Thank you for trying Sticky AMP!!

ছেলেসন্তানদের জন্য বনিয়াদি প্রশিক্ষণ

কলকাতার ‘বেলা শেষে’ সিনেমাটা যাঁরা দেখেছেন, তাঁরা হয়তো এর শেষ দিকের একটি দৃশ্যের সঙ্গে সবাই পরিচিত। এক বৃদ্ধ স্ত্রী ঈশ্বরের কাছে কিছু চাইলেন। তার স্বামী তাকে জিজ্ঞেস করলেন তিনি কী চেয়েছেন; উত্তরে স্ত্রী বলেছেন, ‘ঈশ্বর যেন আমার আগে তোমাকে নিয়ে নেন। কারণ, আমি তোমাকে ছাড়া বাঁচতে পারব, কিন্তু তুমি আমাকে ছাড়া বাঁচতে পারবে না।’ কথাগুলো খুব অর্থবহ মনে হয়েছে। 

এই সিনেমায় স্বামী ভদ্রলোক স্ত্রীকে স্বাবলম্বী করার জন্য বিয়ের ৪৯ বছর পর বিবাহবিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নেন। তারা যখন আলাদা থাকা শুরু করেন তার স্ত্রী স্বাবলম্বী হয়ে উঠলেও এই স্বামী বেচারার আর হয়ে উঠা হয়নি। তার স্বীকারোক্তি, ‘সকালের চাটা কোনো রকম বানিয়ে খেলেও সন্ধ্যাবেলায় আলসেমি লাগে।’

সাধারণত বাঙালি মেয়েরা নিজের আগে স্বামীর মৃত্যু কখনোই চান না, কী সিনেমায় কী বাস্তবতায়। কিন্তু এই সিনেমার কথাগুলো যেন বাস্তবতার চরম প্রকাশ। আমরা আমাদের ছেলেদের এমনভাবে বড় করে তুলি যে তারা পরনির্ভরশীল হয়েই থাকে সারাটা জীবন। এখানে ছেলেদের দোষ দেওয়ার আগে আমাদের পরিবারের, মায়েদের ভূমিকাটা একবার দেখে নেওয়া দরকার। স্ত্রী হয়ে আমি যখন আমার স্বামীর কাছ থেকে ঘরের কাজে সহযোগিতা আশা করছি, তখন নিজের মনে প্রশ্নটা থেকেই যায়, আমার ছেলেকে আমি কী শিখাচ্ছি? তাকে সংসারের কোনো কাজে না জড়িয়ে শুধু পরনির্ভরশীল করে বড় করছি। সে–ও তো তার স্ত্রীর কাছে একই রকমভাবে বিবেচিত হবে আর মা হিসেবে আপনি–আমি যে গালি শুনব তা হলো ‘মায়েরই দোষ, কোনো শিক্ষা দেয়নি।’
করোনাকালের এই দুঃসহ সময়ে একটা ভালো বিষয় লক্ষ করা যাচ্ছে। বাসার বারান্দা কিংবা ঘরের জানালা দিয়ে তাকালে দেখা যায়, অনেক বাসায় ছেলেরা ঘরের কাজ করছে। কাউকে কাপড় শুকাতে, কাউকে ঘর ঝাড়ু দিতে আবার কাউকে বা বাচ্চা সামলাতে দেখা যায়। এটাই তো balance for better! যার জন্য পৃথিবীময় বিশেষ দিবস করে আলোচনা করা হচ্ছে! অথচ আমরা যদি আমাদের ছেলেসন্তানদের এই ছোট কাজগুলো করার জন্য ছোটবেলা থেকে আগ্রহী করে তুলি, তাতে কিন্তু সে কখনোই পরনির্ভরশীল হবে না। বরং তার ছোট ছোট অবদানের কারণে সে একটা ভারসাম্যপূর্ণ পরিবেশের সৃষ্টি করতে পারবে। আর তার অবদানটা কখনোই অস্বীকৃত থাকবে না। সঙ্গে সঙ্গে মা কিংবা সংসারে যে এই কাজগুলো করেন, তাদের প্রতি শ্রদ্ধা আর সহমর্মিতা উপলব্ধি করার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ঘটতে পারে আমাদের সন্তানদের মধ্যে।

করোনার এই সময়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেক মাকে দেখেছি তাঁদের সন্তানদের বিভিন্ন কাজের ছবি পোস্ট করতে। এর মধ্যে কেক, মিষ্টি, আইসক্রিম, সালাদ বানানো থেকে শুরু করে শরবত বানানো। শুধু মেয়েরা নয়, ছেলে বাচ্চারাও অংশ নিচ্ছে সমানভাবে। যেকোনো কাজের ক্ষেত্রে, বিশেষ করে চাকরির ক্ষেত্রে শুরুতেই সামনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য বনিয়াদি প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়ে থাকে। আর সাধারণত এই প্রশিক্ষণের সময় অনেক ক্ষেত্রেই তিন মাস হয়ে থাকে। আমরা যেহেতু করোনার এই সময় অতিক্রম করছি, তাই এই সময়ে বাচ্চাদের জন্য তাদেরকে ঘরের কাজে আগ্রহী করে তুলতে বনিয়াদি প্রশিক্ষণ দেওয়ার এক সুন্দর সুযোগ হতে পারে।

কাজ মানেই রান্না নয়, দৈনন্দিন জীবনের অনেক ছোট ছোট কাজ আছে, যেগুলোতে আমরা সন্তানদের উৎসাহিত করতে পারি। যেমন: নিজের পড়ার টেবিলটা, নিজের কাপড়টা, রাতে ঘুমানোর আগে বিছানাটা গুছানো, ফার্নিচার মুছা, কিংবা পানি শেষ হয়ে গেলে বোতল বা জগে পানি ঢালা, খাওয়ার সময় নিজের প্লেটটা নিয়ে আসা বা খাওয়ার পর তা সরিয়ে ফেলা—এই রকম ছোট ছোট কাজ করা। মাকে কাজে সাহায্য করার কথা বললে ধরেই নেওয়া হয়, মাকে সাহায্য করবে মেয়েরা। কিন্তু ব্যাপারটা যদি এমন হয়, মাকে সাহায্য করবে তার সন্তান—ছেলে হোক বা মেয়ে, সেটা তো আরও ভালো বিষয় হওয়া উচিত। আর বাচ্চাদের কোনো কাজে অংশগ্রহণের আহ্বান জানালে তারা খুশিই হয়, নিজেদের একটু বড় ভাবতে থাকে কিংবা গুরুত্বপূর্ণ মনে করে।
করোনার এই দুঃসময়ে সবাই এক রকম উৎকণ্ঠা–উদ্বিগ্নতা আর কাজের চাপের মধ্য দিয়ে সময় পার করছি। ঘরে ঘরে নেই সাহায্যকারী। বিশেষ করে যাঁরা বাড়িতে বসে অফিস করছেন, তাঁদের জন্য বিষয়টা আরও কঠিন। বাসা, অফিস, ঘরের কাজ সব সামলিয়ে জীবনের যেন নাভিশ্বাস উঠে যাচ্ছে। এ সময়ই হতে পারে সন্তানদেরকে ঘরের কাজে সম্পৃক্ত করার জন্য উপযুক্ত সময়। আমরা নিজেরা যা করছি তার ছোট ছোট কোনো অংশে সাহায্য নিতে পারি আমাদের বাচ্চাদের। মা হয়ে আমরা হয়তো ভাবি বাচ্চারা পড়ালেখা, ক্লাস, খেলাধুলা করছে, তাদেরকে আর ঘরের কাজে জড়িয়ে কাজ কী? অথবা ভাবছি তারা ছোট, এ ধরনের কাজ পারবে না কিংবা ভাবছি তারা ক্লান্ত হয়ে যাবে; আসুন দয়া করে এ রকম চিন্তা–ভাবনাকে প্রশ্রয় না দিই। আপনি আমি নিজে যেটা পারছি, আমাদের সন্তানেরা কেন সেটা পারবে না? আসুন অভিভাবক হয়ে তাদের জীবন চলার পথটা জটিল, পরনির্ভরশীল না করে তুলতে সাহায্য করি। আর বাড়তি পাওনা হিসেবে সন্তানের মধ্যে রোপণ করি মমত্ব, সহমর্মিতা আর শ্রদ্ধাবোধের বীজ!
এখন থেকেই তারা একটু একটু করে বুঝতে শিখুক ঘরের কাজ করলে আত্মমর্যাদায় কোনো সমস্যা হয় না। প্রায় তিন মাসের বেশি সময় ধরে আমাদের সন্তানেরা ঘরে আছে। সন্তানের সঙ্গে পূর্ণ সময় কাটানোর সুযোগ হচ্ছে আমাদের। এই সময় আমরা কাজে লাগিয়েছি হয়তো অনেকেই। যাঁরা এখনো এই বিষয়ে নিয়ে ভাবার সুযোগ পাননি, আসুন আজ থেকেই শুরু করি ছেলেদের প্রশিক্ষিত করার কাজটি। Better Late Than Never.

আজ থেকেই তারা হোক আমাদের ঘরের কাজের সহযোগী। ছেলেদের তথাকথিত ছেলে হিসেবে নয়, মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার কাজটি শুরু করি আজ থেকেই। ছেলেরা আজ থেকেই বুঝতে শিখুক ঘরের কাজ শুধু মেয়েদের দায়িত্ব নয়, তাতে তারও রয়েছে সমান অংশীদারত্ব। আর ছেলেসন্তানদের জন্য এই সব বিষয় নিয়েই আমার শুরু করতে পারি তাদের বনিয়াদি প্রশিক্ষণ!

*লেখক: গবেষণাকর্মী