Thank you for trying Sticky AMP!!

টিএসসি-দোয়েল চত্বরের গাছগুলো যেন কথা বলছে

মেট্রোরেলের স্টেশন নির্মাণের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি থেকে দোয়েল চত্বর পর্যন্ত কয়েকটি গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। ছবি: সংগৃহীত

ফেসবুকে হঠাৎ একটা ছবি দেখে রীতিমতো চমকে গিয়েছিলাম। ছবিতে দেখলাম গাছের কয়েকটি খণ্ড অগোছালোভাবে রাস্তায় পড়ে আছে। পাশ দিয়ে বহমান ছিল গাছগুলো থেকে নির্গত রক্তিম জলধারা। এটা দেখে চিত্তে বিরহপূর্ণ এক দৃশ্যপটের উদ্রেক হলো। ছবিটা দেখে মনে হলো কাছের কয়েকজন বন্ধুকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে শরীর খোঁচানে হয়েছে, আপন বেগে বয়ে চলছে টগবগে রক্ত, আর ক্ষতবিক্ষত নিথর দেহগুলো নির্জন স্থানে পড়ে রয়েছে, দেখার ও ধরার যেন কেউ নেই। চিত্তে সৃষ্ট দৃশ্যটা যেন এমনই ছিল।

হ্যাঁ, বলছিলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি থেকে দোয়েল চত্বর পর্যন্ত কেটে ফেলা গাছগুলোর কথা। যেগুলো যানজটের এ শহরে লাখো মানুষের স্বপ্নের সেই উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত মেট্রোরেল প্রকল্প, MRT Line -6 এর স্টেশন নির্মাণের জন্য কেটে ফেলা হয়েছে।

প্রকল্প পরিকল্পনা অনুযায়ী, মেট্রোরেল চালু হলে দুই দিক থেকে ঘণ্টায় প্রায় ৬০ হাজার যাত্রী পরিবহন করা সম্ভব হবে। ২০.১ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এই প্রকল্পের গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোতে ১৬টি স্টেশন থাকবে। ফলে, ঢাকা শহরের যানজট অনেকটাই হ্রাস পাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। আর ১৬টি স্টেশনের একটি হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা, সামাজিক বিজ্ঞান, কলা ও বিজ্ঞান অনুষদ, সেন্ট্রাল লাইব্রেরি, সায়েন্স লাইব্রেরি, পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান বিভাগ, উচ্চতর বিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্রসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার পাশ দিয়ে মেট্রোরেল লাইন থেকে সৃষ্ট শব্দদূষণ ও বহিরাগতদের অবাধ বিচরণের আশঙ্কায়, শুরু থেকেই একটি পক্ষ ক্যাম্পাসের ভেতর দিয়ে লাইন না নেওয়া ও স্টেশন না নির্মাণের ব্যাপারে বিভিন্ন যুক্তি তুলে ধরে, এর বিরুদ্ধাচরণ করেছে। আবার অনেকেই এর পক্ষে যুক্তি উপস্থাপন করে বলেছেন যে ক্যাম্পাসে একটা স্টেশন থাকলে শিক্ষার্থীদের কোনো ক্ষতি হবে না বরং উপকারই হবে। তাদের যানজটের অসুবিধা ভোগ করতে হবে না। সহজেই ক্যাম্পাসে আসা-যাওয়া করতে পারবে।

এত আলোচনা-সমালোচনার মধ্যেই শুরু হয় মেট্রোরেলের নির্মাণকাজ। এরই ধারাবাহিকতায় বর্তমানে পরিকল্পিত টিএসসি স্টেশন নির্মাণকাজেরও অগ্রগতি হয়েছে। বর্তমানে করোনা সংকটে, লকডাউনের মধ্যেই স্টেশন নির্মাণের জন্য, টিএসসি এলাকার অনেকগুলো গাছ ইতিমধ্যে কেটে ফেলা হয়েছে। এ সময় শিক্ষার্থীরা বাড়িতে অবস্থান করার পরও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে, আন্দোলন ও সমালোচনার ঝড় তুলেছে। গাছ কাটার জন্য অনেকে টিএসসি এলাকায় নির্মল ও প্রাকৃতিক পরিবেশ নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। কেউ কেউ বলেছেন, ওখানে এতগুলো গাছ কাটার প্রয়োজন ছিল না, তবু কাটা হয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আখতারুজ্জামান স্যার বলেছেন, ‘জাতীয় কাজের জন্য যেটা লাগবে, সেটা কাটতে হবে। তবে জাতীয় স্বার্থের বাইরে একটি গাছ কাটলেও আমি ব্যবস্থা নেব।’ তা ছাড়া তিনি পরবর্তী সময়ে টিএসসির সৌন্দর্যবর্ধনের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের আশ্বাস দিয়েছেন।

বৃক্ষশূন্য এ ঢাকা শহরের মাঝে, ক্যাম্পাসের কয়েক দশকের এই গাছগুলো এই এলাকার সৌন্দর্যবর্ধনে ও প্রকৃতিকে ঠিক রাখতে পরম বন্ধুর মতো ভূমিকা পালন করেছে। এ গাছগুলোর সঙ্গে লাখো মানুষের স্মৃতি রয়েছে। প্রতিটি গাছের গোড়া, প্রতিটি ডাল ও পাতা যেন অনেকেরই চিরপরিচিত। প্রখর রোদে কার্জনে যাওয়া ও চানখারপুল থেকে টিউশন করিয়ে আসার সময়কার মায়াভরা শীতল ছায়ার উৎস হলো এরা। মেট্রোরেলের কাজ নিঃসন্দেহে আমাদের জাতীয় স্বার্থ। দেশের একটা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ও জাতীয় প্রতিষ্ঠান। বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বার্থও কিন্তু জাতীয় স্বার্থ। এদিক বিবেচনায়ও প্রতিষ্ঠানের ভেতরে রেললাইন, স্টেশন ও গাছ কাটার ব্যাপারে বিকল্প কিছু চিন্তা করা উচিত ছিল। জাতীয় স্বার্থে আমরা বায়ান্নতে এবং একাত্তরে জীবন দিয়েছি। এখনো সব ধরনের ত্যাগ স্বীকার করতে রাজি আছি। তবু আপন এ গাছগুলোর জন্য কেমন যেন মায়া লাগছে। ওদের কেন যেন ভোলা যাচ্ছে না। ওরা যেন কষ্টে আর্তনাদ করছে। মরেও ওরা যেন কথা বলছে।

*লেখক: শিক্ষার্থী, শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়ন বিভাগ, হাজী মুহম্মদ মুহসীন হল, ঢাবি