Thank you for trying Sticky AMP!!

ছোট কারখানায় জমজমাট জিনজিরা

জিনজিরায় ছোট কারখানার সংখ্যা সাড়ে তিন শ থেকে চার শ। এসব কারখানায় কাজ করে হাজার দশেক শ্রমিক। কারখানাগুলোতে উৎপাদিত পণ্যসামগ্রী বুড়িগঙ্গা পার হয়ে পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকার পাইকারদের কাছে যায়। পরে আরেক দফা হাতবদল হয়ে সারা দেশের খুচরা ব্যবসায়ীদের দুয়ারে পৌঁছায়।

একসময় জিনজিরার কারখানাগুলোতে উৎপাদিত পণ্যসামগ্রীর একটি অংশ ছিল নকল ও নিম্নমানের। সে জন্য কোনো পণ্য নকল মনে হলেই মানুষ ‘মেইড ইন জিনজিরা’ বলে টিপ্পনী কাটতেন। তবে বর্তমানে কারখানাগুলো মানসম্পন্ন পণ্যই তৈরি করছে বলে দাবি করলেন জিনজিরা তাওয়াপট্টি ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প ও ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি আক্তার জেলানী খোকন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘জিনজিরায় উৎপাদিত পণ্যের গুণমান ভালো। এখানকার শ্রমিকেরাও খুবই দক্ষ। কোনো যন্ত্রের নমুনা দিলে তারা সেটি অল্প দামে হুবহু তৈরি করে দিতে পারে।’

সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবদুল মোতালেব বলেন, ‘আমরা যদি বাইরের কোনো পণ্য অনুকরণ করে উৎপাদন করি এবং তা নিজের নামে চালাই তবে সমস্যা নাই। জিনজিরায় এমনটাই হচ্ছে। এটি কোনোভাবেই নকল না।’

১১ এপ্রিল জিনজিরা ঘুরে দেখা গেল, বেশির ভাগ কারখানায় বিভিন্ন ধরনের ‘ওয়াসার’ তৈরি হয়। গোল চাকতির মতো পণ্যটির মাঝ বরাবর একটি গোল ছিদ্র। ওয়াসার বিভিন্ন আকারের হয়। এটি ঘরবাড়ি কিংবা কারখানার টিনের চালের স্ক্রু, রিকশা-ভ্যানসহ বিভিন্ন যন্ত্রের নাটবল্টু লাগাতে ব্যবহৃত হয়। সাধারণত জাহাজের স্ক্র্যাপ ও অ্যালুমিনিয়ামের শিট (পাত) দিয়ে ওয়াসার তৈরি হয়। এ ছাড়া নাটবল্টু, পেরেক, দরজার কবজা, অ্যালুমিনিয়ামের হাঁড়ি-পাতিল, পিতলের বালতি-কলসি, বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম, রিকশার হুডের বাঁশের কাঠামো, লোহার দা-কাঁচি-কুড়াল, কাঠের আসবাব তৈরির কারখানার দেখা মিলল।

২৬-২৭ বছর আগে জিনজিরায় স্মরণিকা মেটাল ইন্ডাস্ট্রিজ নামে কারখানা করেন আবদুল রাজ্জাক খোকন। তাঁর কারখানায় বিভিন্ন ধরনের ওয়াসার তৈরি হয়। কাজ করেন ১৬ জন শ্রমিক। সব মিলিয়ে মাসে ৭৫০ কেজি ওয়াসার উৎপাদিত হয়।

এসব তথ্য দিয়ে আবদুল রাজ্জাক বলেন, পুরান ঢাকার রায়সাহেব বাজার ও ইমামগঞ্জের পাইকারদের কাছে প্রতি কেজি ওয়াসার ৫৫ থেকে ৮০ টাকা দরে বিক্রি হয়। ওয়াসার তৈরির কারখানার সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় ব্যবসা কিছুটা কমে গেছে।

পাশের একটি ছোট্ট কারখানায় পাঁচ শ্রমিক লেদ মেশিনে ওয়াসার তৈরি করছিলেন। তাঁদের মাসিক মজুরি সাড়ে আট হাজার টাকা। দিনে ন্যূনতম ১০০ কেজি ওয়াসার তৈরি করতে হয়। বেশি করলে ওভারটাইম পান।

পাশের আরেক গলিতে ঢুকে চোখে পড়ল ‘বিক্রমপুর মেটাল’ নামের কারখানায় অ্যালুমিনিয়ামের কড়াই তৈরি হচ্ছে। বিদ্যুচ্চালিত যন্ত্রের এক পাশে অ্যালুমিনিয়ামের নির্দিষ্ট আকারের পাত ধরলেই কয়েক সেকেন্ডে কড়াই তৈরি হয়ে যায়। পরে দুই পাশে হাতল লাগিয়ে যন্ত্রের মাধ্যমে পলিশ করলেই ব্যবহারের উপযোগী হয়ে যায় সেই তৈজস।

বিক্রমপুর মেটালের স্বত্বাধিকারী সিরাজুল ইসলাম বললেন, তাঁর কারখানায় অ্যালুমিনিয়ামের কড়াই, গামলা, হাঁড়ি-পাতিল, ঢাকনা ইত্যাদি তৈরি হয়। মাসে প্রায় ১৫ হাজার পণ্য তৈরি হয়। এসব পণ্য মিটফোর্ড এলাকায় পাইকারি দরে বিক্রি হয়। কারখানার শ্রমিকের সংখ্যা ১২ জন।

গলি দিয়ে সামনে এগোতেই দেখা মিলল আরও কয়েকটি অ্যালুমিনিয়াম হাঁড়ি-পাতিলের কারখানা। তেমনি এক কারখানা থেকে বের হচ্ছিলেন পলিশ কারিগর আবু কালাম। তাঁর সারা মুখে অ্যালুমিনিয়ামের গুঁড়ায় মাখামাখি। কদমতলীর এই যুবক বছর তিনেক ধরে কারখানাটিতে কাজ করেন। মাসে ১২-১৫ হাজার টাকা মজুরি পান। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে কাজ করতে শারীরিক সমস্যা হয় কি না, জানতে চাইলে তিনি বললেন, এখনো সমস্যা হয়নি।

একই গলিতে পূর্ণিমা মেটালের কারখানাটি মাঝারি আকারের। এখানে মাসে ৮০-৯০ হাজার অ্যালুমিনিয়ামের কড়াই, গামলা, হাঁড়ি-পাতিল তৈরি হয়। এসব পণ্য মিটফোর্ডের পাইকারদের কাছে যায়। কারখানার স্বত্বাধিকারী জহিরুল ইসলাম বললেন, অ্যালুমিনিয়ামের প্রতি কেজি পণ্যে ছয়-সাত টাকা মুনাফা হয়। তাঁর ভাষায়, বর্তমানে কারখানা চলছে পেটে-ভাতে।
কারণ, দোকান ভাড়া ও বিদ্যুতের বিল বেড়েছে। অন্যদিকে কারখানার সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় ব্যবসা কিছুটা কমে গেছে।

আরেক গলিতে দেখা মিলল পিতলের তৈজস তৈরির কারখানা। সেখানে নাকে গামছা বেঁধে শহীদুল হাওলাদার যন্ত্রের মাধ্যমে পিতলের বদনা পলিশ করছেন। তাঁরা পলিশকে ‘বব’ বলেন। ১৫-১৬ বছর ধরে এই কাজ করছেন শহীদুল। বললেন, একেকটি বদনা পলিশে ১৪ টাকা ও তবলা পলিশে ৮০ টাকা মজুরি পান। মাসে ১৬ হাজার টাকার মতো হয়।

পিতলের এসব তৈজস হাতুড়ি দিয়ে ঠুকে ঠুকে করা হয়। কারখানায় গিয়ে দেখা গেল, আট-নয়জন কারিগর কাজ করছেন। তাঁদের একজন শরীয়তপুরের আবদুল মান্নান ৩৫ বছর ধরে এই কাজ করছেন। তিনি কলস তৈরি করছিলেন। জানালেন, ক্রেতাদের চাহিদা অনুযায়ী তবলা, পিতলের কলস, খোল ও ফুলের টব তৈরি করেন তাঁরা। এসব পণ্য এলিফ্যান্ট রোডসহ বিভিন্ন জায়গায় যায়। সারা দিনে পাঁচটি কলস তৈরি করতে পারেন মান্নান। প্রতিটির মজুরি ৭০ টাকা। সংসার চলে কি না, জানতে চাইলে বললেন, এখানে কাজ করেই দুই ছেলেমেয়েকে পড়াশোনা করাচ্ছেন। তবে টাকার অভাবে বড় ছেলেকে পড়াতে পারেননি।

জিনজিরায় সবচেয়ে বড় কারখানাটি হচ্ছে পাশা ইলেকট্রিক। এখানে বিদ্যুৎ খাতের প্রয়োজনীয় কেব্‌ল কানেক্টর, সাব-স্টেশন কানেক্টরসহ ১০০ ধরনের সরঞ্জাম উৎপাদিত হয়। এসব পণ্য পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে কাজে লাগে। কারখানাটিতে ২৪০ জন শ্রমিক কাজ করেন।

কারখানার মহাব্যবস্থাপক মোর্শেদ আলম সেলিম বললেন, পল্লী বিদ্যুতের প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের প্রায় ৪০ শতাংশই এখানে উৎপাদিত হয়। প্রতিষ্ঠানটি দরপত্রে অংশ নিয়ে পল্লী বিদ্যুতের সরঞ্জাম তৈরির কাজ নেয়। ১৯৮৬ সালে প্রতিষ্ঠিত কারখানাটির আকার বড় করতে নারায়ণগঞ্জে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা চলছে।

জিনজিরা তাওয়াপট্টি ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প ও ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি বলেন, জিনজিরার কারখানাগুলোর জন্য অনেক পণ্যই বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয় না। এতে বৈদেশিক মুদ্রা বাঁচে। সরকার যদি একটি পরিকল্পনা করে, তবে জিনজিরায় উৎপাদিত পণ্য বিদেশে রপ্তানি করা সম্ভব।