Thank you for trying Sticky AMP!!

চাঁপাতলায় শুধুই কান্না

খাবারের জন্য কাঁদছে শিশু বিপাশা বর্মণ। কাঁদছেন মা সঞ্চিতা বর্মণও। কারণ, ঘরে খাবার নেই। খাবার আসবে কোথা থেকে? ঘরই তো নেই! ঘরদোর, সহায়-সম্বল গেছে এমন ১২২টি সংখ্যালঘু পরিবারের। গত রোববার নির্বাচনের পর রাতে যশোরের অভয়নগর উপজেলার চাঁপাতলা গ্রামের মালোপাড়ায় বাড়িতে হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাট চালানো হয়। পুড়িয়ে দেওয়া হয় ১০টি বাড়ি। জামায়াত-শিবির এ নারকীয় হামলা চালিয়েছে বলে জানান স্থানীয় লোকজন । ছবি: এহসান-উদ-দৌলা

নৌকা থেকে নেমে পোঁটলা-পুঁটলি মাথায় ও কাঁধে নিয়ে বাড়ির দিকে হাঁটছে শতাধিক নারী-পুরুষ-শিশু। চোখে-মুখে আতঙ্ক। ভৈরব নদের তীরে দাঁড়ানো শত শত লোক তাদের স্বাগত জানাচ্ছেন। এ যেন শরণার্থী শিবির থেকে ঘরে ফেরা।
বাড়িতে ফিরেই নিজের সাজানো ঘরের বীভৎস চেহারা দেখে কান্নায় ভেঙে পড়লেন চন্দনা বিশ্বাস (৩৭)। তাঁর তিন মেয়ে, এক ছেলে। হামলাকারীরা পুড়িয়ে দিয়েছে তাঁর ঘরের আসবাব, লেপ-তোশক, বিছানা। জীবনধারণের একমাত্র অবলম্বন মাছ ধরার জালগুলোও অক্ষত নেই। করেছে লুটপাটও। আতঙ্কে স্তব্ধ চন্দনার স্বামী সঞ্জয় বিশ্বাস (৪০)। অজানা ভবিষ্যতের কথা ভেবে শঙ্কিত তাঁদের মতো শত শত নারী-পুরুষ-শিশু।
গত রোববার ভোট শেষ হওয়ার পর সন্ধ্যায় যশোরের অভয়নগর উপজেলার চাঁপাতলা গ্রামের মালোপাড়ায় তাণ্ডব চালায় দুর্বৃত্তরা। জ্বালিয়ে দেয় বসতবাড়ি। এরপর গ্রামের প্রায় সবাই ভৈরব নদের ওপারে দেয়াপাড়ায় আশ্রয় নেন। গতকাল তাঁরা নিজেদের বাড়িতে ফিরে আসেন।
কাল ওই গ্রামের সর্বত্র ছিল কান্নার রোল। খাওয়ার মতো কিছু ছিল না ঘরে। কী খাবেন, রাতে আবার সেই নারকীয় হামলা হবে কি না, সেই আতঙ্ক আর অনিশ্চয়তায় বিধ্বস্ত ঘরের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছে মানুষগুলো।
যশোর-৪ আসনের নবনির্বাচিত সাংসদ রণজিত রায়, জেলা প্রশাসক মোস্তাফিজুর রহমান ও পুলিশ সুপার জয়দেব ভদ্রসহ স্থানীয় জনপ্রতিনিধি এবং আওয়ামী লীগের নেতারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাৎক্ষণিকভাবে ২০০ কম্বল, দুই টন চাল ও নগদ এক লাখ টাকা দেওয়া হয়েছে।
ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, ঘটনার এক ঘণ্টা আগে বিষয়টি আঁচ করতে পেরে আওয়ামী লীগের নেতা ও স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনকে জানানো হলেও কেউ তাদের রক্ষায় এগিয়ে আসেনি।
ক্ষোভ ঝরে পড়ে বাসন্তী সরকারের (৪৫) কণ্ঠে, ‘আক্রান্ত হওয়ার পর সাহায্যের জন্য বারবার মোবাইলে আওয়ামী লীগ নেতাদের অনুরোধ করা হয়। কিন্তু তাঁরা এগিয়ে আসেননি। এখন এসে সবাই দরদ দেখাচ্ছেন।’
চাঁপাতলা গ্রামের এক প্রান্তে অবস্থিত নিম্নবর্গীয় হিন্দুদের ১১২টি পরিবার পুরুষ পরম্পরায় বসবাস করে আসছে। পেশায় মূলত মৎস্যজীবী এ পরিবারগুলোর সবাই হামলার শিকার হয়েছে। পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে ওই পাড়ার ১০টি বাড়ি। ১০২টি পরিবারের মাত্র দুটি ঘর ছাড়া সব ঘরেই ভাঙচুর ও লুটপাট চালানো হয়েছে। প্রায় দুই ঘণ্টা ধরে চালানো তাণ্ডবে কমপক্ষে ২০ জন আহত হয়েছে। গুরুতর আহত চারজন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
এলাকাবাসী ও স্থানীয় প্রশাসন বলছে, জামায়াত-শিবির এ তাণ্ডব চালিয়েছে। জামায়াত-শিবিরের স্থানীয় নেতাদের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করা হলেও তাঁদের পাওয়া যায়নি।
এলাকাবাসী বলেন, জামায়াত-শিবিরের তাণ্ডবে আতঙ্কিত হয়ে সাঁতরে নদ পাড়ি দিতে হয়েছিল তাঁদের অনেককেই। নদ পাড়ি দিয়ে দেয়াপাড়া গ্রামের পালপাড়া এলাকার পূজামণ্ডপে আশ্রয় নেন কালীদাসী সরকার। তিনি বলেন, ‘১৫ বছরের ছেলের হাত ধরে সাঁতরে নদী পাড়ি দিয়েছি। একে তো শীতকাল। তারপর সন্ধ্যা। মনে হচ্ছিল নদীর হিম পানিতে বুঝি ডুবে মারা যাব।’
নদ পাড়ি দিতে গিয়ে পরনের শাড়িটিও হারিয়েছেন মায়া রানী মণ্ডল। পরে দেয়াপাড়ার একজনের শাড়ি পরে বাড়ি ফিরেছেন। ২০ বছর আগে স্বামীকে হারিয়েছেন মায়া। তিনটি অনাথ মেয়েকে বড় করে বিয়ে দিয়েছেন। এখন একা থাকেন ছোট্ট একটি ঘরে। গতকাল বাড়ি ফিরে দেখেন তাঁর ঘরটি আর বসবাসের উপযোগী নেই।
মালোপাড়ার আতঙ্কিত মানুষকে সাহায্য করার জন্য দেয়াপাড়ার পালপাড়া থেকে নৌকা নিয়ে এগিয়ে এসেছিল কেউ কেউ। দেয়াপাড়ার সেই সব মানুষের একজন রবীন্দ্রনাথ ব্যানার্জি বলেন, ‘আমরা আসতে না পারলে নদে ডুবে মারা যেত ছোট বাচ্চারা। বাচ্চারা বাড়ি ফেরার কথা শুনে ভয়ে আতঙ্কে শিউরে উঠছে।’
তাণ্ডবের সময় গ্রাম ছেড়ে যায়নি নির্মল বর্মণের পরিবার। তাঁর পুত্রবধূ সঞ্চিতা বলেন, ‘আমিই শ্বশুর মশাইকে বলেছিলাম, বাবা আমরা কোথাও যাব না। মরলে সবাই একসঙ্গে মরব। কানবার যেন কেউ না থাকে।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চাঁপাতলার পাশের চেঙ্গুটিয়া ও বালিয়াডাঙ্গা গ্রাম দুটিতে জামায়াত-শিবিরের শক্তিশালী ঘাঁটি। অভয়নগর উপজেলা জামায়াতে ইসলামীর আমির আবদুল আজিজের গ্রামের বাড়ি বালিয়াডাঙ্গায়। এ দুটি গ্রামের জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা গত ২৮ ফেব্রুয়ারি দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ফাঁসির রায় ঘোষিত হওয়ার পর থেকে যশোর-খুলনা মহাসড়কের একটি বড় এলাকাজুড়ে নাশকতা চালিয়ে যাচ্ছেন।
ভোটের দুই দিন আগে শুক্রবার পানের বরজে আগুন দেওয়া হয় বলে জানান মালোপাড়ার বাসিন্দা সুনীল কুমার সরকার। বিষয়টি পুলিশকে জানানো হলে তারা একবার গ্রামে এসে দেখে গিয়েছিল। আতঙ্কিত গ্রামবাসী পুলিশ ক্যাম্প স্থাপনের দাবি জানিয়েছেন।
পুলিশ সুপার জয়দেব ভদ্র বলেন, মালোপাড়ায় একটি অস্থায়ী পুলিশ ক্যাম্প করা হয়েছে। যতক্ষণ পর্যন্ত ওই পাড়ার বাসিন্দারা নিরাপদ বোধ করবেন না, ততক্ষণ ক্যাম্পটি থাকবে।
অভয়নগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এমদাদুল হক বলেন, নির্বাচনী ব্যস্ততার জন্য মালোপাড়ার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়া যায়নি। নির্বাচনের পর এমন হামলা হবে, তা ধারণার মধ্যে ছিল না। তিনি বলেন, প্রাথমিক তদন্তে এ ঘটনার জন্য জামায়াত-শিবির দায়ী, এটা নিশ্চিত হওয়া গেছে। এরই মধ্যে অভিযুক্ত তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। পুলিশ ৩০ জনের নাম পেয়েছে।