Thank you for trying Sticky AMP!!

তারুণ্যের শক্তিতে এগোচ্ছে ই-কমার্স

বর্তমানে দেশে ই-কমার্স সাইটের সংখ্যা এক হাজার। ই-কমার্স, অনলাইন মার্কেটপ্লেস, এফ-কমার্স—সব মিলিয়ে অনলাইনকেন্দ্রিক ৫০০ কোটি টাকার বাজার দেশে গড়ে উঠেছে, উদ্যোক্তার পাশাপাশি ক্রেতাদের সিংহভাগই তরুণ প্রজন্মের

অন্যদিকে ঢাকা ও চট্টগ্রামের মতো বড় শহরের বাইরে একটু প্রত্যন্ত অঞ্চলে বসবাসকারী মানুষের সমস্যাটা একটু ভিন্ন। সেখানকার একজন ক্রেতা হয়তো মনে মনে একটি পণ্য খুঁজছেন, কিন্তু তাঁর এলাকায় সেই পণ্য মেলে না।

এমন দুই শ্রেণির মানুষের সমস্যার সমাধান করছে অনলাইনভিত্তিক কেনাকাটার ব্যবস্থা ই-কমার্স। মুঠোফোন বা কম্পিউটারের মাধ্যমে কয়েকটি ক্লিক করেই এখন অনলাইনে কিনতে পাওয়া যাচ্ছে পছন্দের যেকোনো পণ্য। শহরের ব্যস্ত লোকেরা এতে নিজেদের সময় বাঁচাতে পারছেন, আবার একটু প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষ ঘরে বসেই পেয়ে যাচ্ছেন পছন্দের পণ্য। তরুণ উদ্যোক্তাদের হাত ধরে গত কয়েক বছরেই দেশে অনলাইনভিত্তিক ই-কমার্স ব্যবসার তাই একটি বিশাল বাজার গড়ে উঠেছে। উদ্যোক্তার পাশাপাশি এ খাতের ক্রেতাদের সিংহভাগই তরুণ প্রজন্মের।

পোশাক, জুতা, গয়না, ইলেকট্রনিক পণ্য, মুঠোফোন থেকে শুরু করে চাল-ডাল, সবজি, এমনকি গাড়ি-বাড়িও এখন অনলাইনে কেনা যাচ্ছে। প্রতিদিনই এ তালিকায় যোগ হচ্ছে নতুন পণ্য। যুগের চাহিদার সঙ্গে তাল মেলাতে প্রতিষ্ঠিত বিভিন্ন বড় প্রতিষ্ঠানও তাদের উৎপাদিত পণ্য এখন অনলাইনে বিক্রি শুরু করেছে।

দেশে অনলাইন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ই-ক্যাব) তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে ই-কমার্স সাইটের সংখ্যা এক হাজার। আর ই-ক্যাবের সঙ্গে নিবন্ধিত আছে ৫১৩টি প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে ১০০ প্রতিষ্ঠান বড় আকারে নিজস্ব ব্র্যান্ড নামে ব্যবসা করছে।

খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ই-কমার্স, অনলাইন মার্কেটপ্লেস, এফ-কমার্স—সব মিলিয়ে অনলাইনকেন্দ্রিক ৫০০ কোটি টাকার বাজার দেশে গড়ে উঠেছে। আগামী কয়েক বছরে এই খাত হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে বলে তাঁরা আশা করছেন। ২০১৫ সালের তথ্য নিয়ে বাজার গবেষণা প্রতিষ্ঠান লাইটক্যাসেল পার্টনার্সের করা গবেষণা অনুযায়ী, বাংলাদেশের ই-কমার্স খাতের আকার সব মিলিয়ে বছরে এখন ৪০০ কোটি টাকার মতো। সরকারি হিসাবে বাংলাদেশে ইন্টারনেট সংযোগের সংখ্যা বর্তমানে ৬ কোটি ২২ লাখ। ব্যবহারকারী যত বাড়বে, ই-কমার্সের বাজার তত দ্রুত বাড়বে বলে উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীরা মনে করেন।

জাতিসংঘের বাণিজ্যবিষয়ক সংস্থা আঙ্কটাডের হিসাব অনুযায়ী, সারা বিশ্বে খুচরা পর্যায়ে ই-কমার্সের বাজার ২ ট্রিলিয়ন বা ২ লাখ কোটি মার্কিন ডলারের। একক দেশ হিসেবে ই-কমার্স লেনদেনে শীর্ষে রয়েছে চীন। শীর্ষ দশে থাকা অন্যান্য দেশ হলো যথাক্রমে যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, জার্মানি, যুক্তরাজ্য, ব্রাজিল, রাশিয়া, ফ্রান্স, দক্ষিণ কোরিয়া ও ভারত।

অনলাইন বেচাকেনা হয় দুইভাবে। আজকের ডিল, বাগডুম, কেইমু, দারাজ, চালডাল, সহজ, বিডিটিকেটস, হাংরি নাকি, আমার দেশ আমার গ্রামের মতো ই-কমার্স সাইটগুলো নিজেরাই পণ্য বিক্রি ও সরবরাহ করে। এসব সাইট থেকে ক্রেতা পণ্য পছন্দ করে অনলাইনে ক্রয়াদেশ দেন। এরপর দুইভাবে পণ্যের বিক্রয়মূল্য পরিশোধ করা যায়। পণ্য ক্রেতার হাতে পৌঁছানোর পর নগদ অর্থে মূল্য পরিশোধ করেন। এই পদ্ধতিকে বলা হয় ক্যাশ অন ডেলিভারি। এ ছাড়া ক্রেডিট কার্ড, ডেবিট কার্ড, মোবাইল ব্যাংকিং হিসাবের মাধ্যমেও পণ্যের মূল্য পরিশোধ করা যায়।

আর বিক্রয় ডটকম, এখানেই ডটকমের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোকে বলা হয় অনলাইন মার্কেটপ্লেস। এখানে একজন বিক্রেতা তাঁর ব্যবহৃত বা একেবারে নতুন পণ্য বিক্রির বিজ্ঞাপন দেন। সেই পণ্যের ছবি, দাম, যোগাযোগের নম্বরসহ বিস্তারিত তথ্য দেওয়া থাকে। কোনো আগ্রহী ক্রেতা সেই বিজ্ঞাপন দেখে ওই বিক্রেতার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। পরে দুজনের আপসের ভিত্তিতে পণ্যটি বেচাকেনা হয়। আবার অনেক প্রতিষ্ঠান তার নিজস্ব পণ্যের বিজ্ঞাপন এসব অনলাইন মার্কেটপ্লেসে দিচ্ছে।

তরুণ উদ্যোক্তাই বেশি: তৃণমূল পর্যায়ের কৃষিপণ্য উৎপাদককে অনলাইনের মাধ্যমে ক্রেতা তথা বাজার ধরিয়ে দেওয়ার লক্ষ্য নিয়ে ২০০৯ সালে যাত্রা শুরু করে আমার দেশ আমার গ্রাম। যুক্তরাজ্য থেকে প্রকৌশলবিদ্যায় স্নাতক শেষ করে ২৮ বছর বয়সে ই-কমার্স সাইটটি প্রতিষ্ঠা করেন আতাউর রহমান।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা পাঁচ তরুণ ২০১১ সালে শুরু করেন বই কেনাবেচার ই-কমার্স সাইট রকমারি ডট কম।

ঢাকার স্টার সিনেপ্লেক্স ও ব্লকবাস্টার মুভিজে চলমান বিভিন্ন সিনেমার টিকিট অনলাইনে কিনতে পাওয়া যায় বিডিটিকেটস ডমকম নামের ই-কমার্স সাইটে। সিনেমার পাশাপাশি এই সাইটে বাস ও লঞ্চের টিকিটও বিক্রি করা হয়। বিডিটিকেটস ডটকমের প্রধান নির্বাহী ও ই-ক্যাবের সহসভাপতি রেজওয়ানুল হক প্রথম আলোকে বলেন, প্রতিবছর গড়ে ৩০ শতাংশ হারে এ খাতের প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। ই-কমার্সের সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো, এটি বাংলাদেশের শহর ও গ্রামের পার্থক্য কমিয়ে আনছে।

ওপরের তিনটির পাশাপাশি ছোট-বড় ১০টির বেশি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের উদ্যোক্তাদের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তাঁদের সবাই ৩০ পেরোনোর আগেই এসব উদ্যোগ নিয়েছেন।

কেইমু বাংলাদেশের গবেষণা অনুযায়ী, অনলাইনে যাঁরা কেনাকাটা করেন, তাঁদের ৯০ শতাংশের বয়স ১৮ থেকে ৪৪ বছরের মধ্যে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি কেনাকাটা করেন ২৫ থেকে ৩৪ বছর বয়সীরা।

ব্যবসায় ফেসবুক: প্রতিষ্ঠিত ই-কমার্স ওয়েবসাইটের পাশাপাশি জনপ্রিয় হয়ে উঠছে ফেসবুককেন্দ্রিক বিভিন্ন পেজ। নির্দিষ্ট একটি বা কয়েকটি পণ্যের বিবরণ, দাম ও তথ্য তুলে ধরে এগুলো এসব পেজের মাধ্যমে বিক্রি করেন অনেকেই। এসব ফেসবুক পেজ ঘিরে যে ব্যবসা, সেটিকে বলা হয় ‘এফ-কমার্স’। ই-ক্যাবের হিসাব অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে এমন ফেসবুক পেজ আছে প্রায় আট হাজার।

এফ-কমার্সকেন্দ্রিক এমন একটি পেজ বা প্রতিষ্ঠান হলো মুন জুয়েলারি। ২০১০ সাল থেকে দেশে তৈরি বিভিন্ন গয়না ও মেয়েদের পোশাক বিক্রি করে আসছে এই পেজ। এর কর্ণধার জিনাত ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, বিভিন্ন মৌসুম ও ক্রেতার চাহিদার বিষয়টি মাথায় রেখেই গয়না-পোশাক বিক্রি করা হয়। নিজস্ব কারিগরের মাধ্যমেই এসব পণ্য তৈরি করা হয়।

লেনদেন এখনো নগদেই: ই-কমার্স খাতের লেনদেনের বেশির ভাগই এখনো নগদ অর্থ বা ক্যাশ অন ডেলিভারিকেন্দ্রিক বলে এ খাতের ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন। এর কারণ হিসেবে তাঁরা বলছেন, ডেবিট-ক্রেডিট কার্ড এখনো নির্দিষ্ট কিছু লোক ব্যবহার করেন। মোবাইল ব্যাংকিং সেবাও অনেকটাই টাকা পাঠানো বা তোলার মতো কাজে সীমাবদ্ধ। ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করে যত বেশি অর্থ পরিশোধ করার সুযোগ বাড়বে, ততই ই-কমার্স বাড়বে।

বেসিস ই-কমার্স অ্যালায়েন্সের সমন্বয়ক ও ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান আজকের ডিলের প্রধান নির্বাহী ফাহিম মাশরুর প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশে ই-কমার্স এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে আছে। ভারতেও ই-কমার্স যখন শুরু হয়, তখন নগদ অর্থের লেনদেন অনেক বেশি ছিল। আগামী চার থেকে পাঁচ বছরের মধ্যে বাংলাদেশেও ই-কমার্স লেনদেনে ডিজিটাল মাধ্যমের ব্যবহার বাড়বে।

প্রয়োজন গ্রাহক-সচেতনতা: ই-কমার্সের বিষয়ে গ্রাহকের অভিযোগও একেবারে কম নয়। মহাখালীর বাসিন্দা মাহফুজা হৃদি কয়েক মাস আগে একটি ই-কমার্স সাইট থেকে বাসায় ব্যবহারের জন্য একটি ডিজিটাল থার্মোমিটার কেনেন। কিন্তু কেনার পর একদিনও থার্মোমিটারটি ব্যবহার করতে পারেননি তিনি। ক্ষোভ প্রকাশ করে মাহফুজা বলেন, অভিযোগ করে পরিবর্তন করে দিতে চাইলেও তারা কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।

ক্রেতার অভিযোগের বিষয়ে ফাহিম মাশরুর বলেন, শুধু নীতিমালা ও আইন প্রয়োগ করে এদের আটকানো কঠিন। এর জন্য গ্রাহক-সচেতনতা খুব গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিষ্ঠিত ব্র্যান্ডের ই-কমার্স সাইট থেকে পণ্য কেনা হলে প্রতারণার বিষয়টি অনেকাংশে এড়ানো সম্ভব।

জানতে চাইলে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক শফিকুল ইসলাম লস্কর প্রথম আলোকে বলেন, ই-কমার্সের মাধ্যমে কোনো পণ্য কিনে ক্রেতারা প্রতারিত হলে এখানে অভিযোগ করতে পারবেন। এ ক্ষেত্রে অভিযোগ প্রমাণিত হলে জরিমানা করা হয় এবং সেই জরিমানার ২৫ শতাংশ অর্থ অভিযোগকারী পাবেন। এ ছাড়া ত্রুটিপূর্ণ পণ্য বদলে দিতে হবে অথবা মূল্য ফেরত দিতে হবে। তিনি বলেন, ঘটনা সংঘটিত হওয়ার ৩০ দিনের মধ্যে অধিদপ্তরে অভিযোগ জানাতে হয়। অভিযোগ পাওয়ার পর দ্রুত তা নিষ্পত্তি করা হয়।