Thank you for trying Sticky AMP!!

চুনোপুঁটি নয়, রাঘববোয়াল ধরুন

চুনোপুঁটি নয়, বড় বড় রাঘববোয়াল ধরতে হবে। দুদককে দেখাতে হবে দৃষ্টান্ত স্থাপন করার মতো কাজ। রাজনৈতিক চাপের কাছে নতিস্বীকার করলে দুর্নীতি দমন সম্ভব হবে না। দুর্নীতির কারণে রাষ্ট্র ব্যর্থ হতে চলেছে। দুর্নীতি বন্ধ করতে হলে রাজনৈতিক সহযোগিতা প্রয়োজন।

দেশের জাতীয় দৈনিক পত্রিকার সম্পাদক ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার প্রধানদের সঙ্গে দুদকের এক মতিবিনিময় সভায় সাংবাদিকেরা এ আহ্বান জানান। আজ সোমবার দুদকের প্রধান কার্যালয়ে ‘কমিশনের কৌশলপত্র ২০১৯’ নিয়ে এ মতবিনিময় সভার আয়োজন করা হয়।

মতবিনিময় সভায় ১৪ জন জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক তাঁদের অভিমত তুলে ধরেন। সভায় সভাপতিত্ব করেন দুদকের চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ। মতবিনিময় অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন সিনিয়র সাংবাদিক মনজুরুল আহসান বুলবুল। সাংবাদিকেরা বলেন, ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান- মেম্বারদের একটা পাকা বাড়ি দেখে তার পেছনে না দৌড়ে যাঁরা দেশের বাইরে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার করছেন তাঁদের পেছনে ছুটতে হবে। রাষ্ট্রের বড় দুর্নীতিবাজদের না ধরলে দুদক সম্পর্কে মানুষের মনে আস্থা আসবে না।

সভায় সভাপতির বক্তব্যে দুদকের চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ বলেন, ‘আসুন আমরা সবাই মিলে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সম্মিলিতভাবে কাজ করি। সুনির্দিষ্টভাবে কার্যপদ্ধতি চালু করি এবং সেভাবে কাজ করি। আপনারা আমাদের সহায়তা করুন।’ তিনি বলেন, দেশে এখনো দুর্নীতির সংজ্ঞা নির্ধারিত না হলেও দুদক অবৈধ সম্পদ অর্জনকে এ সংজ্ঞার আওতায় এনে কাজ করছে।

মতবিনিময় সভায় যুগান্তর-এর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সাইফুল আলম বলেন, দুদক দেশের সর্বত্র কাজ করতে সক্ষম। তবে দুদককে বিড়াল মারার চেয়ে বাঘ সিংহ-মারার দিকে নজর দিতে হবে। রাষ্ট্রীয় দুর্নীতিবাজদের ধরতে হবে। ঋণ অবলোপন ও সুদ মওকুফের দুর্নীতি বন্ধ করতে হবে। তিনি গণমাধ্যমে প্রকাশিত দুর্নীতির রিপোর্ট নিয়ে তদন্ত করে দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য দুদকের প্রতি অনুরোধ জানান।
সাইফুল আলম বলেন, ‘আমি মনে করি জনগণের চাহিদা অনুযায়ী প্রয়োজনে নতুন করে দুদককে ভাবতে হবে। এর জন্য যদি দুদক আইনেও সংশোধনী আনতে হয়, তা করতে হবে। দুদকের কিছু কাজ নিয়ে বাইরে কেউ কেউ সমালোচনা করে থাকেন। যাঁরা বলেন এটা দুদকের কাজ নয়, তাঁদের গোপন অভিলাষ রয়েছে।’ তিনি দুর্নীতিবিরোধী প্রচারের কাজে মসজিদের ইমামদের সম্পৃক্ত করা যেতে পারে বলেও উল্লেখ করেন।
‘বাংলাদেশ প্রতিদিন’-এর সম্পাদক নঈম নিজাম বলেন, মেডিকেল বা জাহালমের মতো ঘটনা ঘটলে আমরা উদ্বিগ্ন হই। বিমান ও ব্যাংকিং খাতে দুর্নীতি বন্ধ করতে হবে। উপজেলায় ডাক্তার না থাকলে সিভিল সার্জনকে জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। প্রযুক্তির ব্যবহারে দুদককে আরও শক্তিশালী হতে হবে। দুদক কর্মকর্তাদের আরও বেশি বেশি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।

সারা বাংলাডট.নেট ও গাজী টিভির প্রধান সম্পাদক সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা বলেন, দুর্নীতির কারণে রাষ্ট্র ব্যর্থ হতে চলেছে। দুর্নীতি বন্ধ করতে হলে শক্তিশালী রাজনৈতিক সহযোগিতা প্রয়োজন। সেটা দুদক পাচ্ছে কি না? সরকারি কর্মকর্তাদের বেতন বাড়ার আগে এবং পরের দুর্নীতির কোনো চিত্র আছে কি না? আমার মনে হয় বড়দের ধরতে না পারলে ছোট মশা-মাছি ধরে দুদকের ভাবমূর্তির বড় কোনো পরিবর্তন হবে না।

ইশতিয়াক রেজা বলেন, দুদক সম্পর্কে ধারণা হচ্ছে, ‘দুদক অনেক কাজ করছে সেটা মধ্যম ও ছোট পর্যায়ের। কিন্তু বড়দের ধরছে না। আমি শতভাগ আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলতে পারি, বাংলাদেশে ১৭ কোটি মানুষের দেশে কেউ বলবে না সরকারি প্রতিষ্ঠানে গিয়ে ঠিকমতো সেবা পেয়েছেন। হয়তো তাঁকে পয়সা দিতে হয়েছে, নয়তো তাঁকে অন্য কোনো কানেকশনের ব্যবস্থা করতে হয়েছে বা অর্থ দিতে হয়েছে। ফলে এই বাস্তবতার মধ্যে আমি মনে করি না দুদকের কাছে বিরাট প্রত্যাশা করে ফেলব। তবে একটা-দুইটা বড় দৃষ্টান্ত করে ফেলতে পারলে হয়তোবা মানুষের আবার আস্থা ফিরে আসবে।’

‘ভোরের কাগজ’-এর সম্পাদক শ্যামল দত্ত বলেন, রাষ্ট্রের মধ্য থেকে পদ্ধতির পরিবর্তন না হলে দুর্নীতি বন্ধ করা সম্ভব নয়। বড় দুর্নীতিবাজেরা পার পেয়ে যাচ্ছে। এ জন্য দুদকের কার্যক্রম সাধারণ মানুষ সিরিয়াসলি নিচ্ছে না। কিন্তু একটি বিষয়, সরকারি কর্মকর্তাদের বেতন বেড়েছে তবে দুর্নীতি কি কমেছে? জাহালমের বিষয়ে দুদক তার দায় এড়াতে পারে না। এতে করে দুদকের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়েছে।

একাত্তর টেলিভিশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান সম্পাদক মোজাম্মেল বাবু বলেন, শিক্ষা খাতের স্বচ্ছতা ফিরিয়ে আনতে হবে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ছোট কর্মকর্তাদের শুধু ধরলে হবে না বড়দেরও ধরতে হবে। উপজেলায় চিকিৎসক থাকেন না কিন্তু কেন থাকেন না, সেটার কারণ উদঘাটন করতে হবে। বেশি বেশি দুদকের গণশুনানি করতে হবে। দুদকের কাজ দুর্নীতি দমন করা। ভূমি ও বিদ্যুৎ, বিচার খাতে দুর্নীতি সীমাহীন। দুদককে সে জন্য এই খাতগুলোতেও আরও বেশি কাজ করতে হবে।

বিটিভির মহাপরিচালক হারুন-অর-রশীদ বলেন, ছোট ছোট দুর্নীতি থেকেই বড় বড় দুর্নীতির জন্ম দেয়। তাই ছোট দুর্নীতি প্রথমে রুখতে না পারলে বড় দুর্নীতি রোখা যায় না। মাত্রাতিরিক্ত ভোগ ও অপ্রয়োজনীয় খরচ দুর্নীতির দিকে ধাবিত করে। সরকারি সব কর্মকর্তার সম্পদের হিসাব দুদকের রাখা উচিত। তবে দুর্নীতি রোধ করা না গেলে দেশের উন্নতির সম্ভব নয়।

মতবিনিময় সভায় দুদকের চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ বলেন, বিগত তিন বছরে কমপক্ষে ১২০ জন ব্যাংক কর্মকর্তা-কর্মচারীকে আইন আমলে আনার জন্য গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এই তালিকায় ব্যাংকের চেয়ারম্যান, ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ অনেক উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তারাও ছিলেন। তিনি বলেন, বিগত তিন বছরে ৬ থেকে ৭ হাজার কোটি নগদ টাকা দুদকের কারণেই বিভিন্ন ব্যাংকে জমা হয়েছে। বেতন বাড়ানোর সঙ্গে দুর্নীতির বিষয়টি সম্পৃক্ত হতে পারে, তবে খুব বেশি সম্পৃক্ত নয় জানিয়ে দুদক চেয়ারম্যান বলেন, বিদ্যমান দুর্নীতির মূলে রয়েছে লোভ, অভাবের কারণে এখন খুব বেশি একটা দুর্নীতি হয় না। হুন্ডির মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার করা যায় না, জানিয়ে দুদক চেয়ারম্যান বলেন, ‘দেশের সিংহভাগ অর্থ পাচার হয়ে থাকে ওভার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে ব্যাংকিং চ্যানেলে। আমরা রাজস্ব বোর্ডের কাছে ওভার ইনভয়েসিংয়ের এক মাসের তালিকা চেয়েছি। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, আমরা আজ পর্যন্ত এই তালিকা পাইনি। এই তালিকা পেলে প্রয়োজনে তালিকা ধরে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

২০১৮ সালের কমিশনের কার্যক্রম নিয়ে এক মন্তব্যের জবাবে দুদক চেয়ারম্যান বলেন, কৌশলগত কারণেই ওই বছর কমিশনের কার্যক্রম কিছুটা স্তিমিত ছিল।

নিরীহ জাহালম প্রসঙ্গে দুদক চেয়ারম্যান বলেন, ‘বিষয়টি যেহেতু উচ্চ আদালতে বিচারাধীন তাই এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করা সমীচীন হবে না। তবে সালেকের জায়গায় কীভাবে জাহালম আসামি হলেন, এ বিষয়ে কমিশন অভ্যন্তরীণভাবে জেলা জজ পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তার মাধ্যমে তদন্ত করছে। এই রিপোর্ট পেলেই সবকিছু জানা যাবে। আমি প্রতিষ্ঠানপ্রধান হিসেবে ঘটনার জন্য গণমাধ্যমের মাধ্যমে দুঃখ প্রকাশ করেছি। এমনকি আমি বলেছি আমরা লজ্জিত।’

দুদক চেয়ারম্যান বলেন, ব্যাংকের দুর্নীতি নিয়ে অশেষ আলোচনা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় দায়িত্ব বাংলাদেশ ব্যাংকের। তারা যদি সময়মতো নিরীক্ষা ও পরিদর্শন কার্যক্রম সম্পন্ন করে, তাহলে অনেক ক্ষেত্রেই দুর্নীতি অনিয়ম প্রতিরোধ করা সম্ভব।