Thank you for trying Sticky AMP!!

জেলেদের সুরক্ষায় উদ্যোগ দরকার

মো. তৌফিকুল আরিফ, শাহীন আনাম, আবদুল ওহাব, সৈয়দ আরিফ আজাদ

চলতি বছরের মে থেকে জুলাই পর্যন্ত মোট ৬৫ দিন মাছ ধরা নিষিদ্ধ থাকায় বঙ্গোপসাগরে মৎস্য সম্পদ বাড়ছে। তবে নিষেধাজ্ঞার ওই সময়ে জেলেদের আর্থসামাজিক অবস্থার অবনতি হয়েছে। সরকার থেকে জেলেদের সহযোগিতা দেওয়া হলেও অনেকই তা পাচ্ছেন না। তাঁদের জন্য যে তহবিল করেছে সরকার, সেটি আরও বাড়ানো প্রয়োজন। জেলেদের সুরক্ষা ও তাঁদের জীবনমান উন্নয়নের পাশাপাশি বঙ্গোপসাগরের মৎস্য সম্পদ বাড়াতে সরকারের আরও উদ্যোগ প্রয়োজন।

‘সামুদ্রিক মৎস্য আহরণে ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞা: করোনাকালে জেলেদের অবস্থা ও ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা’ শীর্ষক ভার্চ্যুয়াল গোলটেবিল বৈঠকে বিশিষ্টজনদের আলোচনায় এসব বিষয় উঠে এসেছে। গতকাল রোববার বিকেলে প্রথম আলো ও মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন যৌথভাবে এ গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করে। বৈঠকে বঙ্গোপসাগরের টেকসই সম্পদ আহরণের একটি জুতসই পরিকল্পনা তৈরি ও তার সঠিক বাস্তবায়নের ওপরে জোর দেন অংশীজনেরা।

বৈঠকে জেলেদের ওপর করা একটি গবেষণার ফলাফল তুলে ধরা হয়। এতে বলা হয়, করোনাকালে জেলেরা এমনিতেই সমস্যায় ছিলেন। এর মধ্যেই ২০ মে থেকে ৬৫ দিন মাছ ধরায় নিষেধাজ্ঞা শুরু হয়। এতে এক–তৃতীয়াংশ জেলে দিনমজুরে পরিণত হন। বেকার হয়ে যান আরও এক–তৃতীয়াংশ। বাকিরা অন্য পেশায় চলে যান। গবেষণার তথ্য তুলে ধরে মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের জেষ্ঠ কর্মসূচি ব্যবস্থাপক শেখ গিয়াসউদ্দিন আহমেদ বলেন, ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞার আগে জেলেরা দিনে ৩৭১ টাকা আয় করতেন। নিষেধাজ্ঞার সময় জেলেদের আয় ১০৭ টাকায় পৌঁছায়। ওই সময়ে তাঁরা উচ্চ হারে মহাজনি ঋণ নিয়েছেন। এর ফলে জেলে পরিবারগুলো স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে তাদের ব্যয় কমিয়ে দিতে বাধ্য হয়।

বৈঠকে প্রধান অতিথির বক্তব্যে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (ব্লু ইকোনমি) মো. তৌফিকুল আরিফ বলেন, করোনাকালে সরকারের ঘোষণা করা প্রণোদনা প্যাকেজ থেকে কৃষির জন্য ৪ শতাংশ সুদে ঋণের সুযোগ আছে। মৎস্য খাতও সেখান থেকে ঋণ পাবে। তিনি বলেন, জেলেরা যাতে দাদনের শিকার না হন, সে জন্য সরকার স্বল্প সুদে তাঁদের ঋণ দেওয়ার কথাও ভাবছে। এ ছাড়া মৎস্য অধিদপ্তরের কাছে থাকা মৎস্যজীবীদের তথ্যভান্ডার হালনাগাদ করা হবে বলে জানান তিনি।

মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম বলেন, সাগরে মাছ ধরার ক্ষেত্রে কত দিন নিষেধাজ্ঞা থাকলে ভালো হয়, তা নিয়ে অনেক গবেষণা হচ্ছে, আরও হওয়া উচিত। উপকূলবাসী এমনিতেই প্রান্তিক। তাঁরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সমুদ্রে মাছ ধরতে যান। ফলে তাঁদের জন্য প্রান্তিকতা কীভাবে কমানো যায়, তা নিয়ে সবাইকে চিন্তা করতে হবে। মৎস্যজীবীদের বিকল্প কর্মসংস্থানের পরিকল্পনার ওপরে জোর দেন তিনি।

শাহীন আনাম বলেন, মৎস্যজীবীরা বংশপরম্পরায় মাছ ধরছেন। কিন্তু তাঁদের সন্তানেরা যাতে পড়ালেখা করে অন্য পেশায় যেতে পারেন, সে ব্যাপারে সহযোগিতা করতে হবে। জেলে পরিবারের নারীদের অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের দিকে সরকারকে নজর দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, করোনাকালে বাল্যবিবাহ ও শিশুশ্রম বাড়ছে। শিশুরা বেশি নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। ফলে জেলেদের জীবন ও জীবিকা নিয়ে সামগ্রিকভাবে ভাবতে হবে।

করোনার কারণে জেলেদের কথা চিন্তা করে এবার ভারতে ৬১ দিনের নিষেধাজ্ঞা ৪১ দিনে কমিয়ে আনা হয় বলে জানান মৎস্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক সৈয়দ আরিফ আজাদ। তিনি বলেন, জেলেদের জীবনমানের সার্বিক উন্নয়নের বিষয়টি মাথায় রেখে পরিকল্পনা করতে হবে।

ওয়ার্ল্ড ফিশ, বাংলাদেশের ইকো ফিশ প্রকল্পের দলনেতা আবদুল ওহাব বলেন, সারা বছরই নানা কারণে মাছ ধরা নিষেধাজ্ঞা যোগ করলে তা ১৪৮ দিন হয়। ওই সময়ে জেলেদের কোনো না কোনো অংশ মাছ ধরতে পারে না। জেলেদের সামাজিক নিরাপত্তার সুবিধা আরও বাড়ানোর পাশাপাশি নিষেধাজ্ঞাকালীন প্রতি মাসে প্রতিটি জেলে পরিবারকে দুই হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়ার প্রস্তাব দেন তিনি।

সামুদ্রিক মৎস্য জরিপ ইউনিটের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মোহাম্মদ শরিফ উদ্দিন বলেন, জেলে পরিবারের ১৮ হাজার তরুণকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। এ ছাড়া ৬৪ হাজার জেলেকে মৎস্য ব্যবস্থাপনার বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে।

দেশের ইলিশ উৎপাদনের সাফল্যকে কাজে লাগিয়ে সামুদ্রিক সম্পদের উন্নয়নে পরিকল্পনা করার পরামর্শ দেন তিনি।
আব্দুল কাইয়ুম, প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক

গোলটেবিল বৈঠকের সূচনা বক্তব্যে জেলেদের বিকল্প কর্মসংস্থানের ওপরে জোর দেন প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম। দেশের ইলিশ উৎপাদনের সাফল্যকে কাজে লাগিয়ে সামুদ্রিক সম্পদের উন্নয়নে পরিকল্পনা করার পরামর্শ দেন তিনি।

জেলে পরিবারে বাল্যবিবাহ বেড়ে গেছে বলে জানান বেসরকারি সংস্থা কোস্ট ট্রাস্টের নির্বাহী পরিচালক রেজাউল করিম চৌধুরী। তিনি বলেন, বাংলাদেশের ২৪টি উপকূলীয় জেলায় দুই কোটি মানুষ জেলে পরিবারের সদস্য। প্রতি পাঁচজনের একজনকে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে উপকূল থেকে সরে আসতে হবে।

নিষেধাজ্ঞার ৬৫ দিনে দুই দফায় চাল বরাদ্দ দেওয়ার কথা থাকলেও তা একবার দেওয়া হয়েছে বলে জানান জাতীয় শ্রমিক ফেডারেশনের সমাজকল্যাণ সম্পাদক এস এম জাকির হোসেন। তিনি বলেন, প্রতি মাসে প্রতিটি পরিবারকে ৬০ থেকে ৬৫ কেজি চাল ও মাসে তিন হাজার টাকা দেওয়া উচিত। নিষেধাজ্ঞার সময়ের পর অবৈধ জাল ও বিষটোপ দিয়ে প্রভাবশালীরা মাছ ধরেন বলে অভিযোগ করেন তিনি।

কক্সবাজার মৎস্য শ্রমিক অ্যাসোসিয়েশনের উপদেষ্টা মিজানুর রহমান বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সমুদ্রে প্রায়ই নিম্নচাপ সৃষ্টি হচ্ছে। ফলে জেলেরা মাছ ধরতে যেতে পারছেন না। করোনার সময়ে জেলেরা এনজিও ঋণ পাননি, ফলে তাঁরা দাদন থেকে উচ্চ সুদে ঋণ নিয়েছেন।

কাজ যখন থাকবে না, তখন তাঁদের জন্য প্রণোদনা দিতে হবে বলে জানান জাতীয় শ্রমিক জোটের সাধারণ সম্পাদক নইমুল আহসান। তিনি বলেন, মৎস্যজীবীদের একটি তথ্যভান্ডার তৈরি করার পাশাপাশি জেলেদের পরিচয়পত্র থাকা উচিত। অনেক জেলে সমুদ্রে গিয়ে হারিয়ে যান। তাঁদের পরিবার তা জানেও না।

সামুদ্রিক মৎস্য সম্পদ বাড়াতে আরও বেশি গবেষণার ওপর জোর দেন জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) ন্যাশনাল অপারেশন অফিসার বি এন নাহার।

প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক ফিরোজ চৌধুরীর সঞ্চালনায় গোলটেবিল বৈঠকে আরও বক্তব্য দেন ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস, বাংলাদেশের সহকারী অধ্যাপক রুমানা সুলতানা। তিনি জেলে পরিবারে শিক্ষার প্রসারে কার্যক্রম চালু করার আহ্বান জানান।