Thank you for trying Sticky AMP!!

ঝুলন্তপাড়ার মানুষের দুঃখগাথা

খুলনার দাকোপ উপজেলার শিবসা নদীর তীরবর্তী কালাবগী গ্রামের ঝুলন্তপাড়ার ঘরবাড়ি। এসব ঘরেই বসবাস করছে ভাগ্যাহত মানুষেরা (ইনসেটে)। সম্প্রতি তোলা ছবি l প্রথম আলো

‘জন্মের অভ্যর্থনা এখানে গম্ভীর, নিরুৎসব, বিষণ্ন। জীবনের স্বাদ এখানে শুধু ক্ষুধা ও পিপাসায়, কাম ও মমতায়, স্বার্থ ও সংকীর্ণতায়। ঈশ্বর থাকেন ওই গ্রামে, ভদ্রপল্লীতে। এখানে তাঁহাকে খুঁজিয়া পাওয়া যাইবে না।’
২০ শতকে পদ্মা নদীর তীরবর্তী কেতুপুরসংলগ্ন জেলেপাড়ার মানুষের জীবনচিত্র মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এঁকেছিলেন ঠিক এভাবে।
খুলনার দাকোপ উপজেলার সুতারখালী ইউনিয়নের দক্ষিণে শেষ জনপদ শিবসা তীরের কালাবগী ঝুলন্তপাড়া যেন ২১ শতকের কেতুপুর।
গ্রামটির পূর্বে ভদ্রা, পশ্চিমে শিবসা নদী, তার ওপারে সুন্দরবন। শিবসা নদীর চরের ওপরেই গাদাগাদি করে গড়ে উঠেছে অসংখ্য টংঘর, ঘরের সামনে ছোট একচিলতে পায়ে চলার পথ। কালবৈশাখীর নির্মম ছোবল, শীতের নির্দয় কামড়, খাওয়ার পানির জন্য নিরন্তর সংগ্রাম, রোগ-শোক আর নিদারুণ দারিদ্র্যই ঝুলন্তপাড়াবাসীর অমোচনীয় বিধিলিপি।
সুতারখালী ইউনিয়নের ৮ ও ৯ নম্বর ওয়ার্ডের প্রায় তিন কিলোমিটারজুড়ে এই ঝুলন্তপাড়ায় ৭০০-৮০০ পরিবারের বাস। ভূমিহীন এসব পরিবারের জীবিকা চলে নদী থেকে বাগদা ও গলদার রেণু পোনা সংগ্রহ করে এবং মাছ ধরে। সুন্দরবনে কাঠ, গোলপাতা ও মধু সংগ্রহ করেন এঁদের অনেকেই।
ওই গ্রাম ঘুরে দেখা যায়, পুরো পাড়ার একটি ঘরও মাটির ওপর তৈরি নয়। শিবসার চরে সুন্দরবনের কাকড়াগাছের খুঁটি, শিরীষ কাঠের পাটাতন এবং গোলপাতার বেড়া দিয়ে তৈরি টংঘরে বাস করেন তাঁরা। ওই ঘরেই চলে রান্না-খাওয়া-ঘুমানো—সবই। প্রায় প্রতিটি ঘরের কাছে অলস পড়ে আছে নেটজাল ও নৌকা। প্রতিটি ঘরের সঙ্গেই লাগানো ঝুলন্ত শৌচাগার।
কয়েকজন বাসিন্দার সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, বড় আকারের জোয়ার ও ঝড় হলে নির্ঘুম রাত কাটে ঝুলন্তপাড়ার মানুষগুলোর। প্রায়ই জোয়ারের পানি উঠে যায় টংঘরের পাটাতনের ওপর।
আশপাশে ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্রও নেই যে বিপদে সেখানে আশ্রয় মিলবে। চিকিৎসাসেবা নিতে নৌপথে যেতে হয় ৩০ কিলোমিটার দূরের উপজেলা সদরে। সবচেয়ে কাছের মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে যেতে লাগে এক ঘণ্টা। এ পাড়ার অনেকেই স্কুলে গেলেও অভাবের কারণে বাধ্য হয়েছে পড়াশোনায় ছেদ টানতে।
৯ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক ইউপি সদস্য রফিকুল ইসলাম বলেন, তুফান উঠলে ও গোনমুখে (ভরাকটাল) এখানকার মানুষ রাতে ঠিকমতো ঘুমাতে পারেন না। পরিবার ও বাচ্চাদের নিয়ে রাত জেগে তাঁরা বসে থাকেন। তুফান কমলে তারপর ঘুমাতে যান। এ পাড়ার মানুষের জন্য যতটুকু সমর্থন দরকার, তা জোটে না। এখানকার জীবন এত জটিল না যে দেখলে কেউ বুঝবে না।
জানা যায়, ১৯৮৮ সালের প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ের পর থেকেই এই এলাকায় ঝুলন্ত ঘর তৈরি শুরু হয়। তারপর থেকে আস্তে আস্তে এর নাম হয়ে গেছে ঝুলন্তপাড়া। এরপর সাত-আট দফায় নদীভাঙনে বসতি জমি চলে গেছে শিবসার পেটে। এরপর সিডর ও আইলার আঘাতে বসতভিটা আর রাস্তা ভেঙে যাওয়ায় ঝুলন্তপাড়ার পরিধি শুধু বেড়েই চলেছে।
শিবসার তীরবর্তী কালাবগী গ্রামের আদি মানচিত্রের কথা জানতে চাইলে ঝুলন্তপাড়ার বাসিন্দা আবুল সরদার (৭১) ও তাহের সানা (৭৫) জানালেন, একসময়ের কালাবগী গ্রামের অনেকটাই এখন সুন্দরবনের অংশ। নদীর ভাঙা-গড়ার খেলায় তাঁদের পূর্বপুরুষদের আবাদি জমি এখন বন বিভাগের নিজস্ব সংরক্ষিত এলাকা। নদীর ওপারে নতুন করে গড়ে ওঠা সুন্দরবনের দিকে আঙুল তুলে আবুল সরদার দেখালেন, তাঁর দাদার ১৮ একর জমি এখন ওই সুন্দরবনের পেটে। আর প্রমত্তা শিবসা নদীও গতিপথ পরিবর্তন করে তাঁদের দিকে এগিয়ে এসেছে।
ওই পাড়ায় সবুজের কোনো চিহ্ন চোখে পড়ল না। একটা গাছও নেই সেখানে। প্রচণ্ড দাবদাহের মধ্যে গত শনিবার দুপুরে একটি টংঘরে গিয়ে পানি চাইতেই লজ্জাবনত মুখে মিনাজ গাজী বললেন, ‘খাওয়ার পানির খুব কষ্ট, ভাই। আজ আমাদের ঘরের পানি ফুরিয়ে গেছে। দেখি পাশের কারও বাড়ি থেকে এনে দিতে পারি কি না।’
তিনি বলেন, খুব বেশি তৃষ্ণা না পেলে এই এলাকার মানুষ পানি খায় না। দুই কিলোমিটার দূর থেকে রান্নার পানি আনতে হয়। খাওয়ার পানি আনতে হয় অন্য উপজেলা থেকে। খুলনা থেকে ৩০ টাকা করে ড্রাম পানি কিনে খেতে হয়।
ওই পাড়ার মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সরকার নদী থেকে পোনা আহরণ নিষিদ্ধ করায় এবং বিকল্প কর্মসংস্থান না থাকায় দারিদ্র্যের বোঝাটা আরও বেড়েছে। সরকারিভাবে জেলে কার্ড দেওয়ার কথা থাকলেও এখনো পর্যন্ত তাঁরা তা পাননি। অধিকাংশ পরিবার এই এলাকায় আর থাকার মতো উপযোগী মনে করছে না।
গ্রামের একজন গোলজার হোসেন সানা বলেন, ‘আমাগো চিন্তার শ্যাষ নি। কখন দুর্যোগ আঘাত হানে, সকাল হলি খাব কী? পানি কেনব কী দিয়ে, চাল কেনব কী দিয়ে? কিচ্ছু নি যে অন্যখানে যাব। মাছ ধরা বন্ধ। বনে যাওয়া যাচ্ছে না। আয়ের অন্য সব পথও বন্ধ। পানির ওপর ঘর। বাইরে কাজে যাতি ভয় হয়, কখন কী হয়। জেলে কার্ড পালি অনন্ত কিছুদিন বাঁচতি পারতাম।’
তারপরও জীবন বাঁচাতে জীবিকার টানে গত কয়েক বছরে এখানকার শতাধিক পরিবার এলাকা ছেড়ে পার্বত্য অঞ্চল, শহরাঞ্চল ও ভারতে চলে গেছে বলে জানালেন এলাকাবাসী।
এখানকার অভাবের চিত্র আরও স্পষ্ট হয় পাড়ার মুদি দোকানদার তৈয়ুবুর রহমান সানার কথায়। তিনি বলেন, ‘কারও ঘরে তেমন চাল নেই। নদীতে যাওয়াও বন্ধ। বাকিতে চাল নেওয়ার জন্য এলাকার মানুষ হাত-পা ধরছে। কেউ আমাদের কথা বলে না, জানে না। দুঃখও কমে না।’