Thank you for trying Sticky AMP!!

ছোট সঞ্চয়, দুর্দিনের সহায়

বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে বড় শিক্ষা হলো করোনাভাইরাসের দ্বারা সারা বিশ্বকে একসঙ্গে নাড়া দেওয়া। এমন কোনো বিষয়বস্তু বাদ যায়নি, যা এই করোনা পাঠ্যপুস্তকে নেই। জীবনের প্রতিটি পরতে পরতে করোনাভাইরাস বুঝিয়ে দিয়েছে খামখেয়ালি হলে, সবকিছুর ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চাইলে পতন হবেই।

বিভিন্ন গবেষকের ধারণা, বর্তমানে করোনা মহামারিতে মানুষ যে ভয়ংকর ফল ভোগ করছেন, তা মূলত মানুষেরই সৃষ্টি। করোনা সবচেয়ে বড় আঘাতটা করেছে মানুষের জীবনহানি ও অর্থনীতির ওপর।

তৃতীয় বিশ্বের নিম্ন-মধ্য আয়ের দেশ হিসেবে বাংলাদেশ ভুক্তভোগী হচ্ছে আরও বেশি। গত ৮ জুন বিশ্বব্যাংকের গ্লোবাল ইকোনমিক প্রসপেক্টাস-২০২০ প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশে মোট দেশজ উৎপাদনের প্রবৃদ্ধি (জিডিপি) ১ দশমিক ৬ শতাংশে নেমে আসতে পারে। এ ছাড়াও ২০২০-২১ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি ১ শতাংশে নেমে আসতে পারে।

বিশেজ্ঞদের ধারণা, এই করোনা মহামারির কারণে দক্ষিণ-এশিয়ার দেশগুলোতে দারিদ্র্যের হার বাড়বে। সেই হিসাবে বাংলাদেশে আগের তুলনায় অনেক বেশি দারিদ্র্যের প্রভাব আসতে চলেছে।

ইতিমধ্যে বাংলাদেশের হতদরিদ্র মানুষের নেতিবাচক ফল ভোগ করতে শুরু করেছে। হয়তোবা সামগ্রিক অর্থে তুলনামূলক একটু বেশি আয়ের খেটে খাওয়া মানুষ চিত্রটি বুঝতে পারবে না। কিন্তু কোনো না কোনোভাবে মহামারির প্রভাব থেকে তো আর কেউ রেহাই পাবে না। একদিকে করোনা মহামারিতে মৃত্যুর ঝুঁকি, অন্যদিকে দরিদ্রতার আঘাত। বিগত সময়ে বাংলাদেশ দুই মাসেরও বেশি সময় লকডাউনের কারণে সব ধরনের কার্যক্রম বন্ধ হয়েছে। এতে বিপাকে পড়েছিল দরিদ্র ও প্রান্তিক মানুষ।

পোশাক খাতের কর্মী, পারলার, ছোট-বড় রেস্তোরাঁ, টি-স্টল, সেলুন, শপিংমলের দোকান, হকার মার্কেট, কৃষকের স্বাভাবিক কর্মকাণ্ড, মজুরসহ সব ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী আয়-রোজগার হারিয়ে অভাব-অনটনে নিমজ্জিত হয়েছে। লকডাউন তুলে নেওয়ার পরও যে এই অবস্থা থেকে সবাই বের হতে পেরেছে তা কোনোভাবেই বলা চলে না।

কিন্তু লক্ষ করলে দেখা যাবে, করোনাকালীন বাংলাদেশের একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ প্রান্তিক জনগোষ্ঠী খুব সুন্দরভাবেই খেয়ে-পরে ভালো আছেন। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, তারা সবাই ক্ষুদ্র সঞ্চয়ধারী। বিশেষ করে বাংলাদেশে প্রায় এক কোটিরও বেশি প্রান্তিক ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির নাগরিক কোনো না কোনো সমবায়ের সঙ্গে জড়িত এবং তাদের আয়ের ক্ষুদ্রাংশ তারা সঞ্চয় রাখছে দীর্ঘ সময় ধরে।

প্রায় পৌনে দুই লাখ সমবায় সমিতির মাধ্যমে তারা নিজেদের অবস্থার উন্নতি ও ভবিষ্যৎ বনিয়াদ গড়তেই সঞ্চয়ের দিকে ঝুঁকেছেন। করোনা মহামারির এই আপৎকালীনই সেই সঞ্চয়গুলোই তাদের রক্ষা করেছে। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে গড়ে ওঠা কয়েকটি সমবায় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কথা বলে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, তারা মূলত তাদের সঞ্চয়ের অর্থ দিয়েই এই সময়ের মহামারি মোকাবিলা করছে। এমনকি, তারা অন্যদেরও সহযোগিতা দিচ্ছে।

সুন্দরবন মৌয়াল শ্রমজীবী সমবায় সমিতি লিমিটেডের সভাপতি রজব আলী শেখের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, করোনাভাইরাস রোধে সরকার–ঘোষিত লকডাউনের কারণে সব মানুষের আয় বন্ধ হয়ে যায়। কিছুদিন চলার পরই সুন্দরবন অঞ্চলের প্রান্তিক মানুষেরা ভয়ানক দরিদ্রতা শিোর হয়। বিভিন্ন স্থানে তারা ত্রাণের জন্য ছুটতে শুরু করে। সেই তুলনায় মৌয়াল-চাষিরা, যাঁরা এই সমিতির সদস্য ছিলেন, তাঁরা তাঁদের সঞ্চয় থেকেই জীবিকা নির্বাহ করতে পারছিলেন। তাঁদের সমিতির দুই শ সদস্যের মধ্যে নারী সদস্য এক শরও বেশি। নারীরা একটু বেশিই সঞ্চয়প্রবণ হন।

দিনাজপুরের তেঁতুলিয়ায় কাম-টু-সেভ (বিটিএস) বহুমুখী সমবায় সমিতি লিমিটেডের সদস্য মোজাফর হোসেনও একই কথা বললেন। মহামারির এই দুর্যোগকালে তাঁদের সবচেয়ে বড় সাহস ছিল ক্ষুদ্র সঞ্চয়গুলো। আগের মতো না হলেও, অনেকটাই সচ্ছলভাবেই লকডাউনের সময়গুলো পার করতে পারছেন তাঁরা। শুধু তা–ই নয়, অন্য হতদরিদ্রদের সহযোগিতার জন্য এই সমবায় প্রতিষ্ঠান উপজেলা অফিসে আর্থিক সহায়তাও দিয়েছে। এই সমবায় প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন ধরনের হস্তশিল্প প্রস্তুত করে ব্যক্তি তথা সামষ্টিক আয়ের ব্যবস্থা করেছে। সমিতির সদস্য ছাড়াও অন্যদেরও এতে কর্মসংস্থান হচ্ছে।

দিনাজপুরের প্রান্তিক এলাকা ঝলঝলির আরেকটি সমবায় সমিতি ঝলঝলি বহুমুখী সমবায় সমিতি লিমিটেড। বিভিন্ন খামার প্রকল্প নিয়ে তারা কাজ করছেন। এই প্রতিষ্ঠানে সভাপতি নজরুল ইসলাম জানান, এই অঞ্চলের সব মানুষই খেটে খাওয়া। আয়ের ক্ষুদ্রাংশই তারা সঞ্চয় করে ভবিষ্যতে কিছু করার জন্য। কিন্তু করোনা রোধে সরকারের ঘোষিত লকডাউনের কারণে তাদের আয় তো বন্ধ হয়ে গেছে। যার কারণে, সদস্যরা তাদের জমানো সঞ্চয় তুলে নিয়ে জীবনধারণ শুরু করেছে।

নজরুল ইসলাম বলেন, ‘সঞ্চয় তুলে নেওয়ার কারণে আমাদের সমিতির কিছুটা আর্থিক সংকট দেখা দিলেও সদস্যরা তাঁদের সঞ্চয়ের কারণেই টিকে রয়েছেন। কিন্তু এই ক্ষুদ্র সঞ্চয় আর কত দিন চলবে? তবে একটি বিষয় লক্ষ করেছি, সদস্য এবং অন্যদের মধ্যে আগের তুলনায় সঞ্চয়প্রবণতা বেড়েছে। অনেকেই সদস্য হওয়ার জন্য এসেছেন এবং পুরোনো সদস্যরা তাঁদের সঞ্চয়ের পরিমাণ বাড়িয়েছেন। আমরা সমিতির আয় থেকে ঈদে হতদরিদ্রদের সহায়তা দিয়েছি।’

মৌলভীবাজারে একটি প্রতিষ্ঠান হলো বড়ছড়া পানি ব্যবস্থাপনা সমবায় সমিতি লিমিটেড। এই সমিতির সদস্য শেখ সবুজ আলম জানান, তাঁদের সদস্যরাই এলাকায় সবচেয়ে বেশি ভালো আছেন এই সংকটকালে। শুধু তা–ই নয়, সরকারের স্বাস্থ্যবিধির পরামর্শ সঠিকভাবে সদস্যদের কাছে পৌঁছে দেওয়ায়, সদস্যরাও সচেতন হয়েছেন। যেহেতু সমবায় দশের জন্য, তাই এখানে একসঙ্গে অনেক কাজ করা যায়। সদস্যদের সঞ্চয় থেকে টাকা উত্তোলনে হঠাৎ একটা চাপ পড়লেও এটাকে ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখছেন সদস্য আলম। কারণ, ক্ষুদ্র সঞ্চয়ও যে দুর্যোগে সবচেয়ে বড় বন্ধু হতে পারে, তা এই করোনার কারণেই সদস্যরা অনুভব করেছে। তিনি খুশি হয়েছেন এই ভেবে যে তাদের সমিতির লভ্যাংশ থেকে উপজেলা পর্যায়ে টিএনওর মাধ্যমে আর্থিক সহযোগিতাও দিতে পেরেছেন।

বাংলাদেশে পাওনিয়ার হিসেবে যেসব সমবায় সমিতি সঞ্চয়ের মাধ্যমে উন্নয়নের পথ দেখিয়েছিল, তার মধ্যে ‘ঢাকা ক্রেডিট’ অন্যতম। এই নামেই বহুল পরিচিত এই সমিতি। সরকারের নিবন্ধিত নথিপত্রে এর নাম ‘দ্য খ্রিষ্টান কো-অপারেটিভ ক্রেডিট ইউনিয়ন লি. ঢাকা’। ৬৫ বছরের আগে ১৯৫৫ খ্রিষ্টাব্দে ৫০ জন সদস্য ও ২৫ টাকা মূলধন নিয়ে মিশনারি এক ফাদার চার্লস জে ইয়াং লক্ষ্মীবাজারে যে সমবায় সমিতিটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, তার সদস্যসংখ্যা বর্তমানে প্রায় ৪৩ হাজার, মূলধন প্রায় ৮০০ কোটি টাকা।

এই সমিতির প্রেসিডেন্ট পংকজ গিলবার্ট কস্তা বলেন, ‘এত বড় দুর্যোগের মাঝেও প্রায় ১ হাজার ৫০০ হতদরিদ্র সদস্যকে ৩ হাজার ৪০০ টাকার খাদ্যদ্রব্য ১ হাজার ৭০০ টাকায় বিতরণ করেছি। এই ১ হাজার ৭০০ টাকা নিতান্তই সহজ শর্তে ঋণ হিসেবে দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া আর্থিকভাবে অসচ্ছল সদস্যদের জন্য নামমাত্র সুদে ৫০ হাজার টাকা করে ‘কমোডিটি ঋণ’ দিয়েছি।’ তিনি বলেন, বর্তমানে এই সমিতির অধিকাংশ সদস্য নিষ্ঠার সঙ্গে তাদের নিয়মিত ঋণের কিস্তি ও শেয়ার জমা দিয়ে যাচ্ছেন। তার মানে, সঞ্চয় মানুষকে সার্বিক দিক থেকে শক্তিশালী করে, মনোবল বৃদ্ধি করে। সংকটের কাছেও হেরে যায় না মানুষ।

কেন্দ্রসহ দেশের প্রান্তিক অঞ্চলের এসব সমবায় সমিতির সাক্ষ্যগুলো সংকটকালের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। কিন্তু বসে খেলে নাকি রাজার ধনও শেষ হয় একদিন। তাই বলা যায়, এভাবে কত দিন চলবে, তাও ভেবে দেখার প্রয়োজন রয়েছে। প্রান্তিক এসব মানুষের আয় বেশি না থাকার কারণে তাদের সঞ্চয়ের পরিমাণও নগণ্য।

দীর্ঘদিনের জমানো অর্থ দিয়ে নাহয় কিছুদিন চলবে, এরপর যে আরও খারাপ অবস্থার আবির্ভাব হবে না তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। বাস্তবতায় এটাও প্রতীয়মান হয় যে সমবায়ের সঙ্গে যারা জড়িত, তারা সত্যিকার অর্থেই প্রান্তিক মানুষ। জীবন-জীবিকার তাগিদে তাদের লড়াই করে চলতে হচ্ছে। রাষ্ট্র তথা সরকারপ্রধানের দায়বদ্ধতা রয়েছে এসব প্রান্তিক মানুষের পাশে থাকার। সমবায় সেক্টর মাধ্যম হিসেবে উন্নয়নের কাজ করলে হয়তো সরকারের উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন অনেকাংশেই পূরণ করার প্রক্রিয়ায় সহজতর হবে। যখন দেশের প্রান্তিক মানুষগুলো ভালো থাকবে, তারা উন্নত হবে, তখনই বাংলাদেশ উন্নয়নের কথা গর্বের সঙ্গে বলতে পারবে এবং পূর্ণ হবে জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের লালিত স্বপ্ন।

লেখকেরা: সমবায়কর্মী