Thank you for trying Sticky AMP!!

‘ছাত্ররা নিজেরা ফাঁকি দিলেও ফাঁকিবাজ শিক্ষক পছন্দ করে না’

আইপিডিসি-প্রথম আলো প্রিয় শিক্ষক সম্মাননা ২০২০ অনুষ্ঠানের শুরুতে জাতীয় সংগীতের সময় উপস্থিত সবাই দাঁড়িয়ে সম্মান জানান। আজ বিকেলে রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলে

মানুষের জীবনে মা–বাবার পরে যাঁদের অবদান সবচেয়ে বেশি, তাঁরা হলেন শিক্ষক। বিশেষ করে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষকেরা একজন মানুষের জীবনে শিক্ষা ও নৈতিকতার যে ভিতটা গড়ে করে দেন, সেটাই সারা জীবন গেঁথে থাকে। তাই তো শিক্ষকের কথা উঠলেই বেশির ভাগ মানুষ তাঁর শৈশবের শিক্ষকদের কথাই উল্লেখ ধরেন। কারণ, এসব শিক্ষকের আদর-শাসনেই বেশির ভাগ মানুষ পথচলার অনুপ্রেরণা পান। এ জন্যই এসব শিক্ষক হয়ে ওঠেন পথচলার প্রেরণা।

মানুষ গড়ার কারিগর এমন নয়জন শিক্ষককে সম্মাননা জানিয়েছে আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইপিডিসি ও প্রথম আলো। শনিবার বিকেলে রাজধানীর একটি হোটেলে ‘আইপিডিসি-প্রথম আলো প্রিয় শিক্ষক সম্মাননা ২০২০’ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। সম্মাননা হিসেবে পরিয়ে দেওয়া হয় উত্তরীয়, দেওয়া হয় ক্রেস্ট, সনদ ও সম্মানী।

বক্তব্য দিচ্ছেন আইপিডিসি ফাইন্যান্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মমিনুল ইসলাম

সম্মাননা তুলে দেন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং স্কুল-কলেজের অধ্যক্ষেরা। অনুভূতি জানাতে গিয়ে সম্মাননা পাওয়া শিক্ষকেরা এই সম্মানকে তাঁদের জীবনে বড় পাওয়া হিসেবে উল্লেখ করেন। করোনাভাইরাসের কারণে স্বাস্থ্যবিধি মেনে সীমিত পরিসরে আয়োজন করা হয় এই অনুষ্ঠান। মনোনয়ন পাওয়া মোট ৭৭৬ জন শিক্ষকের মধ্য থেকে নয়জনকে বেছে নেন বিচারকমণ্ডলী।

সম্মাননা পাওয়া শিক্ষকদের একজন কিশোরগঞ্জের এস ভি সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শাহনাজ কবীর। ক্যানসারের সঙ্গে যুদ্ধ করে জয়ী এই গুণী শিক্ষক বললেন, ‘মানুষের যা ভালোবাসা পেয়েছি, তা এই শিক্ষকতার কারণেই। জীবনে আর কোনো চাওয়া-পাওয়া নাই।’

কুমিল্লা মডার্ন স্কুলের সাবেক সহকারী প্রধান শিক্ষক মো. আবুল হোসেন বলেন, প্রায় ৪৯ বছরে তিনি ক্যাজুয়াল লিভ (সিএল) নেননি। জীবনে দেরি করে স্কুলেও যাননি। শিক্ষার্থীদের নিজের সন্তানদের মতোই দেখেছেন।

বক্তব্য দিচ্ছেন ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির (ইউআইইউ) উপাচার্য চৌধুরী মোফিজুর রহমান

নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষক ময়মনসিংহের কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় হাইস্কুলের সাবেক জ্যেষ্ঠ শিক্ষক আফরূজ জাহান বেগমের ভাষায়, ছাত্ররা নিজেরা ফাঁকি দিলেও ফাঁকিবাজ শিক্ষক পছন্দ করে না।

অনুষ্ঠানের মাঝে ‘আমি বাংলায় গান গাই,...’ গানটি গেয়ে শোনান সংগীতশিল্পী শুভ।

টাঙ্গাইলের আউলিয়াবাদ মাজার দাখিল মাদ্রাসার জুনিয়র মৌলভি রহিমা খাতুন শুধু শিক্ষকতাই করে যাননি, শিক্ষার্থীদের নানা সমস্যার সমাধানেও এগিয়ে যান। বিশেষ করে ছাত্রীদের বাল্যবিবাহ রোধে কীভাবে ভূমিকা রাখেন, সেই কথাও তুলে ধরেন তাঁর বক্তৃতায়।

বক্তব্য দিচ্ছেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং (সিএসই) বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ কায়কোবাদ। পাশে ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির (ইউআইইউ) উপাচার্য চৌধুরী মফিজুর রহমান

যশোরের ঝিকরগাছা সরকারি এম এল মডেল হাইস্কুলের সাবেক সহকারী প্রধান শিক্ষক মো. আবদুর রশিদ বলেন, ভালো শিক্ষক হতে হলে শিক্ষার্থীদের ভালোবাসতে হবে। তারা কী চায়, সেটা জানতে হবে।

সম্মাননা পাওয়া ব্রাহ্মণবাড়িয়ার গোকর্ণ পশ্চিম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক দেবী রানী দাশ অসুস্থতার কারণে অনুষ্ঠানে আসতে পারেননি। তাঁর পক্ষে সম্মাননা গ্রহণ করেন তাঁর ছেলে।

সংগীত পরিবেশন করছেন শিল্পী শুভ

চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদা মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সাবেক প্রধান শিক্ষক মোছা. করিমা খাতুন এখন অসুস্থ। ঠিকমতো কথা বলতে পারেন না। তারপরও অসম্ভব প্রাণশক্তি থাকা এই নারীকে হুইলচেয়ারে করে তাঁর স্বজনেরা অনুষ্ঠানে নিয়ে আসেন। অনুষ্ঠানে তাঁর ছেলের স্ত্রী বললেন, তাঁকে আনা হয়েছে তিনি যেন অনুভব করেন তাঁকে এই সম্মাননা দেওয়া হয়েছে।

শিক্ষক মো. আবদুর রশিদের (ডানে) হাতে সম্মাননা স্মারক তুলে দিচ্ছেন ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশের (ইউল্যাব) উপাচার্য এইচ এম জহিরুল হক

রাজশাহীর পিরিজপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সাবেক সহকারী শিক্ষক মো. জমিউল করিম পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীদের প্রেরণা হিসেবে কাজ করে গেছেন। প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে সম্মাননার জন্য নির্বাচন করায় তিনি ধন্যবাদ জানান।

সম্মাননা গ্রহণের পর কক্সবাজারের কাহারিয়াঘোনা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সাবেক সহকারী শিক্ষক মো. ফয়েজ আহমদ বলেন, তিনি অত্যন্ত খুশি ও আনন্দিত। এই সম্মাননা তাঁর জীবনে বড় পাওয়া।

বক্তব্য দিচ্ছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম

অনুষ্ঠানের ফাঁকে ফাঁকে ভিডিও চিত্রের মাধ্যমে সম্মাননা পাওয়া শিক্ষকদের নিজের কথায় তাঁদের কর্মময় জীবন তুলে ধরেন।

বক্তব্য দিচ্ছেন প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান

অতিথিরা যা বললেন

সম্মাননা তুলে দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম সম্মাননা পাওয়া প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষকদের উদ্দেশে বলেন, তাঁরাই মানুষ গড়ার প্রকৃত কারিগর। তিনি মনে করেন, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষকদের সবচেয়ে বেশি বেতন হওয়া দরকার।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক মোহাম্মদ কায়কোবাদ আক্ষেপ করে বলেন, তিনি যখন স্কুলের ছাত্র ছিলেন, তখন শিক্ষকদের বড় দাম ছিল। অর্থনৈতিক দিক দিয়ে অনগ্রসর থাকলেও সামাজিকভাবে অগ্রসর ছিলেন। এখন তা নেই।

ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির উপাচার্য চৌধুরী মফিজুর রহমান বলেন, স্কুলশিক্ষকদের উত্তরাধিকারই তাঁরা এখনো বহন করে চলছেন।

সম্মাননাপ্রাপ্ত শিক্ষকদের সঙ্গে অতিথিরা

ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টসের উপাচার্য এইচ এম জহিরুল হক অ্যাসিড–সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে প্রথম আলোর উদ্যোগসহ বিভিন্ন উদ্যোগের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করেন।

স্বাগত বক্তব্যে আইপিডিসি ফাইন্যান্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মমিনুল ইসলাম বলেন, গত ৫০ বছরে দেশ অনেক দূর এগিয়েছে। তারপরও কিছু কিছু ক্ষেত্রে কাঙ্ক্ষিত মান অর্জনে পিছিয়ে আছে। তার একটি হলো শিক্ষা। শিক্ষার মান বাড়াতে হলে শিক্ষকদের সম্মান ও সম্মাননা—দুই দিকেই নজর দিতে হবে।

এ ছাড়া সম্মাননা তুলে দেওয়া শিক্ষকদের মধ্যে ছিলেন মতিঝিলের আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ শাহান আরা বেগম ও সেন্ট যোসেফ উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ ব্রাদার লিও প্যারেরা।

আইপিডিসি-প্রথম আলো প্রিয় শিক্ষক সম্মাননা ২০২০ পাওয়া শিক্ষকেরা। বাঁ থেকে আফরূজ জাহান বেগম, শাহনাজ কবীর, মো.ফয়েজ আহমদ, মোছা. করিমা খানম, মো. আবদুর রশিদ, মো. জমিউল করিম, রহিমা খাতুন, মো. আবুল হোসেন। আজ বিকেলে রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলে

করোনা সংক্রমণের কারণে প্রায় এক বছর ধরে ভয়ংকর পরিস্থিতির কথা তুলে ধরেন প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান। তিনি বলেন, তাঁদের জীবদ্দশায় এমন একটি সময় পার করবেন, তা কখনো ভাবেননি। এটি অবিশ্বাস্য ও ভয়ংকর সময়। আবার একই সঙ্গে নতুন অনেক কিছু জানাও গেল। ভবিষ্যতে কীভাবে চলতে হবে, তার অনেক কিছু্ই শিখে নেওয়া গেল।

এ সময় করোনাকালে মারা যাওয়ার জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী এবং করোনায় মারা যাওয়ার সব মানুষকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন মতিউর রহমান। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন প্রথম আলো ট্রাস্টের সমন্বয়কারী মাহবুবা সুলতানা।

গত ৫ অক্টোবর বিশ্ব শিক্ষক দিবসে ভার্চ্যুয়ালি শিক্ষক বাছাইপর্বের অনুষ্ঠান শুরু হয়েছিল। মনোনয়ন পাওয়া মোট ৭৭৬ জন শিক্ষকের মধ্য থেকে ৯ জনকে বেছে নেন বিচারকমণ্ডলী।