Thank you for trying Sticky AMP!!

ছয় জেলায় মৃত্যু ও শনাক্তের রেকর্ড

শনাক্ত ও মৃত্যুতে প্রায় নিয়মিতই এখন রেকর্ড হচ্ছে পটুয়াখালী, চট্টগ্রাম, সিলেট, রংপুর, লক্ষ্মীপুর ও পঞ্চগড় জেলায়।

ডিএনসিসি করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতালের সামনে গতকাল দুপুরে অ্যাম্বুলেন্সে মা মনুজা বেগমকে নিয়ে মেয়ে নার্গিসের উদ্বিগ্ন অপেক্ষা। একজন ভেতরে গেছেন আইসিইউর খোঁজ জানতে। চাঁদপুর সদর হাসপাতাল থেকে গতকাল ঢাকায় আসে পরিবারটি।

দেশে করোনা সংক্রমণের শুরু থেকে পটুয়াখালী জেলার পরিস্থিতি কখনোই উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছায়নি। তবে এখন পরিস্থিতি ভিন্ন। এই জেলায় করোনায় আক্রান্ত হয়ে গত ২৪ ঘণ্টায় ৫ জনের মৃত্যু হয়েছে, যা এক দিনে পটুয়াখালীতে সর্বোচ্চ মৃত্যুর রেকর্ড। সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে ১২৩ জনের। ১৬ মাস ধরে চলা করোনা মহামারিতে এই জেলায় শনাক্তের সংখ্যা প্রথমবারের মতো ১০০ ছাড়ায় গত সপ্তাহে।

পটুয়াখালীর মতোই শনাক্ত ও মৃত্যুতে প্রায় নিয়মিতই এখন রেকর্ড হচ্ছে চট্টগ্রাম, সিলেট, রংপুর, লক্ষ্মীপুর ও পঞ্চগড় জেলায়। এসব জেলায় পরীক্ষার বিপরীতে শনাক্তের হারও বেশি। রোগী বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এসব জেলার হাসপাতালে রোগীর চাপ বেড়েছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, সংকটাপন্ন করোনা রোগীদের চিকিৎসার জন্য পটুয়াখালী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঁচটি নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র (আইসিইউ) রয়েছে। সব কটি শয্যা ফাঁকা থাকার কথা গতকাল অধিদপ্তরের বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু বাস্তবে এই হাসপাতালে সচল কোনো আইসিইউ নেই। তিন মাস আগে পাঁচটি আইসিইউ শয্যা দেওয়া হলেও প্রয়োজনীয় অন্যান্য যন্ত্রপাতি এখনো দেওয়া হয়নি। আইসিইউ পরিচালনার জন্য প্রশিক্ষিত জনবলও নেই। যে কারণে সংকটাপন্ন রোগীদের বাধ্য হয়ে ছুটতে হয় ৪০ কিলোমিটার দূরের বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে।

পটুয়াখালী শহরের বৌদ্ধমন্দির এলাকার বাসিন্দা সুলতান আহমেদের বাবা ও বোন করোনায় আক্রান্ত হয়ে এখন পটুয়াখালী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের করোনা ইউনিটে ভর্তি আছেন। সেখানেই তাঁদের চিকিৎসা চলছে। সুলতান আহমেদ বলেন, হাসপাতালে আইসিইউ নেই। বৃদ্ধ বাবার আইসিইউর প্রয়োজন হলে তাঁকে দ্রুত বরিশালে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি রেখেছেন তাঁরা।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, পটুয়াখালী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কেন্দ্রীয় অক্সিজেন ব্যবস্থা রয়েছে। বাস্তবে সেখানে অক্সিজেন প্ল্যান্ট স্থাপন করা হয়নি। তবে হাসপাতালে বিকল্প ব্যবস্থায় বড় সিলিন্ডার দিয়ে নিরবচ্ছিন্ন অক্সিজেন সরবরাহ ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে। গতকাল এই হাসপাতালের ৮০টি সাধারণ শয্যার প্রতিটিতেই করোনা রোগী ভর্তি ছিল।

হাসপাতালের সহকারী পরিচালক মো. লোকমান হাকিম প্রথম আলোকে বলেন, করোনায় আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসার অনুষঙ্গ হলো নিরবচ্ছিন্ন অক্সিজেন সরবরাহ। বিকল্প উপায়ে সীমিত আকারে সেই অক্সিজেন সরবরাহের ব্যবস্থা করা হয়েছে। আইসিইউ সেবা কার্যক্রমের জন্য প্রশিক্ষিত জনবল ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির জন্য চাহিদাপত্র পাঠানো হয়েছে। তাঁর আশা, খুব দ্রুততম সময়ে আইসিইউ সেবা কার্যক্রম শুরু করা সম্ভব হবে।

পটুয়াখালীর মতো পঞ্চগড় জেলাতেও আইসিইউ ও কেন্দ্রীয় অক্সিজেনের সুবিধা নেই। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যেই এটি উল্লেখ রয়েছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, চট্টগ্রাম, সিলেট, রংপুর, লক্ষ্মীপুরের ৬০টি আইসিইউর মধ্যে ৫৫টিতেই গতকাল রোগী ভর্তি ছিল। অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, চট্টগ্রামে ৫টি আইসিইউ ফাঁকা ছিল।

দেশে চলমান কঠোর বিধিনিষেধের মধ্যেও সংক্রমণ কমার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। ঈদুল আজহার পরে পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। হাসপাতালে শয্যা পেতে রোগীদের এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে ছুটতে হচ্ছে। গতকাল শুক্রবার ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় করোনা রোগীদের জন্য নির্ধারিত ১২টি হাসপাতালে শয্যার চেয়ে রোগী বেশি ভর্তি ছিল।

করোনাবিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সাবেক উপাচার্য নজরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ঈদের সময়ে স্বাস্থ্যবিধি না মেনে অবাধ চলাচলের প্রভাব সংক্রমণে দেখা যাচ্ছে। স্বাস্থ্যসংক্রান্ত বিষয়াদি বিধিনিষেধে যুক্ত না করায় তা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে খুব একটা কাজে আসছে না। আর শনাক্ত কমানো না গেলে মৃত্যুও কমানো সম্ভব হবে না।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত ২৪ ঘণ্টায় (গত বৃহস্পতিবার সকাল আটটা থেকে শুক্রবার সকাল আটটা পর্যন্ত) দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণে আরও ২১২ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ সময় নতুন রোগী শনাক্ত হয়েছে ১৩ হাজার ৮৬২ জন। পরীক্ষার বিপরীতে শনাক্তের হার ৩০ দশমিক ৭৭ শতাংশ।

আইসিইউ শয্যার সংকট, সাধারণ শয্যাতেও রোগীর চাপ

সিলেটে প্রথম করোনায় আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয় গত বছরের ৫ এপ্রিল। গতকাল পর্যন্ত সিলেট জেলায় ২৪ হাজার ৭২৮ জনের করোনা শনাক্ত করা হয়েছে। তাঁদের মধ্যে গত ২৪ ঘণ্টায় জেলায় ৯১৬ জনের নমুনা পরীক্ষা করে ৪৬৪ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে, যা এক দিনে সর্বোচ্চ শনাক্তের রেকর্ড। রোগী শনাক্তের হার ৫০ দশমিক ৬৬ শতাংশ।

সিলেট জেলায় করোনার জন্য নির্ধারিত ১৬টি আইসিইউর কোনোটিই ফাঁকা নেই। জেলার তিনটি হাসপাতালের ১৪৬টি সাধারণ শয্যার মধ্যে গতকাল ১২৭টিতেই রোগী ভর্তি ছিল। সিলেট বিভাগে সিলেট জেলা বাদে শুধু মৌলভীবাজারে ৬টি আইসিইউ রয়েছে। কিন্তু গত কয়েক দিনে রোগীর চাপ বাড়ায় এখন পুরো সিলেট বিভাগেই কোনো আইসিইউ ফাঁকা নেই।

সিলেটের ডেপুটি সিভিল সার্জন জন্মেজয় দত্ত বলেন, সিলেট জেলা সংক্রমণের ‘পিকে’ (সর্বোচ্চ অবস্থায়) রয়েছে। দফায় দফায় বিধিনিষেধ দেওয়া হলেও জনগণ স্বাস্থ্যবিধির তোয়াক্কা করেননি। ঈদের সময়ও অনেকে ঘুরে বেড়িয়েছেন। সংক্রমণ বৃদ্ধির পেছনে এর প্রভাব পড়েছে।

রংপুর বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালকের কার্যালয় সূত্র জানায়, ২৪ ঘণ্টায় রংপুর বিভাগে করোনা শনাক্ত হয়েছে ৯৫৪ জন। এটি এ পর্যন্ত বিভাগে এক দিনে সর্বোচ্চ সংক্রমণ শনাক্তের রেকর্ড। এর আগে গত ২৫ জুলাই শনাক্ত ছিল ৯২০ জন। তাঁদের মধ্যে রংপুর জেলায় গত ২৪ ঘণ্টায় ২৭২ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে, যা জেলায় এক দিনে সর্বোচ্চ শনাক্ত।

রংপুর জেলায় করোনা রোগীদের জন্য ৮টি আইসিইউর সব কটিতেই গতকাল রোগী ভর্তি ছিল, আর ১৬১টি সাধারণ শয্যার মধ্যে ১৪১টিতেই রোগী ছিল।

চট্টগ্রামে গত ২৪ ঘণ্টায় ১ হাজার ৪৬৬ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে। এখন পর্যন্ত এক দিনে সর্বোচ্চ শনাক্তের রেকর্ড এটি। পরীক্ষা বিবেচনায় শনাক্তের হার ৩৭ শতাংশের বেশি। এর আগে গত বৃহস্পতিবার জেলায় সর্বোচ্চ ১ হাজার ৩১৫ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছিল। চট্টগ্রামে করোনা রোগীদের জন্য নির্ধারিত ৩৩টি আইসিইউর মধ্যে ২৮টিতে রোগী ছিল।

চট্টগ্রাম বিভাগের লক্ষ্মীপুর জেলায় গত ২৪ ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ২২২ জনের সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে। এর আগে গত ২৮ জুলাই এক দিনে সর্বোচ্চ ২০৫ জনের সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছিল। লক্ষ্মীপুরে করোনা রোগীদের জন্য তিনটি আইসিইউ থাকলেও কোনোটিই ফাঁকা নেই।

লক্ষ্মীপুর জেলা করোনা প্রতিরোধ কমিটির সদস্যসচিব ও সিভিল সার্জন মো. আব্দুল গাফ্ফার বলেন, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেড়েই চলছে। জুন মাসের প্রথমে মোটামুটি লক্ষ্মীপুরের পরিস্থিতি ভালো ছিল। জুনের শেষ দিক থেকে খারাপের মধ্যে আছে।

রোগী বাড়তে থাকায় করোনার জন্য নির্ধারিত দেশের বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালগুলোতে চাপ বাড়ছে। গতকাল ১২টি সরকারি হাসপাতালে নির্ধারিত শয্যার চেয়ে বেশি রোগী ভর্তি ছিল।

২৫০ শয্যাবিশিষ্ট চাঁদপুর জেনারেল হাসপাতালে করোনা রোগীদের জন্য শয্যা রয়েছে ৬০টি। গতকাল রোগী ভর্তি ছিল ১৯৩ জন। রাজধানীর কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে ২৭৫টি সাধারণ শয্যায় রোগী ভর্তি ছিল ৩৬৪ জন।

এ ছাড়া যেসব হাসপাতালে শয্যার চেয়ে রোগী বেশি ছিল, সেগুলো হলো ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, চট্টগ্রামের ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতাল, গাজীপুর শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, কিশোরগঞ্জের সৈয়দ নজরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ফেনী সদর হাসপাতাল, কুমিল্লা জেনারেল হাসপাতাল, বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, বরিশালের শের–ই–বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, বরিশাল জেনারেল হাসপাতাল এবং বরগুনা জেনারেল হাসপাতাল।

২৪ ঘণ্টার চিত্র

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত ২৪ ঘণ্টায় করোনায় সবচেয়ে বেশি ৬৫ জনের মৃত্যু হয়েছে ঢাকা বিভাগে। চট্টগ্রাম বিভাগে মারা গেছেন ৫৩ জন, খুলনা বিভাগে ৩৬ জন। বাকিরা অন্যান্য বিভাগের। এখন পর্যন্ত করোনা সংক্রমিত শনাক্ত রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১২ লাখ ৪০ হাজার ১১৫ জন এবং মারা গেছেন ২০ হাজার ৪৬৭ জন। করোনায় আক্রান্ত হওয়ার পর এখন পর্যন্ত সুস্থ হয়েছেন ১০ লাখ ৬৪ হাজার ১৯৫ জন। সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় সুস্থ হয়েছেন ১৩ হাজার ৯৭৫ জন।