Thank you for trying Sticky AMP!!

ডেঙ্গুর ব্যয়ভার কত শ কোটি টাকায় ঠেকবে

মোহাম্মদ লিমন ফরিদপুরের রাজেন্দ্র কলেজের ব্যবস্থাপনা বিভাগের স্নাতক (সম্মান) শেষ বর্ষের ছাত্র। ঢাকায় চাচার বাসায় বেড়াতে এসে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হন। ১৫ থেকে ২২ আগস্ট পর্যন্ত রাজধানীর শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। সরকারি ওই হাসপাতালে বিনা মূল্যে চিকিৎসা হয়। তারপরও কৃষক পরিবারটির ডেঙ্গু-খরচা নেহাত কম হয়নি।

লিমন সুস্থ হয়ে ফিরেছেন। চিকিৎসা নিয়ে তিনি সন্তুষ্ট। প্রথম আলোকে লিমন বলেন, ‘সরকারি হাসপাতাল, তাই মোটামুটি সব ফ্রি। ওষুধ ফ্রি, ডাক্তার ফ্রি, টেস্ট ফ্রি।’ তবে চারটি পরীক্ষা বাইরে করাতে হয়েছে। হাসপাতালের খাবার মুখে রুচত না। পথ্য বাড়ি থেকে আনতে আর কিনতে হয়েছে। সব মিলিয়ে ১০ হাজার টাকার বেশি খরচ হয়েছে। আবার দেখাশোনা করতে লিমনের মা ও এক বন্ধুকে ঢাকায় এসে থাকতে হয়েছে। এসবের এবং মায়ের কাজের ক্ষতির অর্থমূল্য হিসাব করা হয়নি। নিজের ও বন্ধুর পড়াশোনার ক্ষতি তো আছেই।

ঢাকায় মোহাম্মদপুর শেখেরটেকের বাসিন্দা ফারজানা চৌধুরীর সরকারি হাসপাতাল পছন্দ নয়। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে তিনি ১৫ আগস্ট শ্যামলীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হন। ২১ আগস্ট হাসপাতাল ছেড়ে যাওয়ার আগে ৫৫ হাজার ১২৩ টাকা বিল মিটিয়েছেন। খরচের খাতগুলোর মধ্যে আছে ভর্তি ফি, শয্যাভাড়া, পরীক্ষা ফি, ডাক্তার ফি, ওষুধ ও খাবারের খরচ। এ প্রতিবেদক আনুষঙ্গিক খরচগুলোর হিসাব জানার জন্য পরিবারটির সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেননি।

সরকারি ও নানা স্তরের বেসরকারি হাসপাতালে অথবা বাড়িতে রেখে ডেঙ্গু চিকিৎসায় মানুষকে কত খরচ করতে হচ্ছে। রোগীর মোট সংখ্যার নিরিখে এযাবৎ ডেঙ্গুর ব্যয়ভারই–বা কত দাঁড়িয়েছে। এ দুটি প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে প্রথম আলো জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য-অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ও সাবেক পরিচালক সৈয়দ আবদুল হামিদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল।

এরই সুবাদে ইনস্টিটিউট ‘বাংলাদেশে ডেঙ্গু রোগীর অর্থনৈতিক বোঝা’ শিরোনামে একটি সমীক্ষা শুরু করেছে। চলমান এই সমীক্ষার ১৭ আগস্ট পর্যন্ত করা খসড়া হিসাব বলছে, এযাবৎ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত জনগোষ্ঠীর প্রায় ২০৪ কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। এর মধ্যে মৃত্যুজনিত দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির হিসাবও আছে।

তবে সমীক্ষাটি ডেঙ্গু বাবদ সরকারের ক্ষতি বা গচ্চার হিসাব করেনি। এমনিতে গত অর্থবছরে লার্ভা ও মশা মারতে ঢাকা দক্ষিণ ও ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের বরাদ্দ ছিল যথাক্রমে ২৬ ও ২৫ কোটি টাকা। ইতিমধ্যে একাধিক গবেষণা আর বাস্তব পরিস্থিতি বলে দিয়েছে, মশকনিধনে এসব ওষুধ ছিল অকার্যকর।

ভাইরাস বিশেষজ্ঞ নজরুল ইসলাম বলছেন, সময়মতো এডিস মশা প্রতিরোধ না করায় মানুষ এই ক্ষতির মধ্যে পড়েছে। এই ব্যর্থতার দায়িত্ব ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন এবং সরকারের সংশ্লিষ্ট সব কটি দপ্তরের। অন্য কোনো দেশে হয়তো প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হতো।

ডেঙ্গুর ব্যয়ভার জানতে অধ্যাপক আবদুল হামিদের নেতৃত্বে শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন দল গত প্রায় এক মাসে ঢাকা শহরের সরকারি-বেসরকারি ১০টি হাসপাতালে ঘুরেছে। খরচের হিসাব করতে গিয়ে বেসরকারি হাসপাতালগুলোকে ক ও খ শ্রেণিতে ভাগ করা হয়েছে। নমুনা হিসেবে সমীক্ষাটি এযাবৎ সরকারি হাসপাতালের নয়জন এবং বেসরকারি ক শ্রেণির হাসপাতালের পাঁচজন ও খ শ্রেণির হাসপাতালের ২৪ জন রোগীর খরচের হিসাব নিয়েছে।

স্কয়ার, ইউনাইটেড, অ্যাপোলো, আজগর আলী হাসপাতালের মতো হাসপাতালগুলোকে ক শ্রেণিতে ধরা হয়েছে। আর খ শ্রেণির মধ্যে আছে পপুলার, সেন্ট্রাল, ইবনে সিনা, ল্যাবএইডের মতো হাসপাতালগুলো।

অধ্যাপক হামিদ প্রথম আলোকে বলেন, দেশজুড়ে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত সব রোগীর ব্যয়ের হিসাব এই বিশ্লেষণে অন্তর্ভুক্ত করা যায়নি। সব বেসরকারি হাসপাতালের রোগীর তথ্য তাঁরা পাননি। হাসপাতালগুলোর বহির্বিভাগে চিকিৎসা নেওয়া অসংখ্য রোগীর তথ্যও পাওয়া যায়নি। ঠিক যেমন চেম্বারে ডাক্তার দেখিয়ে বাড়িতে চিকিৎসা করানো রোগীর খরচও দেখা হয়নি। ঢাকার বাইরের কোনো বেসরকারি হাসপাতালের হিসাবই করা হয়নি।

টাকার অঙ্কে

সমীক্ষার খসড়া বিশ্লেষণ অনুযায়ী, সরকারি হাসপাতালে একজন রোগীর চিকিৎসা খরচ পড়ছে সাড়ে ৫ হাজার টাকার কাছাকাছি। বেসরকারি ক শ্রেণির হাসপাতালে এ খরচ দেড় লাখ টাকা। বেসরকারি খ শ্রেণির হাসপাতালে একই খরচ সাড়ে ৫৩ হাজার টাকা। এই খরচের মধ্যে আছে ডাক্তারের ফি, পরীক্ষা–নিরীক্ষা খরচ, ওষুধের খরচ, পথ্য ক্রয়ের খরচ, যাতায়াত খরচ, হাসপাতাল বিল ইত্যাদি।

সৈয়দ আবদুল হামিদ বলেন, এর ওপরে আছে পরোক্ষ ব্যয়। এই খরচও কম নয়। তবে মানুষ সচরাচর এটা হিসাবে ধরে না। গবেষকেরা কিন্তু সেই খরচও হিসাব করেছেন।

প্রথমত, হাসপাতালে রোগীর দেখাশোনার জন্য গড়ে দুজনকে থাকতে হয়। দ্বিতীয়ত, ডেঙ্গু রোগীকে গড়ে ৮ দিন হাসপাতালে থাকতে হচ্ছে। তাঁদের এই সময়েরও অর্থমূল্য আছে। গবেষকেরা বর্তমান বার্ষিক মাথাপিছু গড় আয়ের ভিত্তিতে রোগীসহ তিনজনের সময়ের সার্বিক দাম হিসাব করেছেন। এটাকে তাঁরা বলছেন পরোক্ষ ব্যয়।

একইভাবে, মৃত্যু শুধু মৃত্যু নয়। মৃত্যুর মধ্য দিয়ে কর্মক্ষম মানুষের বাকি জীবনের কর্মদিবস নষ্ট হয়ে যায়। সেটারও আর্থিক মূল্য আছে। বর্তমান মাথাপিছু আয়ের নিরিখে গবেষকেরা সেটারও পরিমাপ করেছেন।

গবেষণাটি গত ১ জানুয়ারি থেকে ১৭ আগস্ট পর্যন্ত ডেঙ্গু নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি মোট রোগীর সংখ্যা ধরেছে ৫১ হাজার ৫০০। সংখ্যাটি প্রথম আলো গবেষকদের দিয়েছে। এই সংখ্যা এবং কোন হাসপাতালে কত রোগী ভর্তি, সে হিসাব প্রথম আলো পেয়েছে সরকারের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশনস সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের কাছ থেকে।

কন্টোল রুম তাদের নজরদারিতে থাকা ঢাকার সরকারি ও বেসরকারি ৪০টি হাসপাতাল এবং ৬৪ জেলার সিভিল সার্জনদের কাছ থেকে তথ্য নিয়ে এ হিসাব রাখে। ঢাকার বাইরের বেসরকারি হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীর কোনো হিসাব রাখা হয় না।

কন্ট্রোল রুমের হিসাবে ১৭ আগস্ট পর্যন্ত সরকারি হাসপাতালে ভর্তি হওয়া মোট রোগীর সংখ্যা ছিল প্রায় ৩৭ হাজার। তালিকার বেসরকারি হাসপাতালগুলোর রোগীর সংখ্যা গবেষকেরা ‘ক’ ও ‘খ’ শ্রেণির হিসাবে ভেঙে নিয়েছেন। তাতে ক শ্রেণিতে রোগী ছিল ৩ হাজারের কিছু বেশি। খ শ্রেণিতে ছিল সাড়ে ১১ হাজারের মতো।

সমীক্ষায় প্রতি শ্রেণির জন্য যে গড় খরচ এসেছে, সেগুলো ধরে হাসপাতালের ধরনভেদে রোগীর মোট ব্যয়ভার নির্ণয় করা হয়েছে। এই হিসাবে সরকারি হাসপাতালের রোগীরা সংখ্যায় অনেক গুণ বেশি হয়েও চিকিৎসা বাবদ খরচ করেছে ২০ কোটি টাকা। বেসরকারি ক শ্রেণির হাসপাতালের রোগীদের খরচ হয়েছে তার দ্বিগুণের কিছু বেশি। আর খ শ্রেণির হাসপাতালের রোগীরা বিল দিয়েছে সরকারি হাসপাতালের তিন গুণ বেশি টাকা।

তিন শ্রেণির হাসপাতালের বিল বাবদ রোগীরা মোট খরচ করেছে ১২৮ কোটি টাকা। মোট পরোক্ষ ব্যয় ৫৪ কোটি টাকা। এদিকে সরকারি হিসাবে ১৭ আগস্ট পর্যন্ত ডেঙ্গুতে ৪০ জনের মৃত্যু হয়েছিল। এদের গড় বয়স ছিল ৩০ বছর। গড় আয়ুর নিরিখে তাদের প্রত্যাশিত কর্মক্ষম সময়ের অর্থনৈতিক ক্ষতি দাঁড়ায় প্রায় ২৩ কোটি টাকা।

বেহিসাবি প্রতিরোধ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চলমান সমীক্ষায় ডেঙ্গু প্রতিরোধে মানুষের খরচটা ধরা হয়নি। অর্থনীতিবিদ হোসেন জিল্লুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, রোগ প্রতিরোধের খরচ সাধারণভাবে সরকারেরই বহন করার কথা। কিন্তু ডেঙ্গুর ক্ষেত্রে মানুষকে এ খাতেও প্রচুর খরচ করতে হচ্ছে।

এ বছরের জুলাই মাস থেকে ডেঙ্গুর প্রকোপ ব্যাপক হয়। ক্রমে ৬৪ জেলায় ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়ে। একদিকে যেমন হাসপাতালগুলো রোগীর চাপে বেসামাল হয়ে পড়ে, অন্যদিকে মশকনিধনসামগ্রীর বাজারদর পাল্লা দিয়ে বাড়ে।

২৯ জুলাই প্রথম আলো আয়োজিত গোলটেবিল বৈঠকে ঢাকার একজন গৃহিণী সঙ্গীতা রহমান বলেছিলেন, ‘আমাদের এখন খাবারের খরচের চেয়ে মশার পেছনে বেশি খরচ হচ্ছে।’ তাঁর ১০ বছরের মেয়ে রুজাইনা ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়ার পর থেকে তাঁরা আতঙ্কে আছেন। মেয়েকে হাসপাতাল থেকে বাড়িতে আনার পরও ভয় কাটেনি।

সঙ্গীতার পরিবারটি মশা মারার জন্য কয়েল, মশকনিধনকারী কীটনাশক স্প্রে শরীরে লাগানোর মলম কিনছে। কীটনাশকের জন্য রাতে শ্বাসকষ্ট হয়। খরচ তো বাড়ছেই। মানুষ ব্যক্তিগত সুরক্ষার জন্য মশা মারার ব্যাট আর মশারিও কিনছে।

ওষুধ ও কীটনাশক প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান এসিআইয়ের মশা মারার স্প্রের নাম অ্যারোসল। কামরুল হাসান প্রতিষ্ঠানটির ব্যবসাবিষয়ক পরিচালক। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এই সময় অ্যারোসল বিক্রির পরিমাণ তিন থেকে চার গুণ বেড়েছে। তাঁদের হিসাবে দেশে মশানাশক স্প্রের বাজারের ৯৭ শতাংশ এসিআইয়ের দখলে।

ঢাকার ফ্রি স্কুল স্ট্রিটে মো. আবদুল্লাহ্‌ আল মামুনের মুদিদোকানটি বেশ বড়। গতকাল এ প্রতিবেদককে তিনি বলেছেন, দুই মাস ধরে তাঁর দোকানে মশার কয়েল আর স্প্রে অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে তিন গুণ বেশি বিক্রি হচ্ছে।

অ্যারোসলের সবচেয়ে বড় ক্যানটির দাম ৪৫০ টাকা। ভারতীয় ছোট ক্যানের দামই প্রায় ৩০০ টাকা। কয়েলের দাম ৫০ থেকে ৮০ টাকা। কারওয়ান বাজারে মশারির দাম ২০০ থেকে ৩৫০ টাকা। ভারতীয় মশানিরোধক যে মলমের দাম ৪৮ রুপি, ফার্মগেটের দোকানে তার দাম ৪০০ টাকা। ডেঙ্গু রোগীর পথ্য কমলাজাতীয় ফল, ডাব, বোতলজাত ফলের রস বা নানা ধনের কোমল পানীয়রও বিক্রি আর দাম দুটোই বেড়েছে।

টাকায় মাপা কঠিন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকেরা বলছেন, এসব অর্থনৈতিক ক্ষতির সঙ্গে আছে হয়রানি আর আতঙ্কের চাপ (সাইকোলজিক্যাল ট্রমা)। সেই ক্ষতি টাকার অঙ্কে মাপা কঠিন।

মো. শাহেদ রফি নিজে একজন ডাক্তার। গত ৫ জুলাই রাজধানীর ক শ্রেণির একটি বেসরকারি হাসপাতালে তাঁর একমাত্র ছেলে সাত বছরের ইরতিজা সাহাদ ডেঙ্গুতে ভুগে মারা যায়। ডা. শাহেদ হাসপাতালের বিল দিয়েছেন প্রায় দুই লাখ টাকা। কিন্তু গতকাল প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘ছেলের মৃত্যুর ক্ষতি আমি কী করে হিসাব করব? এই ক্ষতির কোনো হিসাব করা সম্ভব না।’