Thank you for trying Sticky AMP!!

ঢাকার উপকণ্ঠ ছিল ওয়ারী

বলধা গার্ডেন। পুরান ঢাকার একমাত্র উদ্ভিদ উদ্যান। ঢাকার বিভিন্ন এলাকা থেকে সেখানে যায় দর্শনার্থীরা l প্রথম আলো

ওয়্যার, ১৮৮৪ সালে ঢাকার ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন। তাঁর নামানুসারে ঢাকা শহরের তৎকালীন উপকণ্ঠ এলাকাটি পরিচিত হয়ে উঠেছিল উয়ারী বা ওয়ারী হিসেবে। আঠারো শ আশির দশকে ওয়ারীর সাত শ এক সরকারি খাসজমিতে চাকরিজীবীদের জন্য আবাসিক এলাকা গড়ে তোলে ইংরেজ সরকার। যেমনটি ষাটের দশকে মধ্যবিত্ত শ্রেণির জন্য ধানমন্ডিকে আবাসিক এলাকা হিসেবে পত্তন করা হয়েছিল।
ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুনের লেখা ঢাকা: স্মৃতি বিস্মৃতির নগরী বইতে আজিমউশশানের একটি উদ্ধৃতিতে পুরান ঢাকার ওয়ারীর এই চিত্র পাওয়া যায়। তবে বর্তমানে ওয়ারী বলতে একটি অভিজাত এলাকাকে বোঝায়। এই এলাকার মানুষের কাছে ওয়ারী পুরান ঢাকার রাজধানী। অর্থাৎ পুরান ঢাকার ঘিঞ্জি এলাকার মধ্যে ওয়ারী এলাকাটি পরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা। এই এলাকার রাস্তাঘাটও বেশ চওড়া, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। সম্প্রতি এই এলাকাটিতে দেশের নামীদামি ব্র্যান্ডের সাজ-পোশাকের অনেক শোরুম, সুপার শপ গড়ে উঠেছে। আছে বলধা গার্ডেন, সলিমুল্লাহ ডিগ্রি কলেজ, জয়কালী মন্দিরসহ ঐতিহ্যবাহী অনেক স্থাপনা।
ওয়ারী এলাকাটি মূলত টিপু সুলতান রোড (উত্তর অংশ) র‍্যাংকিং স্ট্রিট, লারমিনি স্ট্রিট, নবাব স্ট্রিট, হেয়ার স্ট্রিট, ওয়্যার স্ট্রিট, যুগীনগর লেন, জয়কালী মন্দির রোড নিয়ে গঠিত। এই এলাকাটি ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) ৪১ নম্বর ওয়ার্ডের আওতাধীন। তবে একই ওয়ার্ডের লালমোহন সাহা স্ট্রিট, ভজহরি সাহা স্ট্রিট, মদন মোহন বসাক রোড, পদ্মনিধি লেন, হরি স্ট্রিট ল্যান্ড, অকসেন লেন, নারিন্দা রোড, গোয়ালঘাট লেনে ভিন্ন চিত্র দেখা গেছে।
এই এলাকাগুলোর রাস্তাঘটের প্রশস্ততা গড়ে ৮ ফুট। এর মধ্যে পানি ও গ্যাসসংকট রয়েছে। অকেজো হয়ে আছে পয়োনিষ্কাশন লাইন। একমাত্র কমিউনিটি সেন্টারটির ভেতরে চলছে ওয়ারী থানার কার্যক্রম।
এ ছাড়া নারিন্দা শিশুপার্ক দখল করে গড়ে উঠেছে ঢাকা ওয়াসার একটি স্টাফ কোয়ার্টার ও নারিন্দা জুনিয়র লায়ন্স ক্লাব ভবন। দ্বিতল এই ক্লাবটিতে নিয়মিত চলে হাউজির আসর। মহল্লার কেউ প্রতিবাদ করার সাহ পান না। গতকাল বুধবার ওই এলাকাগুলো ঘুরে স্থানীয় বাসিন্দা ও জনপ্রতিনিধির সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।

ওয়ারী: মুনতাসীর মামুনের বইতে বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ ভবতোষ দত্ত ১৯২২ সালে ওয়ারীর যেসব বিবরণ দিয়েছেন তাতে চিত্রটি আরও স্পষ্ট হবে। তিনি লিখেছেন, ‘ওয়ারি ঠিক শহরতলি নয়, কিন্তু শহরের মধ্যে হয়েও একটি ভিন্ন রকমের উপান্তিক না হলেও প্রান্তিক। রাস্তাঘাট পরিচ্ছন্ন, রাস্তায় লোক বেশি নেই, যারা আছে তারাও পোশাকে-পরিচ্ছদে মার্জিত। বাড়িগুলি সুন্দর-একতলাই বেশি, কয়েকটি মাত্র দোতলা, তার প্রত্যেকটি বাড়িতে অনেকটা খোলা জমি।’
ভবতোষ দত্তের বিবরণে আরও আছে, ‘এখানে যারা থাকতেন তারা মধ্যবিত্ত। দু-একজন জমিদার ছাড়া খুব বড় লোক প্রায় কেউ নেই। চরম দরিদ্র্যরা এখানে যেত না। এখানে থাকতেন ডেপুটি, মুনসেফ, জেলা জজেরা।’
তবে গতকাল স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন, এখন ওয়ারীতে সাধারণত উচ্চবিত্ত লোকজনই বেশি বাস করেন। আরেকাংশ বলেছে, এর মধ্যে এক-তৃতীয়াংশ মধ্যবিত্ত আছে।
এই ওয়ার্ডের অন্যান্য এলাকার তুলনায় ওয়ারী এলাকাটি ভিন্ন। রাস্তাঘাট পর্যাপ্ত প্রশস্ত। সড়কগুলোও পরিচ্ছন্ন, মানুষের চলাচল স্বাভাবিক। প্রতি সড়কে আছে বহুতল আবাসিক ও বাণিজ্যিক ভবন। একটি ভবন থেকে আরেকটি ভবনের নির্দিষ্ট দূরত্ব আছে। এর মধ্যে টিপু সুলতান রোডে আছে ঐতিহ্যবাহী দৃষ্টিনন্দন অনেকগুলো পুরান বাড়ি।
র‍্যাংকিন স্ট্রিটের বাসিন্দা আনোয়ার হোসেন (৫৫) বলেন, এখন তিনি যে বাড়িটিতে থাকেন সেটি পাঁচতলা। আগে এই জায়গায় তাঁদের একটি একতলা বাড়ি ছিল। পরিবারের সদস্যসংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় পাঁচ বছর আগে সেটি ভেঙে ফেলা হয়েছে। তিনি বলেন, আগের তুলনায় ওয়ারী অনেক উন্নত হয়েছে। কিন্তু এর বৈশিষ্ট্য পাল্টে গেছে। কোথাও ফাঁকা জায়গা (মাঠ-পার্ক) নেই। তারপরও ওয়ারী মানে অভিজাত, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও পরিকল্পিত এলাকা।

শিশুপার্ক দখল করে ক্লাব, হাউজি: নারিন্দা রোডে বিনত বিবি নারিন্দা বড় মসজিদের দক্ষিণ পাশে ছিল ‘নারিন্দা শিশুপার্ক’। কিন্তু গতকাল এই এলাকায় গিয়ে পার্কের কোনো অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। এই জায়গায় দ্বিতল একটি বড় ভবন গড়ে উঠেছে। এটি নারিন্দা জুনিয়র লায়ন্স ক্লাব নামে পরিচিত। ক্লাবের নিচে বসে আড্ডা দিচ্ছেন এর সদস্যরা। সাংবাদিক পরিচয় পাওয়ার পর তাঁরা ক্লাবের ভেতর ঢুকতে দেননি।
ওই সদস্যরা বলেন, এই ক্লাবের সভাপতি রশিদুল হক ভূঁইয়া ওয়ারী থানা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি। ক্লাবের ভেতর তাঁর অনুমতি ছাড়া ঢোকা যাবে না। এ সময় রশিদুল ক্লাবে ছিলেন না। তাঁর মুঠোফোন নম্বরও তাঁরা দিতে রাজি হননি।
এ ছাড়া এই ক্লাবের পূর্ব পাশে আছে ঢাকা ওয়াসার স্টাফ কোয়ার্টার। কোয়ার্টারে ঢোকার ফটকে তালা।
নারিন্দা রোডের তিনজন বাসিন্দা বলেন, প্রায় ৫০ শতক জায়গার ওপর এই শিশুপার্কটি ছিল। নব্বইয়ের দশকে সেখানে একটি কমিউনিটি সেন্টার নির্মাণ করেছিল সিটি করপোরেশন। এর কয়েক বছর পর কমিউনিটি সেন্টারটি দখল করে নেয় লায়ন্স ক্লাব। অথচ ক্লাবটির কোনো কার্যক্রম নেই। নিয়মিত জুয়ার আসর বসে।

আবদুর রহিম কমিউনিটি সেন্টার: ওয়ারীর টিপু সুলতান রোডের পূর্ব মাথায় রয়েছে আবদুর রহিম কমিউনিটি সেন্টার। এর মধ্যে কমিউনিটি সেন্টারটির তৃতীয় ও চতুর্থ তলায় চলছে ‘ওয়ারী থানার’ কার্যক্রম। দেখা যায়, কমিউনিটি সেন্টারের সামনে ও নিচতলায় পুলিশের জব্দ করা অর্ধশতাধিক মোটরসাইকেল এলোমেলোভাবে রাখা। বর্তমানে কমিউনিটি সেন্টার বলতে শুধু নিচতলার চারপাশ আবদ্ধ একটি মিলনায়তনই ব্যবহৃত হয়। দ্বিতীয় ও চতুর্থ তলার প্রায় অর্ধেক দখল করে বসবাস করছেন ওয়ারী থানার পুলিশ ও আনসার সদস্যরা। দ্বিতীয় তলার একাংশে রয়েছে বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি ও ন্যাশনাল হেলথ কেয়ার নেটওয়ার্কের কার্যালয়। ছাদে পুলিশের ক্যানটিন। নিচতলায় রয়েছে ইকরা মেডিসিন সেন্টার নামের একটি ওষুধের দোকান ও একটি মুদির দোকান৷ পুরো কমিউনিটি সেন্টারটিতে নোংরা ও অপরিচ্ছন্ন পরিবেশ।
টিপু সুলতান রোডের বাসিন্দা সোহরাব হোসেন বলেন, আগে প্রতি মাসে এখানে অনুষ্ঠান হতো ২৫ থেকে ৩০টি। কমিউনিটি সেন্টার ফাঁকা পাওয়া কঠিন ছিল। কিন্তু ২০১২ সালে থানা চালু হওয়ার পর মানুষজন এখানে আর তেমন অনুষ্ঠান করতে আসে না। অবিলম্বে থানার কার্যক্রম সরিয়ে নিতে হবে।

জুয়া বন্ধ করা পুলিশের দায়িত্ব

সারোয়ার হাসান

২০১৫ সালে সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) ৪১ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়েছেন আওয়ামী লীগ-সমর্থিত সারোয়ার হাসান। গতকাল তাঁর ওয়ার্ডের বিভিন্ন সমস্যা-সম্ভাবনা নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি।
প্রথম আলো: ওয়ারীকে নিয়ে আপনার পরিকল্পনা কী?
কাউন্সিলর: ওয়ারীর সঙ্গে ঢাকার ইতিহাস-ঐতিহ্য জড়িয়ে আছে। তাই পুরান ঢাকার অন্যান্য এলাকা থেকে ওয়ারী অনেকটা ভিন্ন। আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর ওয়ারীর সব কটি রাস্তা ও নালা সংস্কার করেছি। ওয়ারীসহ ওয়ার্ডের প্রতিটি সড়কে এলইডি বাতি লাগিয়েছি। প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফ্রি ওয়াইফাইয়ের ব্যবস্থা করেছি। এখন পুরো ওয়ারীকে সিটি ক্যামেরার আওতায় আনতে ২৫ লাখ টাকার একটি কাজ হাতে নিয়েছি। এক মাসের মধ্যে কাজ শুরু হবে। তবে ওয়ার্ডের অন্যান্য এলাকায় আমার নিজস্ব উদ্যোগে লাগানো ২৮টি সিসি ক্যামেরা সচল আছে।
প্রথম আলো: নারিন্দা শিশুপার্কটি দখলমুক্ত করতে কোনো উদ্যোগ নিয়েছেন?
কাউন্সিলর: ছোটবেলায় আমি নিজেও এই শিশুপার্কে খেলাধুলা করেছি। কিন্তু কমিউনিটি সেন্টার ও ওয়াসার কোয়ার্টার নির্মাণের ফলে তা নষ্ট হয়ে গেছে। অথচ আমার মহল্লার শিশু-কিশোরদের আনন্দ-বিনোদনের কোনো স্থান নেই। এই পার্কটি আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে ডিএসসিসিতে আবেদন করব।
প্রথম আলো: লায়ন্স ক্লাবের জুয়ার আসর বন্ধে কোনো উদ্যোগ নেবেন?
কাউন্সিলর: জুয়া খেলা একটি অসামাজিক কাজ। তা বন্ধ করার দায়িত্ব থানা-পুলিশের।
প্রথম আলো: আবদুর রহিম কমিউনিটি সেন্টারটি কবে এলাকাবাসী ব্যবহার করতে পারবে? আপনার কোনো উদ্যোগ আছে?
কাউন্সিলর: বিষয়টি থানাকে একাধিকবার লিখিতভাবে জানিয়েছি। তারা আগামী বছরের মধ্যে অন্যত্র চলে যাবে বলে জানিয়েছে।
প্রথম আলো: গত আড়াই বছরে আপনার ওয়ার্ডে কী কী উন্নয়নকাজ করেছেন?
কাউন্সিলর: প্রায় সাড়ে ৪ কোটি টাকা ব্যয়ে আমার ওয়ার্ডের প্রায় ৮০ ভাগ সড়ক ও নালা সংস্কার করেছি। এখন সংস্কারসহ বিভিন্ন উন্নয়নে আরও প্রায় ৫ কোটি টাকার কাজের দরপত্র ডাকা হবে।