Thank you for trying Sticky AMP!!

ছাত্রলীগের ৮ কর্মীর ফাঁসি

ছেলে হারানোর শোক আজও বয়ে বেড়াচ্ছেন বিশ্বজিতের মা কল্পনা দাস। গতকাল রায় ঘোষণার পর বিশ্বজিতের সমাধিতে তাঁর আবক্ষ মূর্তির সামনে কাঁদছেন তিনি। এ সময় তাঁকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করেন বিশ্বজিতের চাচাতো বোন । ছবি: প্রথম আলো

পুরান ঢাকায় দরজি দোকানি বিশ্বজিৎ দাসকে পিটিয়ে ও কুপিয়ে হত্যার দায়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের আট কর্মীকে ফাঁসির রশিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দিয়েছেন আদালত। অপর ১৩ আসামিকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ ও প্রত্যেককে ২০ হাজার টাকা জরিমানার আদেশ দেওয়া হয়।
ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-৪-এর বিচারক এ বি এম নিজামুল হক গতকাল বুধবার এ রায় ঘোষণা করেন। বিশ্বজিৎ হত্যা মামলায় চলতি বছরের ২ জুন অভিযোগ গঠন করা হয়। এর সাড়ে ছয় মাসের মাথায় বিচারিক আদালতে আলোচিত এই মামলার নিষ্পত্তি হলো।
মৃত্যুদণ্ডাদেশ পাওয়া ব্যক্তিরা হলেন রফিকুল ইসলাম ওরফে শাকিল, মাহফুজুর রহমান ওরফে নাহিদ, রাশেদুজ্জামান ওরফে শাওন, ইমদাদুল হক, কাইয়ুম মিয়া, সাইফুল ইসলাম, রাজন তালুকদার ও নূরে আলম ওরফে লিমন। তাঁদের মধ্যে প্রথম ছয়জন কারাগারে এবং রাজন ও নূরে আলম পলাতক।
যাবজ্জীবন দণ্ডাদেশ পাওয়া ব্যক্তিরা হলেন এইচ এম কিবরিয়া, গোলাম মোস্তফা, খন্দকার ইউনুস আলী, মনিরুল হক, তারিক বিন জোহর, আলাউদ্দিন, ওবায়দুল কাদের, ইমরান হোসেন, আজিজুর রহমান, আল আমিন শেখ, রফিকুল ইসলাম (২), কামরুল হাসান ও মোশাররফ হোসেন। এঁদের মধ্যে কিবরিয়া ও গোলাম মোস্তফা ছাড়া বাকিরা পলাতক। ২১ আসামিই জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের কর্মী।
রায়ে আদালত বলেন, আসামিরা ইচ্ছাকৃতভাবে ঘটনার সময় (২০১২ সালের ৯ ডিসেম্বর) বিশ্বজিৎ দাসকে ছোরা, চাপাতি, রড ও কাঠের রোলার দিয়ে আঘাত করেন এবং কিল, ঘুষি মারেন। ফলে মৃত্যু হতে পারে বলে তাঁদের জানা ছিল। এ কারণে দণ্ডবিধির ৩০২ ধারায় হত্যার দায়ে আট আসামিকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হলো। অপর ১৩ আসামি হত্যাকাণ্ডে অংশ নিয়ে সহযোগিতা করায় ৩০২ ও ৩৪ ধারায় তাঁদের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও প্রত্যেককে ২০ হাজার টাকা জরিমানা করা হলো।
রায়ে বলা হয়, ‘রাজনৈতিক হরতাল ও অবরোধ যদি হিংস্রতা ও বিশৃঙ্খলার দিকে ধাবিত হয়, তবে নিকট ভবিষ্যতে হয়তো বিশ্বজিতের মতো আরও মৃত্যু আমাদের দেখতে হবে।’
দুপুর ১২টা ২০ মিনিটে কারাগারে আটক আট আসামিকে আদালতে হাজির করা হয়। ১২টা ২৫ মিনিটে এজলাসে আসেন বিচারক। তিনি বিচারকাজে সহযোগিতার জন্য রাষ্ট্রপক্ষ ও আসামিপক্ষের আইনজীবীদের ধন্যবাদ জানিয়ে প্রায় ১০ মিনিটে পর্যবেক্ষণসহ রায়ের সংক্ষিপ্ত অংশ পড়েন। বিশ্বজিতের বড় ভাই উত্তম কুমার দাসসহ কয়েকজন স্বজন উপস্থিত ছিলেন।
রায়ে বলা হয়, রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষ্য-প্রমাণ, আসামিদের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি, গণমাধ্যমে প্রকাশিত স্থির ও ভিডিওচিত্র এবং হত্যাকাণ্ডের পারিপার্শ্বিক অবস্থা রায়ের ক্ষেত্রে বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। আসামিদের মধ্যে আটজন গ্রেপ্তার আছেন, ১৩ জন পলাতক। সংগত কারণেই বিশ্বাস করা যায়, বিশ্বজিৎ হত্যার সঙ্গে আসামিরা জড়িত। আসামিরা অপরাধী মনের তাড়নায় আদালতে বিচারের সম্মুখীন না হয়ে ইচ্ছাকৃতভাবে পলাতক রয়েছেন। আসামিদের বিরুদ্ধে বেআইনিভাবে হত্যা ও হত্যাকাণ্ডে সহযোগিতা করার অপরাধ প্রমাণিত হয়েছে। আইনের দৃষ্টিতে তাঁদের সর্বোচ্চ শাস্তিই কাম্য।
রায়ের পর বিশ্বজিতের ভাই উত্তম সন্তোষ প্রকাশ করে প্রথম আলোকে বলেন, বিশ্বজিৎকে হারানোর শোকে মা-বাবা অসুস্থ, তাঁদের মনের অবস্থা খুব খারাপ। তাঁরা বিশ্বজিতের ভাস্কর্য বানিয়ে তা শরীয়তপুরে গ্রামের বাড়ির পেছনে বসিয়েছেন। ওই ভাস্কর্যের সামনে বসে মা-বাবা কান্নাকাটি করেন। উত্তম দ্রুত রায় বাস্তবায়নের এবং তাঁদের পরিবারের নিরাপত্তার দাবি জানান।
‘আমার কিছুই অইব না’: রায়ের পর বেলা পৌনে একটার দিকে আদালত থেকে আসামিদের কারাগারে নেওয়ার জন্য প্রিজন ভ্যানে ওঠানোর সময় রফিকুল ইসলাম ওরফে শাকিল তাঁর স্বজনদের উদ্দেশে বলেন, ‘জজকোর্টের ওপর হাইকোর্ট আছে। সেখানে কিছু করার চেষ্টা কইরেন। আর আমার লাইগা চিন্তা কইরেন না। আমার কিছুই অইব না।’ রাশেদুজ্জামান সাংবাদিকদের উদ্দেশে বলেন, ‘আপনাদের কারণেই আমাদের এই বিপদ। রায়ে আপনারা খুশি তো? আপনারা খুশি হলেই আমরা খুশি।’
সকাল থেকে আদালত এলাকায় গণমাধ্যমকর্মী ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা ভিড় করেন। কারাগারে নেওয়ার জন্য আসামিদের প্রিজন ভ্যানে তোলার সময় নেতা-কর্মীরা তাঁদের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেন।
নির্মম সেই হত্যাকাণ্ড ও বিচার কার্যক্রম: গত বছরের ৯ ডিসেম্বর ছিল বিরোধী দলের অবরোধ কর্মসূচি। সেদিন সকাল নয়টার দিকে বিএনপির সমর্থক আইনজীবীরা জজকোর্ট এলাকা থেকে মিছিল বের করেন। মিছিলটি বাহাদুর শাহ পার্ক হয়ে জজকোর্টের দিকে আসতে থাকে। একই সময় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের অবরোধবিরোধী মিছিল রায়সাহেব বাজার মোড় ঘুরে ক্যাম্পাসের দিকে যাচ্ছিল। এ সময় বাহাদুর শাহ পার্কের কাছে একটি ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটে। ছাত্রলীগের মিছিল থেকে কয়েকজন এ সময় পথচারী বিশ্বজিৎকে (২৪) ধাওয়া করে। তিনি তখন লক্ষ্মীবাজারের বাসা থেকে শাঁখারীবাজারের দোকানে যাচ্ছিলেন। ধাওয়ার মুখে তিনি পার্কের কাছে দোতলায় একটি ক্লিনিকে আশ্রয় নিলে ছাত্রলীগের কর্মীরা সেখানে তাঁকে নৃশংসভাবে কোপান ও পেটান। পরে তাঁকে নিচে নামিয়ে এনে পেটানো ও বর্বর নির্যাতন করা হয়। একপর্যায়ে তিনি দৌড়ে শাঁখারীবাজারের রাস্তার মুখে গিয়ে পড়ে যান। রিকশাচালক রিপন তাঁকে রিকশায় তুলে মিটফোর্ড হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানে তাঁর মৃত্যু হয়।
ওই দিন রাতেই ২৫ জনের নাম উল্লেখ করে সূত্রাপুর থানায় মামলা করে পুলিশ। মামলাটি তদন্ত করে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। ৫ মার্চ ২১ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেয় ডিবি। সন্দেহজনকভাবে আদালত এলাকা থেকে গ্রেপ্তার হওয়া চারজনকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। ২ জুন অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিক বিচারকাজ শুরু হয়। জনগুরুত্ব বিবেচনা করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ১৮ জুন মামলাটি ট্রাইব্যুনালে পাঠানোর প্রজ্ঞাপন প্রকাশ করে।
১৪ জুলাই সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়। ১৯ নভেম্বর সাক্ষ্য ও জেরা শেষ হয়। রাষ্ট্রপক্ষে ৬০ জন সাক্ষীর মধ্যে ৩২ জন সাক্ষ্য দেন। আসামিপক্ষে সাক্ষ্য দেন দুজন। ২৭ নভেম্বর থেকে ১ ডিসেম্বর পর্যন্ত যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে আদালত ১৮ ডিসেম্বর রায় ঘোষণার দিন ধার্য করেন। রাষ্ট্রপক্ষে সরকারি কৌঁসুলি এস এম রফিকুল ইসলাম এবং আসামিপক্ষে আইনজীবী সৈয়দ শাহ আলম, জামাল উদ্দিন প্রমুখ মামলা পরিচালনা করেন।
যেভাবে আসামিরা শনাক্ত হলেন: হাইকোর্টের স্বতঃপ্রণোদিত আদেশের পরিপ্রেক্ষিতে গণমাধ্যমে প্রচারিত ছবি, আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদ ও প্রত্যক্ষদর্শীদের তথ্যের ভিত্তিতে ২১ আসামিকে শনাক্ত করা হয়। রফিকুল, রাশেদুজ্জামান, মাহফুজুর ও ইমদাদুল আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন।
তদন্ত কমিটির খবর নেই: অভিযোগ আছে, বিশ্বজিৎ হত্যাকাণ্ডের সময় ঘটনাস্থলের ১০-১৫ গজ দূরে দাঁড়িয়েছিলেন পুলিশের লালবাগ বিভাগের উপকমিশনার হারুন অর রশিদসহ অন্তত ৩০ পুলিশ সদস্য। হামলাকারীদের প্রতিহত করতে এবং বিশ্বজিৎকে রক্ষায় তাঁরা এগিয়ে আসেননি। এ বিষয়টি তদন্তের জন্য গত বছরের ২১ ডিসেম্বর পুলিশ সদর দপ্তর তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে। কিন্তু এই কমিটি এখনো প্রতিবেদন জমা দেয়নি বলে জানা গেছে।

এক নজরে: বিশ্বজিৎ হত্যা মামলা

৯ ডিসেম্বর, ২০১২ বিশ্বজিৎ দাসকে হত্যা
৫ মার্চ, ২০১৩ অভিযোগপত্র দাখিল
২ জুন অভিযোগ গঠন
১৮ জুন জনগুরুত্ব বিবেচনায় ট্রাইব্যুনালে পাঠানোর প্রজ্ঞাপন
২৭ নভেম্বর যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শুরু
১ ডিসেম্বর যুক্তি উপস্থাপন শেষ
[তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি]