Thank you for trying Sticky AMP!!

জঙ্গিরা ভিনগ্রহের প্রাণী নয়, আমাদেরই সন্তান

সালিহা বেন আলী

তিউনিসিয়ান বংশোদ্ভূত বেলজিয়ামের নাগরিক সালিহা বেন আলী একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখলেন তাঁর ১৭ বছরের ছেলে সাবরি বেন আলীর বিছানাটা খালি। এরপর তিনি জানলেন ছেলে জঙ্গিবাদে জড়িয়ে সিরিয়া গেছে। চার মাস পরই তিনি জানলেন ছেলে মারা গেছে। সালিহা ভেঙে পড়েননি। উগ্রবাদ, জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে সচেতনতা গড়তে গোটা পৃথিবীই চষে বেড়াচ্ছেন। সম্প্রতি এসেছিলেন বাংলাদেশেও। ১৫ ফেব্রুয়ারি ধানমন্ডির একটি প্রতিষ্ঠানে এক অনুষ্ঠানের ফাঁকে প্রথম আলোকে সাক্ষাৎ​কার দেন তিনি। সাক্ষাৎ​কার নিয়েছেন গোলাম মর্তুজা

প্রথম আলো: সাবরি কীভাবে নিখোঁজ হলো?
সালিহা: ২০১৩ সালের আগস্টে এক সকালে উঠে দেখলাম ও বিছানায় নেই। তার আগের দিন বিকেলে ও আমার কাছে অনুমতি চেয়েছিল এক বিয়ের অনুষ্ঠানে যাওয়ার জন্য। আমি বলেছি, তুমি যেতে পারো। এখন আমার মনে হয়, সে আসলে জঙ্গিবাদে যুক্ত হওয়ার জন্য আমার কাছে এভাবে অনুমতি আদায় করেছে। স্কুল ছাড়ার পর থেকে ও নিজেকে বঞ্চিত মনে করত।

প্রথম আলো: ওই বয়সে সাবরি কেন স্কুল ছাড়ল?
সালিহা: সাবরি হোটেল ম্যানেজমেন্টে পড়ত। পড়াশোনার শেষ পর্যায়ে ছিল। একদিন সাবরি বলল, সে ওই প্রতিষ্ঠানে পড়তে চায় না, কারণ তাদের দুজন শিক্ষক বর্ণবাদী (রেসিস্ট)। তাই তার জন্য ওখানে পড়াশোনা করা কঠিন। এরপর সে নতুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের খোঁজ করছিল। আমি আর তাঁর দুজনেই তাকে স্কুল ছাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিলাম। আমরা বললাম, বসে না থেকে তুমি স্বেচ্ছাশ্রম বা কোনো উপার্জনমূলক কাজ করো। কিন্তু সে ভালো কোনো কাজ পাচ্ছিল না। কারণ, বেলজিয়ামে উচ্চ ডিগ্রি ছাড়া আমাদের মতো তিউনিসিয়ান বা মরক্কোর লোকেরা ভালো কাজ পায় না। তখন সাবরি ময়লা পরিষ্কারের (গার্বেজ ম্যান) কাজ নেয়। ওই কাজে কঠিন পরিশ্রম। হতাশ হয়ে সাবরি আমাকে বলেছে, মা, আমি তিনটি ভাষা জানার পরও ভালো কাজ পাচ্ছি না। তাঁর প্রতিবেশী বন্ধুরা বলেছে, দেখো, তুমি স্কুলে ভালো ফল করার পরেও তোমাকে সমাজ গার্বেজ ম্যান বানিয়েছে। ও সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার চেষ্টা করেছে। কিন্তু পারেনি। কারণ, তার কোমরে সমস্যা ছিল। এরপরে সে পাচক বা প্রশাসনিক কাজ বেছে নিতে চায়। সে দমকল বাহিনীতেও যোগ দেওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু কোনোটাই হয়নি। বেশ কিছু ব্যর্থতা তাঁর আত্মবিশ্বাস কমিয়ে দিয়েছিল। এ সময়ই সে কিছু লোকের সঙ্গ পায়, যারা তাকে একজন ভালো মুসলিম হওয়ার জন্য উৎসাহিত করে। এরপর সে ইসলাম কী, তা বুঝতে স্থানীয় মসজিদের ইমামের কাছে যায়। ইমামের সঙ্গে ভাষাজনিত সমস্যার কারণে যোগাযোগ সফল হয়নি, ইমাম তাঁকে সময়ও দেয়নি। পরে সে ইন্টারনেটে খোঁজাখুঁজি শুরু করে। এ সময় তার সঙ্গে একজন ধর্মান্তরিত মুসলমানের পরিচয় হয়। তার নাম জাঁ লুইদানি। আর ইউরোপের এই ধর্মান্তরিত মুসলিমরা সবচেয়ে ভয়ংকর জঙ্গিতে পরিণত হয়েছিল। ও-ই তাকে উগ্রবাদের দীক্ষা দেয়।

প্রথম আলো: অ-ইউরোপীয় হওয়ায় বঞ্চনা, বর্ণবাদের শিকার হওয়ার কারণে কি মুসলিমরা জঙ্গিবাদে উৎসাহিত হচ্ছে? আপনি কী ভাবেন?
সালিহা: বিষয়টা এ রকম না-ও হতে পারে। ইউরোপে অনেকেই জঙ্গিবাদে যুক্ত হয়েছে যারা আরব বংশোদ্ভূত নয়। এটা আদর্শ বা ধর্মের জন্য নয়। তারা তরুণদের মৃত্যুর পরের অসীম সুখময় জীবনের লোভ দেখাচ্ছে। ওই তরুণেরাও জীবনে আরও ভালো কিছু করতে চায়। আর তরুণদের কাছে সংঘাতটা বেশি আকর্ষণীয়। তাদের বোঝানো হচ্ছে, এ পথে গেলে তুমি রাতারাতি জিরো থেকে হিরো হয়ে যাচ্ছ। তরুণেরা ভাবে, আজকে যে কিছুই না, রাতারাতি সে কিছু একটা হয়ে যাবে।

প্রথম আলো: ছেলে চলে যাওয়ার পর প্রথম দিনটিতে আপনি কী করলেন?
সালিহা: আমি তার বন্ধুদের ফোন করে জানতে চাইলাম তারা সাবরির খোঁজ জানে কি না। তাঁর বন্ধুরা জানাল, কয়েক সপ্তাহ ধরেই তারা সাবরিকে দেখে না। সে যে মসজিদে যাওয়ার কথা বলত, তখন জানলাম আসলে সে মসজিদে যেত না। আমি ও আমার স্বামী পুলিশের কাছে গেলাম। আমরা খুবই উদ্বিগ্ন ছিলাম।

প্রথম আলো: পুলিশের কি কোনো উদ্যোগ ছিল?
সালিহা: তারা (পুলিশ) খুবই সহানুভূতিশীল ছিল। তারা বলল, হয়তো আপনার ছেলে তার মেয়েবন্ধুর সঙ্গে আছে বা কোথাও মদ্যপান করতে গেছে। আমি বললাম, আমার ছেলের কোনো মেয়েবন্ধু নেই এবং সে মদ্যপান করে না। সে সিরিয়ায় যেতে পারে বলে আমাদের শঙ্কার কথা পুলিশকে জানালাম। পুলিশ জানাল, তাকে নিখোঁজ হিসেবে ঘোষণা করতে হলে অন্তত দুদিন অপেক্ষা করতে হবে। বাসায় ফিরে আমরা প্রতিবেশীদের কাছেও খুঁজলাম। আমরা দুদিন বাসায় থাকলাম। এর মধ্যেই আমার ছেলের এক বন্ধু বলল, সাবরি সিরিয়ায় গেছে, তার নাম তালিকায় আছে। আমি বললাম, আমাকে সেই তালিকাটা দাও। যে লোকটা তালিকাটা বানিয়েছে তার নাম খালিদ জারকানি, সে এখন ৩০ বছরের সাজা ভোগ করছে। সে একজন পেশাদার (উগ্রবাদে) নিয়োগকারী। অন্য দুই তরুণকে জঙ্গিবাদে নিয়োগের অপরাধ সাব্যস্ত হওয়ায় তাঁর পৃথকভাবে দুটি ঘটনায় ৩০ বছরের সাজা হয়েছে। এরপর আমাদের কেবল অপেক্ষাই করার ছিল। চার দিন পর আমরা ফেসবুকে আবু তোরাব নামের এক ব্যক্তির কাছ থেকে একটি বার্তা পেলাম। সেই আবু তোরাব জানাল, সে-ই আমার ছোট্ট ছেলে সাবরি, সিরিয়ায় গিয়ে নাম পাল্টেছে। আমি প্রশ্ন করলাম, তুমি কোথায়? সে বলল, ‘মা, দুঃখিত হয়ো না, পাগল হয়ো না। আমি সিরিয়ায়। সিরিয়ার মানুষকে সাহায্য করতে এসেছি। বেহেশতে আমাদের দেখা হবে।’

প্রথম আলো: সাবরি চলে যাওয়ার পরে আপনার প্রতিবেশী ও স্বজনদের প্রতিক্রিয়াটা কেমন ছিল?
সালিহা: অনেক প্রতিবেশী বলছে তুমি তোমার ছেলেকে ভুল শিক্ষা দিয়েছ। স্থানীয় বেলজিয়ানদের কেউ বলেছে, তোমাদের (ইসলাম) ধর্মেই জিহাদের উল্লেখ রয়েছে। আবার কেউ বলেছে, তুমি শহীদের মা, জীবন শেষ হওয়া পর্যন্ত ধৈর্য ধরো। অপেক্ষা করো। আর কিছু ঘনিষ্ঠ ও পরিচিত লোক আমাকে এমনভাবে এড়িয়ে চলা শুরু করল যেন আমার কোনো সাংঘাতিক ছোঁয়াচে রোগ হয়েছে।

প্রথম আলো: সিরিয়ায় যাওয়ার পর তার সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছিল? সে সেখানে যা করতে গিয়েছিল, তা করতে পেরেছিল কি?
সালিহা: আমার ছেলেটির এক বন্ধু সিরিয়ায় গিয়ে আবার বেলজিয়ামে ফেরতও আসে। সাবরি তাকে বলেছে যে, সে মা-বাবার কাছে ফিরে যেতে চায়। কারণ, এখানে (সিরিয়ায়) অনেক অনৈসলামিক কার্যকলাপ বা ফিতনা চলছে। তারা জানে না তাদের শত্রু কারা। এখানে একদল মানুষ অন্য দলগুলোর ওপর গণহত্যা চালাচ্ছে। সাবরি তার বন্ধুকে বলেছে, শিয়ারাও মুসলমান, তাদের হত্যা করা ঠিক নয়। এসব কারণে সে ফিরে আসতে চেয়েছিল, কিন্তু পারেনি। ফেরার ইচ্ছা পোষণ করার দুই সপ্তাহ পরই ডিসেম্বরে (২০১৩ সালের) সে নিহত হয়।

প্রথম আলো: সে কীভাবে নিহত হলো?
সালিহা: আমরা আসলে জানি না। কেউ বলেছে, সে ইরাকে বোমা হামলা চালাতে গিয়ে মারা যায়। তার যে বন্ধুটি ফিরে এসেছে সে বলেছে, সাবরি সম্মুখযুদ্ধের সময় মারা গেছে। ডিসেম্বরে কেউ একজন সাবরির বাবাকে ফোন করে বলল, আপনি আবু তোরাবের বাবা? আমার স্বামী বলল, আমার ছেলের নাম সাবরি। ফোনের ওই লোকটি তখন বলল, ‘আপনাকে অভিনন্দন, আপনার ছেলে শহীদ হতে পেরেছে।’

প্রথম আলো: এত বড় একটা আঘাতের পর আপনি কী করে এই প্রচারণামূলক কাজটা শুরু করলেন?
সালিহা: আমি ক্যাথলিক অ্যাসোসিয়েশন নামে একটি এনজিওর পরিচালক হিসেবে কাজ করতাম। এনজিওটি শিশু শরণার্থীদের নিয়ে কাজ করে। সাবরিকে হারিয়ে আমি সমাজকর্মীর মতো চিন্তা করা শুরু করি। আমার মনে হলো বিষয়টি নিয়ে আমাদের কথা বলা উচিত, সচেতনতা বাড়ানো উচিত। পরিবারগুলোকে উগ্রবাদের ধরন ও লক্ষণগুলো সম্পর্কে সচেতন করার চেষ্টা করলাম। কারণ, যখন থেকে সাবরির মধ্যে পরিবর্তন শুরু হলো, তখন থেকেই আমি বলতাম, এটা কী ইসলাম। এটা ইসলাম কি না, বিষয়গুলো আলোচিত হওয়া উচিত। আমি মানুষকে আমার উদ্বেগের বিষয়ে জানালাম। তাদের প্রকৃত মুসলিম হওয়ার বিষয়গুলো বললাম। আমি বুঝলাম যে আমি একা সব মানুষকে ব্যাখ্যা দিয়ে সন্তুষ্ট করতে পারি না। তাই আমি আমার মতো অন্য পিতা–মাতার সঙ্গে দেখা করলাম। আমরা পিতা–মাতাদের দল গঠন করলাম। যেখানে আমরা আমাদের আঘাত, বেদনা ও সবাই যেন সুবিচার পাই এসব বিষয়ে কাজ করতাম। তখন অবস্থাটা এ রকম যে আমার পরিবারের গল্পগুলোও সবাই শুনতে চাইত না। কিন্তু আমি বারবারই আমার ছেলে সাবরির নাম উচ্চারণ করতাম। ওটা আমার জন্য জরুরি ছিল। আমার কোনো কোনো স্বজন বলল, তুমি দয়া করে সাবরির নাম নিয়ো না, এতে তোমার কষ্ট বাড়বে। আর তুমি ঘরের চারদিকে ছেলের ছবি লাগিয়ে কীভাবে তাকে ভুলে থাকার আশা করো। আমি বলছি, আমি তাকে ভুলতে চাই না। আমি তাকে সর্বত্রই রাখতে চাই। কখনো কখনো পরিবারের লোকও ঠিকমতো বুঝতে পারে না। তখন আমরা একটা দল করলাম। আমরা রাজনীতিবিদ, এনজিও, মিউনিসিপ্যালিটিসহ সব জায়গায় গেলাম। জানালাম আমাদের দেশে একটি বড় সমস্যা এসেছে। স্কুলগুলোতে বাজে শিক্ষাব্যবস্থা বৈষম্যের তৈরি করছে। ইসলামভীতির মতো আরও অনেক বিষয় তৈরি হচ্ছে।

প্রথম আলো: জঙ্গিবাদের শিকার পরিবারগুলোর জন্য আপনার বার্তা কী?
সালিহা: আপনারা ভাববেন না সেই বাচ্চাগুলোর জন্য আপনারা একাই দায়ী, নিজেদের অপরাধী ভাববেন না। এর জন্য আমরা সবাই দায়ী। ওরা এ সমাজেরই সন্তান। এখনই আপনাদের উচিত অপরাধী মনোভাব ঝেড়ে সমাজের জন্য কিছু করতে মাঠে নামা। এখন আপনি অন্যদের সন্তানদের জন্য কিছু করতে পারেন, যাতে অন্য পরিবারগুলোর একই পরিণতি না হয়।

প্রথম আলো: এসব ক্ষেত্রে সবাই মুখ লুকাতে চায়, আপনি কেন নিজেকে প্রকাশ করছেন, ছেলের ছবি সবাইকে দেখাচ্ছেন?
সালিহা: মানুষকে মুখ না দেখালে মানুষের ধারণা হয় সবাই একটা দানবের বিষয়ে কথা বলছে। আইএসে কারা যায়? এরা কোনো ভিনগ্রহের প্রাণী নয়। এরা আপনার-আমার যে কারোরই ছেলে হতে পারে। আজ আমি এর শিকার হয়েছি, কাল এর শিকার হতে পারেন আপনিও। তাই আমি সব সময় আমার ও ছেলের ছবিটা সবাইকে দেখাতে চাই। দেখো আমার ছেলেটা কোনো দানব নয়। সে হাসিখুশি, দেখতে সুন্দর একটা হ্যান্ডসাম ছেলে। এই ইস্যুটার একটা মানবীয় চেহারা দেওয়া খুবই জরুরি। তাই আমি বলি, কথা বলুন, আপনাদের মুখ দেখান।

প্রথম আলো: বাংলাদেশের এ পরিস্থিতিতে জঙ্গিবাদ রোধে সরকারের কী করা উচিত বলে আপনি মনে করেন?
সালিহা: শুধু নিরাপত্তার পরিপ্রেক্ষিত থেকে দেখলেই হবে না। পুরো বিষয়টা পুলিশি নয়। সামাজিক ক্ষেত্র, শিক্ষা ও তরুণদের সঙ্গে যোগাযোগের ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করতে হবে। পুলিশ ছাড়াও বাংলাদেশ সরকারের কাছে বার্তা পৌঁছানোর বিকল্প মাধ্যম থাকতে হবে যেখানে মানুষ নিজেদের সমস্যা ও সংশয়ের বিষয়গুলো মন খুলে জানাতে পারে। পুলিশ তাদের সর্বোচ্চটাই করছে। তারপরও আমাদের একটা হেল্পলাইন নম্বর দরকার, যাতে মানুষ কোনো ছেলেমেয়ের মধ্যে জঙ্গিবাদের কোনো চিহ্ন দেখামাত্রই সাহায্য চাইতে পারে। সমাজকে বলতে হবে, তারা যেন তরুণ ও শিশুদের সময় দেয়। আর গণতন্ত্রের চর্চাটাও খুব গুরুত্বপূর্ণ। আমি এখানে রোহিঙ্গাদের কথা শুনেছি। এটা আপনাদের আরও ঝুঁকিপূর্ণ করে তোলে। তাই এখন তোমাদের গণমাধ্যমের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব সঠিক পথটা দেখানোর।