Thank you for trying Sticky AMP!!

ডেঙ্গুতে শিশুমৃত্যু বেশি হচ্ছে

>যে দেশে একবার ডেঙ্গু ঢোকে, সে দেশ থেকে এই রোগ চিরতরে বিদায় হয় না। মানুষকে সচেতন করে ডেঙ্গুর প্রকোপ কমানোই এখন প্রধান চ্যালেঞ্জ।

ডেঙ্গু জ্বরে দেশে যত মানুষ মারা যাচ্ছে, তার অর্ধেকের বেশি শিশু। চলতি বছরের প্রথম ৯ মাসে ডেঙ্গুতে মারা গেছে ১৭ জন। এর মধ্যে শিশু ৯ জন। চার ধরনের ডেঙ্গু ভাইরাসের মধ্যে ডেন-৩ নামের ভাইরাসে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। যেসব রোগী দ্বিতীয়বার ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছে, তাদের পরিস্থিতি অত্যন্ত জটিল। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা বলছেন, ডেঙ্গু দেশ থেকে যাবে না। তাই সচেতনতা ও সঠিক চিকিৎসার মাধ্যমে এই রোগ মোকাবিলা করা জরুরি হয়ে পড়েছে। 

ঢাকা মেডিকেল কলেজের মেডিসিন বিভাগের সাবেক অধ্যাপক কাজী তারিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, রাজধানী ঢাকায় ডেঙ্গু পরিস্থিতি বেশ জটিল আকার ধারণ করেছে। রোগের ধরনের পরিবর্তন হচ্ছে। এতে আগের চেয়ে বেশি মানুষ মারা যাচ্ছে।

সরকারের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম থেকে গত বৃহস্পতিবার পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৯ মাসে ডেঙ্গুতে মোট ১৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। গত ১৫ বছরের মধ্যে ডেঙ্গুতে এবারই সর্বোচ্চসংখ্যক মানুষের মৃত্যু হয়েছে। চলতি বছরে এ পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে ৬ হাজার ৮৭৭ জন। আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা আরও বাড়ার আশঙ্কা আছে। অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে একটি শিশু মারা গেছে। তার স্বাস্থ্য পরীক্ষার ফলাফল এখনো সরকারের নিয়ন্ত্রণকক্ষে এসে পৌঁছায়নি। চিকিৎসকেরা ধারণা করছেন, শিশুটির মৃত্যুর কারণ ডেঙ্গু হতে পারে। ধারণা সঠিক হলে মৃত্যুর সংখ্যা ১৮ হবে।

হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা চিকিৎসক আয়শা আক্তার বলেন, ১৪টি সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত হাসপাতাল এবং ৩৫টি বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে ডেঙ্গুতে মৃত্যু ও আক্রান্তের তথ্য হালনাগাদ করা হয়। ওই হাসপাতালগুলো ডেঙ্গুসহ আরও কিছু সংক্রামক রোগে আক্রান্ত রোগীর তথ্য সরকারকে পাঠায়।

তবে ডেঙ্গু রোগে মৃত্যু ও আক্রান্তের সংখ্যা নিয়ে সরকারের দেওয়া পরিসংখ্যান পূর্ণাঙ্গ নয় বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা। বিষয়টি অস্বীকার করেননি স্বাস্থ্য খাতের সরকারি কর্মকর্তারাও। তাঁরা বলছেন, দেশের সব হাসপাতাল ও ক্লিনিক যেন সংক্রামক রোগের তথ্য সরকারকে জানায় সে জন্য রোগ নিয়ন্ত্রণ দপ্তর থেকে সব জেলার সিভিল সার্জনদের সম্প্রতি চিঠি দেওয়া হয়েছে।

ডেঙ্গু রোগে আক্রান্তের সংখ্যা জানা পরিসংখ্যানের চেয়ে অন্তত ১০ গুণ বেশি হবে বলে মনে করেন মেডিসিন বিশেষজ্ঞ কাজী তারিকুল। তিনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ডেঙ্গু–বিষয়ক জাতীয় নির্দেশিকার তৃতীয় ও চতুর্থ সংস্করণের প্রধান সম্পাদকও। এই চিকিৎসক প্রথম আলোকে বলেন, অনেক সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এবং চিকিৎসকদের ব্যক্তিগত চেম্বারের তথ্য সরকারের কাছে আসছে না। এই রোগ নিয়ে আতঙ্কিত না হয়ে মানুষকে সচেতন হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।

ডেঙ্গুতে মৃত ব্যক্তিদের বয়স বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ৯ জনের বয়স ১২ বছরের কম। সবচেয়ে কম বয়সী শিশুটি ছিল ১ বছর ৭ মাসের। সবচেয়ে বেশি বয়সী ছিলেন ৫৫ বছর বয়সী মহিলা। মৃতদের মধ্যে ২৭ বছর বয়সী একজন চিকিৎসকও আছেন।

ডেঙ্গুতে শিশুরা কেন বেশি মারা যাচ্ছে—এই প্রশ্নের উত্তরে ঢাকা মেডিকেল কলেজের শিশু বিভাগের সাবেক প্রধান অধ্যাপক আবিদ হোসেন মোল্লা প্রথম আলোকে বলেন, শিশুর রোগ প্রতিরোধ বা রোগের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার ক্ষমতা বয়স্কদের তুলনায় কম।

রোগের ধরনে পরিবর্তন

ডেঙ্গু ভাইরাসজনিত রোগ। এডিস মশা এই ভাইরাস ছড়ায়। ডেঙ্গুর চার ধরনের ভাইরাস (সেরোটাইপ) আছে: ডেন-১, ডেন-২, ডেন-৩ ও ডেন-৪। সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) অন্যান্য রোগের সঙ্গে ডেঙ্গু পরিস্থিতির ওপর নজর রাখছে। আইইডিসিআর বলছে, এই চার ধরনের ভাইরাসই বাংলাদেশে আছে। ২০০০ সালে বাংলাদেশে প্রথম ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। এই সময় ডেন-১, ডেন-২, ডেন-৩ ও ডেন-৪ ভাইরাসেই মানুষ আক্রান্ত হয়েছিল। একধরনের ভাইরাসে দ্বিতীয়বার আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে না। কারণ, মানুষের শরীরে ভাইরাসটির প্রতিরোধক্ষমতা প্রাকৃতিকভাবেই তৈরি হয়। তবে অন্য তিন ধরনের ভাইরাসে আক্রান্ত হতে পারে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি) অধ্যাপক সানিয়া তাহমিনা প্রথম আলোকে বলেন, ডেন-৩ বেশি বিপজ্জনক। এ বছর ডেন-৩–এ আক্রান্ত হচ্ছে বেশির ভাগ মানুষ।

তবে এবার বিপদের কারণ হলো, অনেক রোগী পাওয়া যাচ্ছে, যারা দ্বিতীয়বার আক্রান্ত। আইইডিসিআরের সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞানীরা বলেছেন, মারা গেছে বা যেসব রোগী মারাত্মক অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে, তাদের অধিকাংশের ইতিহাস বলছে, তারা আগেও আক্রান্ত হয়েছিল।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দ্বিতীয়বার আক্রান্ত হওয়ার প্রতিক্রিয়া অনেকটা সুনামির মতো। প্রথমবারের চেয়ে দ্বিতীয়বারের ভয়াবহতা প্রায় ২০০ গুণ বেশি। অল্প সময়ের মধ্যে রক্তক্ষরণ দেখা দিতে পারে। অনেক রোগীর পেটে বা বুকে পানি জমে যায়। দ্বিতীয়বারে আক্রান্ত ব্যক্তিদের মৃত্যুর হারও বেশি।

একবার যে দেশে ডেঙ্গু ঢোকে সে দেশ থেকে ডেঙ্গু চিরতরে বিদায় হয় না বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা। তাঁরা বলছেন, ডেঙ্গু প্রতিরোধে জনসচেতনতা বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। ২০০০ সালে সরকার ও নাগরিক সমাজ মানুষকে সচেতন করার বড় উদ্যোগ নিয়েছিল। এখনো সেই ধরনের উদ্যোগের প্রয়োজন।

চিকিৎসকদের পরামর্শ হচ্ছে, জ্বর হলে কোনো অবহেলা করা যাবে না। প্যারাসিটামল ছাড়া অন্য কোনো ব্যথানাশক ওষুধ সেবন করাও ঠিক হবে না। দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।