Thank you for trying Sticky AMP!!

গল্প হলেও সত্যি

কয়েক দিন আগের ঘটনা। রাজধানীর শান্তিনগর থেকে মোহাম্মদপুর যাব। রাত বাজে প্রায় ১০টা। দুজন সহকর্মীকে নিয়ে উঠলাম সিএনজিচালিত একটি অটোরিকশায়। অটোরিকশার ভেতরটা একেবারে ঝকঝকে, পরিষ্কার। দুপাশের দরজার গ্রিলগুলো পর্যন্ত চকচক করছে। জিজ্ঞাসা করে জানলাম, গাড়িটা চালকের নিজস্ব। সহযাত্রীরা জানালেন, এই সময়টায় এখানে প্রায়ই দেখা মেলে এই চাচার। তাঁর পরনে লুঙ্গি, ফতুয়া। মুখে সফেদ দাড়ি। সব মিলিয়ে একজন পরিচ্ছন্ন চেহারার মানুষ।

যাত্রাপথে সহকর্মীদের সঙ্গে নানান বিষয় নিয়ে কথা বলছিলাম। কথা চলার একপর্যায়ে আমাদের জাতীয় জীবনের অন্যতম অর্জন মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গ উঠতেই অনেকটা স্বগতোক্তির মতো কী একটা মন্তব্য করলেন বর্ষীয়ান মানুষটি। কান খাড়া করলাম তিনজনই। প্রশ্ন করে জানলাম, তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। মুক্তিযোদ্ধা। সেনাবাহিনীতে সৈনিক পদে কর্মরত ছিলেন সে সময়। পাঁচ নম্বর সেক্টরে যোগ দেন।

এরপর আমাদের নানান কৌতূহলী প্রশ্নের শুরু। যানজট এড়িয়ে অটোরিকশা চালাতে চালাতে মোটামুটি নিরাসক্ত ভঙ্গিতে চাচা উত্তর দিয়ে যাচ্ছেন। কথা আর ড্রাইভিং, দুটোতেই তিনি একই রকম শান্ত ও ধীরস্থির। এদিকে তাঁর একেকটা কথা শুনে আমরা ঠিক ততটাই উত্তেজিত, অস্থির!

তারপর যা জানা গেল, তা সংক্ষেপে বলি। ওই অটোরিকশাচালকের জন্ম ১৯৩০ সালে, দক্ষিণবঙ্গের একটি গ্রামে। সে হিসাবে তাঁর বয়স এখন ৯০ বছর। যদিও দেখে মনে হয় বড়জোর ৬৫ থেকে ৭০ হবে। আমৃত্যু নিজে কাজ করে খাবেন আর পরিশ্রম করবেন, এই তাঁর মূলনীতি। যে কারণে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তাঁর ন্যায্য প্রাপ্য ভাতাটুকুও তিনি গ্রহণ করেন না। প্রতিদিন রাত নয়টা নাগাদ শান্তিনগরের কোয়ান্টাম স্বেচ্ছা রক্তদান কার্যক্রমের উদ্যোগে পরিচালিত কোয়ান্টাম ল্যাবের সামনে এসে দাঁড়ান। এখান থেকে শুরু। সারা রাত অটোরিকশা চালান। ভোরে ফজরের নামাজ শেষে বাড়ি ফিরে চার ঘণ্টার ঘুম। ‘তারপর? দিনে সিএনজি চালান না কেন?’ চাচা জানালেন, চালের আড়তের ব্যবসা আছে তাঁর, দিনের বেলা ওখানে সময় দেন। বাসার পাশেই তাঁর ভাইদের বাসা, ওখানে ভাইয়ের পুত্র-কন্যা ও নাতি-নাতনিদের সঙ্গে সময় কাটান। এর পাশাপাশি বাড়ির দেখাশোনা আর কিছু কাজকর্ম তো থাকেই। ‘বাড়ি’ শুনে জানতে চাইলাম, ‘আপনি কি কোনো বাড়িতে কেয়ারটেকারের কাজ করেন?’ এরপর চাচা যা শোনালেন, সেটা আরও বিস্ময়কর। বাড়ি তাঁর নিজের। বহু বছর আগে ঢাকায় কিছু জমি কিনে রেখেছিলেন, সেখানে বছর বিশেক আগে একটা পাঁচতলা বাড়ি করেছেন। একটা ফ্লোরে সস্ত্রীক নিজে থাকেন আর বাকি চারটা ফ্লোর ভাড়া দিয়েছেন। ভাড়াটেরাও তাঁকে ভালোবাসেন, তাঁর বাড়ি ছেড়ে যেতে চান না। একেকজন ১২ থেকে ১৫ বছর ধরে আছেন তাঁর বাড়িতে।

এখানেই শেষ নয়। ‘আপনার পরিবারে কে কে আছে আর? ছেলেময়ে কজন?’ এর উত্তর যা পেলাম, তাতে আমাদের সত্যিই চক্ষু চড়কগাছ হওয়ার দশা। তাঁর দুই ছেলেময়ে। মেয়ে বছর পাঁচেক আগে ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করে বর্তমানে চিকিৎসক স্বামীসহ থাকে নিউইয়র্কে। ছেলে বুয়েট থেকে পাস করে বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে সরকারি চাকরিতে যোগ দিয়েছিলেন, কিন্তু সেখানে ভালো লাগছিল না বলে এখন পিএইচডি করতে গেছেন জাপানে। ‘তো, আপনি সিএনজি চালান কেন? ছেলেমেয়েরা কিংবা চাচি কিছু বলে না আপনাকে?’ চাচা বললেন, ‘হ্যারা তো নিষেধ করেই, কিন্তু এই একটু পরিশ্রম না করলে যে আমার হাড়গোড় ম্যাজম্যাজ করে! শরীল বইস্যা যাইতে চায়। শরীলে শক্তি পাই না। কাজের মইদ্যে থাকলেই আমি ভালো থাকি, বাবা। আপনের চাচি একবার আমার এই সিএনজি ১৫ দিন গ্যারেজে বাইন্ধা তালা দিয়া রাখছিল। শ্যাষে তো আমি অসুস্থ হইয়া গ্যালাম। সেই থাইক্যা আর কিছু কয় না!’

চাচাকে বললাম, আপনার ছেলেমেয়ে উচ্চশিক্ষিত, টাকাপয়সারও কোনো অভাব নেই, তবু আপনি এই বয়সেও এভাবে দিন-রাত পরিশ্রম করেন। আপনার কি মনে হয় না যে এ কথাগুলো সবাইকে জানানো দরকার? তাতে বহু মানুষ বিশেষ করে তরুণেরা উদ্বুদ্ধ হবেন, অনুপ্রেরণা পাবে আপনার জীবন থেকে। এই প্রথমবারের মতো কিছুটা অসহিষ্ণু হতে দেখা গেল চাচাকে। কণ্ঠে জোর আপত্তি নিয়ে বললেন, ‘না...না...দরকার নাই, আমি কর্ম কইরা খাই, এইডা আমার ভালো লাগে। মাইনষেরে এই সব জানাইয়া কী অইব?’

মোহাম্মদপুর পৌঁছে গেছি। জিজ্ঞেস করলাম, ভাড়া কত দেব চাচা? ‘দেন, আপনার যা মন চায় দেন। দিলেও আর কত টেকা বেশি দেবেন? ঠকাইলেও আর কত ঠকাইবেন? লাভ-লোকসানের মালিক তো আল্লাহ!’ ভাড়া যা দিলাম মিটারের হিসাবে ঠিকই আছে, কিন্তু প্রচলিত ব্যবস্থায় অটোরিকশা চালকেরা যা সাধারণত দাবি করেন, তার চেয়ে কম। তিনি সেটাই ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বলে নিলেন বিনা বাক্যে। গাড়ি থেকে নেমে শেষ প্রশ্নটা করলাম, ‘আচ্ছা, এত জায়গা থাকতে আপনার বাসা থেকে এত দূরে গিয়ে কোয়ান্টামের সামনে দাঁড়ান কেন? একেবারেই নিস্পৃহ ভঙ্গিতে চাচার উত্তর, ‘ঢাকা মেডিকেল, মিটফোর্ড এসব সরকারি হাসপাতালে বহু গরিব রোগী আইসা ভর্তি হয় দেশের বিভিন্ন জায়গা থাইকা। তা গো আত্মীয়স্বজন ওইহানে আসে রোগীর লাইগা রক্ত নিতে। হ্যারা ভালোমতো পথঘাটও চিনে না ঢাকা শহরে। আমি হ্যাগোরে হাসপাতালে পৌঁছাইয়া দিই। পয়সা নিই না।’

*লেখক: চিকিৎসক