Thank you for trying Sticky AMP!!

ঢাকা ছেড়ে যাওয়া সমস্যা নয়, সমস্যা নির্ভরশীলতায়

২০০০ সালের পর চীনের মোট বাণিজ্যিক মবিলাইজেশনের পরিমাণ ছিল ৫০০ বিলিয়ন ডলার, মাত্র ১৯ বছরে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৫ হাজারে। কী মনে হয়? বেইজিংকেন্দ্রিক অর্থনীতি এর মূলে? একদমই নয়। অতিরিক্ত জনসংখ্যাকে কীভাবে সম্পদে পরিণত করতে হয় তার চমৎকার উদাহরণ হচ্ছে জনবহুল দেশটি।

দু–একটা উদাহরণ দেওয়া যাক—নব্বইয়ের দশকে জেলখানার কয়েদিদের দিয়ে ক্যালকুলেটর বানিয়ে চীন বুঝতে পারে, যে যেখানে আছে তাকে সেখানেই কাজে লাগাতে হবে। পুরো দেশকে তৈরি করতে হবে অর্থনীতির মুক্তাঞ্চল হিসেবে।

বিভিন্ন বিমানবন্দরে লেওভারের টাইমে আমরা ৩-৭ ডলারে যে হোম ডেকরের জিনিসপত্রগুলো কিনি, তা কোথায় তৈরি হয় ধারণা আছে? তার অধিকাংশই নৌকায় তৈরি হয়। শুধু তা–ই নয় হাজারো হস্তশিল্পের ক্ষুদ্র ফ্যাক্টরি আছে চায়নাজুড়ে শুধু নৌকায়, বাসার ছাদে, বাড়ির গ্যারেজে, নিজেদের লিভিং রুমে। মিনিমাম ওভারহেড কস্ট, কোয়ালিটি শ্রম, বাড়তি বিল আর ভাড়ার বোঝা না থাকার কারণে এই পণ্য চায়না স্বল্পমূল্যে আপনার ঘরে পৌঁছে দিচ্ছে, তৈরি করেছে ‘চায়নিজ মনোপলি’।

করোনার প্রকোপে প্রবল অর্থনৈতিক সংকট তৈরি হয়েছে, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বাণিজ্য হারাচ্ছে, চাকরি হারাচ্ছেন সাধারণ শ্রমজীবীরা। প্রতিদিন হাজারো মানুষ ঢাকা শহর ছেড়ে দিচ্ছে, যারা ছাড়ছে, তারা ভাবছে এত বছরেও এই শহরে একটু ঠিকানা হলো না, সব দেওয়ার পরও এই শহর পরই থেকে গেল। আমরা যারা এখনো ছাড়িনি টিকে আছি, প্রচণ্ড ভয়ের মধ্যে দিন পার করছি, নিজেকে কল্পনা করছি ফিউচার ভিকটিম হিসেবে।

এই সময়টায় সবার মনে ঘাপটি মেরে থাকা ভাবনা হচ্ছে—‘বাড়িওয়ালা ভাড়া কমাচ্ছেন না কেন’, ‘সরকার কেন বলছে না আগামী ৬ মাস সব বিল মওকুফ’, ‘যে মানুষগুলো শহর ছেড়ে দিচ্ছে তাদের পাশে কেউ দাঁড়াচ্ছে না কেন’, ‘কোম্পানিগুলো এত বছর ব্যবসা করার পর এখন দুর্দিনে আমাদের দিকে তাকাচ্ছে না কেন’।

আমাদের এই ভাবনাগুলোই ভিন্নভাবে ভাবার সময় এসেছে। আসুন, অন্যভাবে ভাবি—ঢাকায় বাড়িভাড়া এত বেশি কেন, আমার কর সরকার কতটুকু ইফেক্টিভ মেথডে খরচ করছে, ১৬ কোটি মানুষের চার ভাগের প্রায় এক ভাগই রাজধানীতে কেন, কোম্পানিগুলোর কাছে আমাদের শ্রম এত মূল্যহীন কেন ইত্যাদি।

যেখানে চাহিদা অনুযায়ী জোগান অপ্রতুল, সেখানে পণ্যের দাম একতরফা হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি, একটা বাড়ির টু-লেট ঝুললে প্রতিদিন এভারেজে ১০টি কল পাওয়া যায়, এ শহরে বাড়িভাড়া বাড়াটাই স্বাভাবিক।

এবার নিজের প্রতি নিজেই কয়েকটা প্রশ্ন করি আসুন, সরকারকে আমি পুরোপুরি কর দিচ্ছি কি? দেশের শীর্ষস্থানীয় বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো কতটুকু ট্রান্সপারেন্ট ট্যাক্সের ক্ষেত্রে? সরকারের কর বিভাগ কতটুকু নিরপেক্ষ এবং শক্তিশালী এ ব্যাপারে? যতটুকু ট্যাক্স আদায় হচ্ছে তার কতটুকু জনকল্যাণে খরচ হচ্ছে? এসব প্রশ্নের উত্তর মেলানো কঠিন আমাদের জন্য, তাই এড়িয়ে যাই কমবেশি সবাই। সব মিলিয়ে, শুধু ইনফাস্ট্রাকচারাল ডেভেলপমেন্ট আর ঋণপুষ্ট জিডিপি গ্রোথে যখন আমাদের মন ভরে যায়, তখন এই ছাইপাঁশ বিল মওকুফের দাবি ছাড়া অন্য কিছু আমাদের মাথায় না আসাই স্বাভাবিক।

প্রান্তিক অঞ্চল থেকে শুরু করে মফস্বল, এমনকি বিভাগীয় শহরাঞ্চলের মানুষ, আমরা সবাই বিভিন্ন কারণে ঢাকামুখী, ঢাকাকে আমরা একমাত্র সমাধান হিসেবে দেখছি। প্রতিটি মন্ত্রণালয়, সরকারি এজেন্সি ঢাকায়, রুট লেভেলের যেসব মুখপাত্র বা অঙ্গপ্রতিষ্ঠান আছে তারাও স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। ফলে শেষ পর্যন্ত ঢাকায় আসতেই হবে, আর এটাই সত্য।

প্রতিটি কোম্পানির হেড অফিস, বাচ্চা হেড অফিস, ছাপোনা অফিস সব ঢাকায়, এমনকি ম্যানুফ্যাকচারিং ফ্যাক্টরিগুলোও ঢাকার চারপাশে। এসব ইস্যু আমাকে–আপনাকে নির্ভরশীল করে তুলছে ঢাকার ওপর। ব্যবসায়ীরা ব্যবসার জন্য ঢাকাকে ভালো ভাবছে, আমার চাকরির সুবিধা বেশি (!) বলে আমি ঢাকায় থাকতে চাচ্ছি, ঢাকায় আমরা সবাই থাকছি বলে থাকার জায়গার চাহিদা বাড়ছে, ফলে বাড়িভাড়া বাড়ছে, বাড়ছে নিত্যপণ্য আর কোনোরকম চলার খরচও।

যেহেতু ঢাকায় আমাকে থাকতেই হচ্ছে তথাকথিত উন্নত জীবনযাপনের জন্য তাই কর্মসংস্থানও প্রয়োজন। হয় চাকরি করা নয়তো ব্যবসা করা। দ্বিতীয় উপায়ের দিকে কেউ ঝুঁকতে চাইলে তাকে অগত্যা পিছু ফিরতে হয়। শুধু প্রতিযোগিতামূলক এ শহরে ব্যবসা দিয়ে টিকে থাকতে চাইলে অধিক মূলধন প্রয়োজন, ব্যক্তিগত যোগাযোগ ভালো থাকা প্রয়োজন। এসব কোনোটার যার নেই, তার জন্য অসম্ভব ব্যবসা করা তা বলছি না কিন্তু খুব সহজও না। ফলে তার কাছে একমাত্র অপশন হচ্ছে প্রথম উপায়টি বেছে নেওয়া অর্থাৎ চাকরি করে টিকে থাকা।

প্রতিযোগিতামূলক চাকরির বাজার এ কথা বলাই বাহুল্য। ১০ হাজার টাকার মাসিক বেতনে চাকরির নোটিশ দেওয়া হলেও সেখানে জমা হয় কয়েক হাজার সিভি। যেখানে একটা ভ্যাকেন্সির পেছনে গড়ে ২৫ জন আগ্রহী সেখানে পঁচিশ হাজার টাকার শ্রমকে ১২ হাজার টাকায় মূল্যায়ন করার সুযোগ তৈরি হয় নিয়োগকর্তাদের হাতে। যেখানে শুরুতেই শ্রমের দাম অর্ধেক কমিয়ে ফেলা সম্ভব হয়, সেখানে দুর্দিনে যে নামমাত্র মূল্য থাকবে না, সেটাই স্বাভাবিক।

ওপরের পয়েন্টগুলো খেয়াল করে দেখুন, আমাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা ঢাকা ছেড়ে চলে যাওয়া নয়, ঢাকার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়া। আমাদের অর্থনীতি, নিজেদের আত্মকেন্দ্রিক চিন্তাভাবনা আর নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের অদূরদর্শিতা আমাদের দিনকে দিনে আরও বেশি ঢাকাকেন্দ্রিক করে ফেলেছে।

যাঁরা ঢাকা ছেড়ে যাচ্ছেন তাঁদের ঢাকায় ফিরিয়ে আনার চেষ্টা কিংবা এমন দুর্যোগের দিনে ৪০ কেজি চাল, ১০ কেজি আলুর ত্রাণ তার সমস্যাকে কমাবে না, বাড়াবে।

বর্তমান আর্থিক টানাপোড়েন থেকে আমাদের শেখা উচিত কীভাবে দেশের পুরো অর্থনৈতিক অবস্থাকে গ্রামমুখী অর্থনীতিকে উন্নীত করা যায়। যে লোকটি ঢাকা ছেড়ে গেছে, তার উচিত চিন্তা করা কীভাবে নিজের গ্রামের ভিটেকে আয়ের উৎস বানানো যায়। অন্যদিকে সরকারের উচিত এদের জন্য স্পেশাল স্কিম চালু করা।

গ্রামমুখী কারখানা, খামার, কৃষি ইত্যাদি ক্ষেত্রে বিশেষ প্রণোদনা, প্রথম পাঁচ বছরে ট্যাক্স মওকুফ, ফিন্যান্সিয়াল এবং টেকনিক্যাল অ্যাসিস্ট্যান্স দেওয়া, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বিনিয়োগে গ্রাম আর শহরের পরিমাণ ৫০–৫০ আবশ্যক করা ইত্যাদি।

বাংলাদেশে প্রতিবছর বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো সিএসআর ফান্ডের যে পরিমাণ টাকা খরচ করে, তা দিয়ে কয়েক লাখ মানুষের বাড়িতে চারটি গরুর খামার করে দেওয়া সম্ভব, সরকারের উচিত এই ফান্ডের পুরোটুকু আগামী কয়েক বছর এই গ্রামমুখী অর্থনীতির উন্নয়নে খরচ হওয়াটা নিশ্চিত করা। অধিকাংশ বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান তাদের সিএসআর ফান্ড ‘সামাজিক কর্ম’–এর আড়ালে নিজেদের ব্র্যান্ড অ্যাওয়ারনেসের কাজে খরচ করে। এই সময়টাতে তাই তাদেরও এগিয়ে আসতে হবে।

এই করোনায় কেউ বাড়িভাড়া না দিতে পেরে শহর ছেড়ে দিতে চাইলে তাকে ১০ হাজার টাকা দান করে শহরে থাকার জন্য উৎসাহিত করবেন না, তাকে ১০ হাজার টাকায় সবজির খামার করার বুদ্ধিটি দিন, তাকে বোঝান সাময়িক সমাধান কোনো সমাধান নয়। সমাধান টানতে হবে নিজেকে। নিজের মনকে বোঝাতে হবে, চীনের মানুষ প্রত্যন্ত অঞ্চলে বসে আইফোনের প্রতিটি মডেল প্রিবুক করতে পারলে আপনিও পারবেন। কিছুদিন পরিশ্রম হবে হয়তো, তবে এতেই টেকসই উন্নয়ন সম্ভব। সবাইকে বিশ্বাস করতেই হবে—‘এই দিন দিন নয়, আরও দিন আছে, এই দিনেরে নিব আমরা, সেই দিনেরই কাছে’।