Thank you for trying Sticky AMP!!

ছোটবেলার ঈদ সুচিত্রা-উত্তম এবং গুড-প্যারেন্টিং

গত শতকের পঞ্চাশের দশকে ঈদে হলে গিয়ে সিনেমা দেখার চল ছিল

এই ঈদে রাস্তাঘাট একেবারে ফাঁকা দেখে মনে পড়ল আমাদের ছোটবেলার ঈদের কথা। শুধু এত সুউচ্চ ভবনের জট তখন ছিল না। কিন্তু জনবিরল রাস্তাঘাট। সারা দিন বন্ধুদের সঙ্গে মিলে পাড়া চষে বেড়াতাম। আরেকটা মজা ছিল। গুলিস্তান বা আশপাশের সিনেমা হলে ম্যাটিনি শো দেখতাম, বন্ধুদের সঙ্গে। এটা ছিল আমাদের কাছে এক বড় আকর্ষণ।

আর সিনেমা মানেই তো সুচিত্রা-উত্তম। ঈদের সময় সব হলেই বেশ হিট ছবি চলত। অনেক হলে চলত ইংরেজি ছবি। বিশেষভাবে গুলিস্তানে। পরে নাজ হলে তো প্রতি সপ্তাহে নামকরা ইংরেজি ছবি চলত। আমি ছিলাম সেই সব ছবির পোকা।

সেটা ১৯৫০-এর দশকের শেষ দিকের কথা। আমরা ওয়ারীতে থাকি। পড়তাম রামকৃষ্ণ মিশন স্কুলে। পরে চলে যাই সদরঘাটে কলেজিয়েট স্কুলে। রামকৃষ্ণ মিশন স্কুলে শুক্রবারে ছিল মর্নিং ক্লাস। দশটা না বাজতেই চলে যেতাম গুলিস্তানে। অথবা রায়সা বাজারের কাছে মুকুল সিনেমা হলে। প্রচুর ইংরেজি সিনেমা দেখেছি।

বলতে গেলে অড্রে হেপবার্ন, গ্রেগরিপেক থেকে শুরু করে সব নামকরা অভিনয়শিল্পীর ছবি একটাও বাদ দিতাম না। আবার ভারতীয় হিন্দি ছবিও দেখতাম। দিলীপ কুমার, সায়েরা বানু থেকে শুরু করে সব বিখ্যাত শিল্পীর অভিনয় দেখতে ভালোবাসতাম।

আমাদের বাসার নিয়ম ছিল, খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে পড়তে বসতে হবে। এরপর স্কুল। বিকেলে বাসায় এসে খেয়ে আবার স্কুলের মাঠে যেতাম খেলতে। কিন্তু কঠোর নিয়ম ছিল, সন্ধ্যার আগেই বাসায় ফিরে হাত–পা ধুয়ে পড়তে বসতে হবে। মা দেখতেন এই নিয়ম আমরা মেনে চলছি কি না।

আমরা গুড প্যারেন্টিংয়ের কথা বলি। অনেক কিশোর-তরুণ আজকাল দল বেঁধে মারপিট করে। এই তো গতকাল ঈদের বিকেলে দেখলাম, আমাদের বাসার সামনে দিয়ে একদল তরুণ মোটরসাইকেলের বহর নিয়ে বিকট আওয়াজ করে ঝড়ের বেগে চলছে।

মনে হয় তরুণেরা যেন একধরনের উচ্ছৃঙ্খলতার মধ্যে চলে যাচ্ছে। তখন আমরা বলি গুড প্যারেন্টিংয়ের কথা। আসলে আমরা যেভাবে বড় হয়েছি, সেটাই বোধ হয় গুড প্যারেন্টিং। শুধু দুটি নিয়ম। সকালে পড়তে বসো। আর সন্ধ্যার আগেই বাসায় ফিরে আবার পড়তে বসো। অবশ্য বাসার পরিবেশও অনুকূল ছিল। তার মধ্যে একটা বড় ব্যাপার ছিল, ছোটদের জন্য ভালো গল্পের বই, কবিতার বই। আমরা পড়াশোনার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছি এভাবেই।

যাক, ঈদের কথা বলছিলাম। একবার এক ঈদে ঠিক করলাম সুচিত্রা-উত্তমের ছবি দেখতে যাব সদরঘাটে, রূপমহল সিনেমা হলে। পাশের বাসার বন্ধুও যাবে। ঈদের পরদিন ম্যাটিনি শো। বেলা তিনটা থেকে সন্ধ্যা ছয়টা। বন্ধুর বাসায় গেলাম। সে বলল, যাবে না। আমার মনটা খারাপ হয়ে গেল। তাও বললাম, তাহলে আমি একাই যাই। ছবিটা খুব টানছিল।

ছবি শুরু হলো। চলছে। গল্পটা বেশ মজার ছিল। এর মধ্যেই বাইরে শুরু হয়ে গেল ঝড়-বৃষ্টি। বিদ্যুৎ চলে গেল। আমি হল থেকে বেরিয়ে এসে ভাবছি, আর মাত্র ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই বাসায় ফিরতে হবে। না হলে সন্ধ্যা পেরিয়ে যাবে। মায়ের বকুনি খেতে হবে। একটু একটু বৃষ্টিও পড়ছে। রিকশায় বাসায় ফিরে যাব কি না ভাবছি। এরই মধ্যে বিদ্যুৎ ফিরে এল। আমি আবার হলে ঢুকে সিনেমাটা শেষ পর্যন্ত দেখে বাসায় রওনা দিলাম।

এদিকে সন্ধ্যা প্রায় হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আমি বুঝতে পারিনি সেদিন আমার বিপদটা আসছে অন্য দিক থেকে। বাসায় ফিরে যথারীতি হাত-মুখ ধুয়ে পড়তে বসেছি। মা এসে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এই ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে কোথায় ছিলি?’ আমি একটু থতমত খেয়ে বললাম, পল্টন ময়দানে ফুটবল খেলতে গিয়েছিলাম। বৃষ্টির জন্য ফিরতে একটু দেরি হলো। মা একটু থেমে শুধু বললেন, ‘আমাকে না বলে আর কখনো এভাবে বাইরে যাবি না।’

আমি তো খুশি। পরদিন পাশের বাসার বন্ধুর কাছে গেলাম সুচিত্রা-উত্তমের ছবির গল্পটা বলতে। বন্ধু আমাকে দেখে বলল, ‘তোমার মা কিছু বলেছেন?’ আমি বললাম, না তো, কেন? সে বলল, ‘কাল ঝড়ের সময় তোমার মা একজনকে পাঠিয়েছিলেন আমার কাছে, জানার জন্য, আমি আছি কি না।’ আমি তো হতভম্ব। বললাম, কী বলেছ? সে বলল, ‘কেন! বললাম যে তুমি সিনেমা দেখতে গিয়েছ।’

আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। তার মানে মা সবই জানেন। জানেন যে আমি মিথ্যা বলেছি। ফুটবল খেলতে নয়, সিনেমা দেখতে গিয়েছি। আমার মিথ্যা বলাটা ধরা পড়ে গেছে। কিন্তু তারপরও মা এটা নিয়ে একটা কথাও বলেননি। শুধু বলেছেন, আর কখনো এভাবে না বলে যেন বাইরে না যাই।

আমি তখন বেশ ছোট। মিথ্যা বলে যে কত বড় অন্যায় করেছি, সেদিন আমার মা আমাকে কোনো বকাঝকা না করেও খুব নীরবে জানিয়ে দিলেন। বুঝিয়ে দিলেন, মিথ্যা বলতে নেই। এরপর আর কোনো দিন আমি মিথ্যা বলিনি। আমার জীবনের সবচেয়ে বড় শিক্ষা মা এমন সুন্দরভাবে আমাকে বুঝিয়ে দিয়েছেন।

আজ মা নেই। সুচিত্রা-উত্তমের সেই অনাবিল আনন্দের দিনও নেই। কিন্তু আমি আমার জীবনে এখনো ধরে রেখেছি, কীভাবে মানুষ হতে হয়।

আব্দুল কাইয়ুম, প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক