সড়কে চলাচলের জন্য সাধারণ মানুষকে সচেতন করতে হবে। আন্তজেলাসহ দেশের প্রতিটি সড়কে ছাগল, গরু, ধানমাড়াই, নির্মাণসামগ্রী রাখাসহ নানা ধরনের উপকরণ সব সময় থাকে। মোটরসাইকেল চালক, ইজিবাইকচালকেরা বেপরোয়াভাবে চলাচল করেন। তাঁদের ব্যাপারে দেশের আইন শিথিল, শুধু পরিবহন চালকদের জন্য নতুন আইনটি ভয়ংকর।

বাস মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক গোলাম রসুল বলেন, শ্রমিকেরা ধর্মঘট পালন করছেন। যদি শ্রমিকেরা পরিবহন না চালান তাহলে তো সমস্যা অনেক। যেসব মালিক ঋণ করে পরিবহন কিনেছেন, তাঁদের জন্য চরম বিপদ। শ্রমিকনেতাদের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক চলছে। তবে এখনো শ্রমিকেরা তাঁদের দাবি থেকে সরে আসেননি।

যশোর: নতুন আইন সংশোধনসহ ১০ দফা দাবিতে গত রোববার সকাল থেকে শ্রমিকদের টানা কর্মবিরতি চালছে। আজও যশোরের স্থানীয় সব সড়ক-মহাসড়কে বাস চলাচল বন্ধ রয়েছে। যে কারণে গন্তব্যে পৌঁছাতে মানুষকে চরম দুর্ভোগেও শিকার হতে হচ্ছে।

সকাল আটটায় শহরের খাজুরা বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে দেখা যায়, ঢাকাগামী যাত্রীবাহী বাস চলাচল করলেও যশোর-মাগুরা সড়কে কোনো বাস চলাচল করছে না। নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছানোর জন্য মানুষকে বিকল্প বাহন হিসেবে ধীরগতির তিন চাকার ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক ও সিঅ্যান্ডজি আটোর নির্ভর করতে হচ্ছে।

কবির হোসেন নামের একজন যাত্রী বলেন, ‘আমি যশোর শহর থেকে মনোহরপুর বাজারে যাব। বাসে ভাড়া নেয় ৫ টাকা। কিন্তু ইজিবাইকে ২০ টাকা দিয়ে যেতে হবে। সময়ও নষ্ট হচ্ছে।’

কবিরের মতো সবাইকে প্রায় দ্বিগুণ ভাড়া দিয়ে বিকল্প যানবাহনে চড়ে নির্দিষ্ট গন্তব্যে যেতে হচ্ছে।

জানতে চাইলে যশোর জেলা পরিবহন সংস্থা শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি মামুনুর রশীদ বলেন, ‘কর্মবিরতি আমাদের শ্রমিক ইউনিয়ন বা মালিক সমিতির পূর্বঘোষিত কোনো কর্মসূচি নয়। চালকদের অনেকের লাইসেন্স নেই, গাড়িরও রুট পারমিট নেই। যে কারণে তাঁরা ভয়ে গাড়ি চালাতে চাচ্ছেন না। কেউ বাস চালালে আমাদের কোনো আপত্তি নেই।’

গতকাল সন্ধ্যায় সমস্যা সমাধানে জেলা প্রশাসকের সঙ্গে পরিবহন মালিক ও শ্রমিকদের ১৫টি সংগঠনের নেতারা আলোচনায় বসেন। এ সময় কর্মবিরতি না করে বাস চলাচল স্বাভাবিক রাখার জন্য জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শফিউল আরিফ আহ্বান জানান।

ওই বৈঠকে থাকা যশোর জেলা পরিবহন সংস্থা শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি মামুনুর রশীদ বলেন, জেলা প্রশাসকের আহ্বানে সাড়া দিয়ে শ্রমিকদের নয়টি ও মালিকদের সাতটি সংগঠনের বৈঠক ডাকা হয়েছে।

শ্রমিকেরা জানান, গত ১৪ নভেম্বর যশোরে সমাবেশ থেকে সড়ক আইন ২০১৮ সংশোধনসহ ১০ দফা দাবি করা হয়েছে। এরপর গত রোববার বেলা ১১টা থেকে যশোর-নড়াইল, যশোর-খুলনা, যশোর কেশবপুর, যশোর-চৌগাছা, যশোর-নাভারণ-সাতক্ষীরা, যশোর-রাজগঞ্জ, যশোর-ঝিনাইদহ, যশোর-মাগুরাসহ স্থানীয় বিভিন্ন সড়কে বাস চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।

(প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন নিজস্ব প্রতিবেদক, খুলনা ও সাতক্ষীরা এবং প্রতিনিধি, চুয়াডাঙ্গা ও মেহেরপুর)