খুলনা সিটি নির্বাচনে শেষ মুহূর্তে ভোটের হিসাব
>
- খুলনা সিটি নির্বাচন
- গুরুত্বপূর্ণ ৯টি ভোটব্যাংক।
- ফল নির্ধারণে নিয়ামক হতে পারে নতুন ভোটার ও বস্তিবাসী।
কাল বাদে পরশু খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচন। শুরু হয়েছে ভোটের নানা হিসাব-নিকাশ। দলীয় বিবেচনা বা নৌকা-ধানের শীষ প্রতীক প্রধান বিষয় হয়ে উঠলেও ভোটের হিসাবে অন্তত ৯টি ‘ভোটব্যাংক’ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
নির্বাচন-বিশ্লেষকেরা বলছেন, নতুন ৫৩ হাজার ভোটার এবং ১ লাখ বস্তিবাসী ভোটের ফল নির্ধারণে নিয়ামক হয়ে উঠতে পারে। এর বাইরে বাকি ভোটব্যাংকগুলো যেমন সংখ্যালঘু ভোট, জামায়াত, হেফাজতে ইসলাম, বিহারি, শ্রমজীবী বস্তিবাসী, পাটকলের শ্রমিক ও আঞ্চলিক ভোট কোনটি কোন দিকে, সেটার একটা ধারণা পাওয়া যায়।
খুলনা সিটিতে এখন মোট ভোটার ৪ লাখ ৯৩ হাজার ৯৩ জন। এর মধ্যে ৪০ শতাংশই এসব ভোটব্যাংকের হিসাবে পড়েছে। এর আগে ২০১৩ সালের সিটি নির্বাচনে ভোটার ছিল ৪ লাখ ৪০ হাজার। ওই নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী মনিরুজ্জামানের কাছে ৬০ হাজার ভোটের ব্যবধানে হেরে যান আওয়ামী লীগের প্রার্থী তালুকদার আবদুল খালেক।
খুলনা সিটিতে মোট ভোটের ২০ শতাংশ সংখ্যালঘু ভোট বলে ধারণা করা হয়। গত সিটি নির্বাচনে এদের একটা অংশ আওয়ামী লীগ-সমর্থিত মেয়র প্রার্থী তালুকদার আবদুল খালেককে ভোট দেয়নি বলে প্রচার আছে। তবে এবারের প্রেক্ষাপট ভিন্ন। সরকারি দলের প্রার্থীর ‘উন্নয়নের ধারাবাহিকতার’ যে প্রচার, সেটা যেমন গুরুত্ব পাচ্ছে, তেমনি আগামী জাতীয় নির্বাচনে এই নির্বাচনের প্রভাবের কথাও সামনে আসছে।
যদিও হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের খুলনা মহানগরের সভাপতি বীরেন্দ্র নাথ ঘোষ প্রথম আলোকে বলেন, ‘এবার আমরা প্রার্থীদের সঙ্গে কোনো মতবিনিময় সভার আয়োজন করিনি। ঐক্য পরিষদের পক্ষ থেকেও কারও পক্ষে ভোট চাওয়া হচ্ছে না। যার যাকে খুশি ভোট দেবে।’ খুলনা শহরে সংখ্যালঘুদের ভোট প্রায় ৮৭ হাজার বলে জানান তিনি।
বীরেন্দ্র নাথ ঘোষ নিজে ২৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর পদপ্রার্থী। তিনি নগর আওয়ামী লীগের স্বাস্থ্য ও জনসংখ্যাবিষয়ক সম্পাদক। কিন্তু দলের সমর্থন পাননি।
সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের পরই এখানে বড় ভোটব্যাংক জামায়াতে ইসলামীর। দলটির খুলনা মহানগর কমিটির সহকারী সেক্রেটারি মো. শাহ আলমের দাবি, এই শহরে এবার তাঁদের ভোটার আছে ৭০ থেকে ৭৫ হাজার। তাঁরা ২০-দলীয় জোটের প্রার্থী হিসেবে বিএনপির প্রার্থীকে পূর্ণ সমর্থন দিচ্ছেন। তবে ভোটকেন্দ্রে যেতে পারবেন কি না, শঙ্কা আছে। যেতে পারলে ধানের শীষেই ভোট দেবেন তাঁরা। অবশ্য এখানকার রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, জামায়াতের ভোট এত বেশি হবে না। বড়জোর ৪০ হাজার হতে পারে।
হেফাজতে ইসলাম প্রকাশ্যে কাউকে সমর্থন বা সংগঠনের ব্যানারে কারও পক্ষে না নামলেও তারা ভেতরে-ভেতরে সক্রিয়। হেফাজতের সঙ্গে যুক্ত যেসব ধর্মভিত্তিক দল বিএনপি জোটে আছে, তারা বিএনপির প্রার্থীর সঙ্গেই আছে। এখানকার হেফাজতের গুরুত্বপূর্ণ একজন নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, তাঁরা প্রকাশ্যে নেই। তবে ভোট দেবেন। খুলনায় ছোট-বড় ৭০-৮০টি মাদ্রাসা আছে। ভোট আছে প্রায় ৩০ হাজার।
এখানে বিহারিদের একটি জনগোষ্ঠী আছে। তারা ঐতিহাসিকভাবে আওয়ামী লীগবিরোধী। তাদের ভোটার সংখ্যা ৬-৭ হাজার হবে বলে জানা গেছে।
আঞ্চলিক ভোটার, অর্থাৎ অন্য জেলা থেকে যাঁরা এখানে এসে স্থায়ী হয়েছেন, তাঁদের মধ্যে বরিশাল, ফরিদপুর, মাদারীপুর, গোপালগঞ্জ, নড়াইল, নোয়াখালী উল্লেখযোগ্য। এসব ভোটারের মনোযোগ কাড়তে দুই দলই ওই সব জেলার নেতাদের দিয়ে জনসংযোগ করেছেন। আঞ্চলিক ভোটারদের বড় অংশ আওয়ামী লীগের দিকে আছে বলে মনে করা হয়। পাটকল শ্রমিকেরাও একটা ভোটব্যাংক। তাঁরা অনেকে বিভিন্ন দাবিতে অনেক দিন ধরে আন্দোলনে আছেন। তাঁদের সমস্যা সমাধানের আশ্বাস দিয়েছেন সরকারি দলের প্রার্থী তালুকদার আবদুল খালেক। তবে এই ভোট ভাগাভাগি হবে বলে ধারণা। নগরীতে শ্রমজীবী বস্তিবাসীর ভোট প্রায় ১ লাখ। এই ভোট নিয়ে কারও পরিষ্কার ধারণা নেই।
সদর থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. সাইফুল ইসলামের মতে, বস্তিবাসী শ্রমজীবীদের অনেক উপার্জন এখন। একজন রিকশাচালক দৈনিক পাঁচ শ, হাজার টাকা উপার্জন করেন। তাঁরা ভেবেচিন্তে ভোট দেবেন।
বিএনপির মেয়র প্রার্থী নজরুল ইসলাম মঞ্জুও মনে করেন, বস্তিবাসীরা ভোট বিক্রি করবেন না। বস্তিবাসী রিকশাচালক, ইজিবাইকচালক, ফুটপাতের ব্যবসায়ীরা চাঁদাবাজিসহ নানাভাবে নিপীড়নের শিকার। তাঁরা এসবের বিপক্ষে ভোট দেবেন।
এর বাইরে গত পাঁচ বছরের আরও কিছু বিষয় আছে, যা প্রধান দুই দলের প্রার্থীর জন্য নেতিবাচক হয়ে আছে। যেমন গত পাঁচ বছর মেয়র ছিলেন বিএনপির মনিরুজ্জামান। তাঁর সময়ে তেমন উন্নয়ন হয়নি, যা এখন সরকারি দলের প্রার্থীরা সামনে আনছেন। যদিও মনিরুজ্জামান বলছেন, তিনি একটা বড় সময় মেয়র পদের বাইরে ছিলেন। সরকার দুই দফা মামলা দিয়ে তাঁকে পদ থেকে সরিয়ে রেখেছিল। এ ছাড়া তাঁর সময় সরকার উন্নয়ন বরাদ্দ সেভাবে দেয়নি। মনিরুজ্জামানের ব্যাখ্যা সত্ত্বেও ভোটের রাজনীতিতে তাঁর ব্যর্থতার দায় বিএনপির প্রার্থীকে বহন করতে হবে বলে মনে করছেন অনেকে।
একইভাবে গত ৯ বছরে এখানকার আওয়ামী লীগের কিছু নেতা ও সাংসদের দুষ্কর্ম, মাদকের বিস্তার, টেন্ডারবাজির প্রভাব তালুকদার খালেকের ঘাড়ে পড়তে পারে-এমন আলোচনাও মাঠে আছে।
দুই দলের পক্ষে-বিপক্ষে এসব ইস্যুর বাইরে নাগরিক সমাজে আলোচনায় শীর্ষে আছে নতুন ৫৩ হাজার ভোটার। এই তরুণদের মনোভাব বোঝার চেষ্টা করছে সব পক্ষ।
সদর থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও দলের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সদস্য মো. সাইফুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, আজকের বাংলাদেশ যেখানে পৌঁছেছে, মহাকাশে বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ হয়েছে, তরুণদের কাছে এসব অগ্রগতি ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। তার ওপর তরুণেরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করে, তারা আওয়ামী লীগের দিকেই থাকবে।
তরুণদের নিয়ে কাজ করেন, বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার এমন একজন ব্যাক্তির পর্যবেক্ষণ, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি একতরফা নির্বাচন, আওয়ামী লীগ সরকারের গত ৯ বছরের নানা সমালোচনা মেনে নিয়েই তরুণদের একটা বড় অংশ উন্নয়নের পক্ষে অবস্থান নেবে।
নজরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, তরুণেরা সম্ভাবনার দিকে তাকিয়ে ভোট দেবেন। তাঁরা উন্নয়ন, প্রগতি, আইনের শাসন, মৌলিক অধিকার, ভোটের অধিকার, গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার পক্ষে ভোট দেবেন বলে তাঁর বিশ্বাস।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) খুলনার সম্পাদক কুদরত-ই খুদার মতে, দুটি ভোটব্যাংক এই ভোটে জয়-পরাজয়ের নিয়ামক হিসেবে কাজ করবে। একটা হলো ৫৩ হাজার তরুণ ভোটার। তাঁরা জীবনে প্রথম ভোট দেবেন। তাই বুঝে-শুনে প্রার্থীদের অতীত-বর্তমান জেনে ভোট দেবেন। এরপর আছে বস্তিবাসী ভোট, যা মোট ভোটের প্রায় ২০ শতাংশ। এখানে প্রায় ১ হাজার ৩০০ বস্তি আছে, যার মধ্যে ৭০০ বড় বস্তি। অতীতে তাঁদের ভোট টাকায় কেনা হতো। এখন তাঁরা সচেতন। তাঁরাও হিসাব করে ভোট দেবেন।