Thank you for trying Sticky AMP!!

তিস্তা এখন আর নদী নয়, বিস্তীর্ণ জমি

বালুচরে দিগন্তজুড়ে সবুজের মাঠে এখন ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন কৃষকেরা। আলু, ভুট্টা, মরিচ, মসুর ডাল, মিষ্টিকুমড়া, চিনাবাদাম, পেঁয়াজ, রসুন, তরমুজ, তামাকসহ বিভিন্ন ফসল ফলানোর ধুম পড়েছে তিস্তায়। ছবি: সংগৃহীত

নতুন বছরের শুরুতেই তিস্তা পানিশূন্য। গত বছরের কয়েক দফা বন্যার পর তিস্তার বুকে জেগে উঠেছে ধু ধু বালুচর। তিস্তা নদী খনন, শাসন, ড্রেজিং ও সংরক্ষণ না করায় উজান থেকে নেমে আসা পলি জমে অগভীর খরস্রোতা রাক্ষুসি তিস্তা নদী আবাদি জমিতে রূপ নিয়েছে।

এখন এই বালুচলে তিস্তাপাড়ে লাখো কৃষক বিভিন্ন ফসল ফলিয়ে স্বপ্ন দেখছেন নিজের দিনবদলের। দীর্ঘদিনের তিস্তার ভাঙনে জমি খুইয়ে যাওয়া পরিবারগুলো যেন তাদের প্রাণ ফিরে পেয়েছে।

তিস্তায় শেষ সম্বল হারিয়ে দেশের বিভিন্ন এলাকায় চলে যাওয়া পরিবারগুলো আবার চরে ফিরতে শুরু করেছে। তারা বাপ-দাদার ভিটায় পরিজন নিয়ে নানাবিধ ফসলের চাষাবাদে মেতে উঠেছে।

লালমনিরহাটে জেগে উঠেছে ৬৩টি চর। বালুচরে দিগন্তজুড়ে সবুজ মাঠে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন কৃষক। আলু, ভুট্টা, মরিচ, মসুর ডাল, মিষ্টিকুমড়া, চিনাবাদাম, পেঁয়াজ, রসুন, তরমুজ, তামাকসহ বিভিন্ন ফসল ফলাওর ধুম পড়েছে তিস্তায়।

তিস্তার দুই পাড়ে বসবাসকারী লোকজন জানান, তিস্তা এখন আর নদী নয়, এ যেন বিস্তীর্ণ আবাদি জমি। তিস্তার বুকে খেয়া পারে বা মাছ ধরতে নৌকা নিয়ে ছুটে চলা মাঝিমল্লাদের দৌড়ঝাঁপ নেই। পানি আর মাছে পরিপূর্ণ তিস্তার বুকে জেগে উঠেছে শুধুই বালুচর।

মাছ ধরতে না পেরে মানবেতর জীবন যাপন করছে নদীর দুই পাড়ের কয়েক হাজার জেলে পরিবার।

বিপন্ন হতে বসেছে তিস্তার বুকে বাস করা নানা জীববৈচিত্র্য। নৌকা নয়, হেঁটে, মহিষের গাড়িতে, আবার কখনো মোটরসাইকেলে তিস্তা পাড়ি দিচ্ছেন নদী দুই পাড়ের মানুষ। জেলে থেকে শুরু করে নদীকে কেন্দ্র করে বেঁচে থাকা লাখো মানুষের চোখে এখন কান্না।

বালুচরে দিগন্তজুড়ে সবুজের মাঠে এখন ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন কৃষকেরা। আলু, ভুট্টা, মরিচ, মসুর ডাল, মিষ্টিকুমড়া, চিনাবাদাম, পেঁয়াজ, রসুন, তরমুজ, তামাকসহ বিভিন্ন ফসল ফলানোর ধুম পড়েছে তিস্তায়। ছবি: সংগৃহীত

এ অঞ্চলের বৃহৎ নদী তিস্তার বুকে ফলছে নানা ধরনের ফসল। হাতীবান্ধা উপজেলার সানিয়াজান ইউনিয়নের তিস্তাপাড়ের শেখ সুন্দর গ্রামের হাশেম আলী বলেন, ‘অনেক আগে দুই বিঘা আবাদি জমি তিস্তায় বিলীন হয়ে গেছে। বর্তমানে নদীর পানি না থাকায় জেগে ওঠা চরে শেষ সম্বল দুই বিঘা জমিতে আবাদ শুরু করি। জমিতে ভুট্টা, মসুর ডাল, মিষ্টিকুমড়া, লাগিয়েছি। আশা করি, ভালো ফসল পাব।’ চরাঞ্চলের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে বাহারি ফসলের নজর কারা দৃশ্য।

লালমনিরহাটের চররাজপুর এলাকার আকবার হোসেন জানান, তিস্তায় একহাঁটু পানিও নেই। হেঁটে নদী পার হওয়া যায়। প্রতিবছর এ সময় তিস্তায় পানি থাকে না। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে জমিতে ফসল ফলানো হয়। প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমে উজান থেকে পাহাড়ি ঢলের সঙ্গে নেমে আসে বালু। এ কারণে নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে যাচ্ছে। বছর বছর তলদেশ ভরাট হওয়ায় এ জেলার নদীগুলো হারাতে বসেছে তার ঐতিহ্য। নদীতে মাছ ধরে যাঁরা জীবিকা নির্বাহ করতেন, তাঁরা আজ অসহায়। পানি না থাকায় জেলেরা পেশা বদল করে চলে যাচ্ছেন অন্য পেশায়।

প্রায় ২০ বছর ধরে তিস্তা নদীতে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করছেন লালমনিরহাটে গড্ডিমারী ইউনিয়নের দোয়ানী গ্রামের আকবর আলী (৫০)। তিনি বলেন, ‘এখন নদীতে পানিও নেই, মাছও নেই। বর্ষায় অতিরিক্ত পানির কারণে নদীতে মাছ ধরা যায় না। আমরা খুব কষ্টে আছি।’

গড্ডিমারী ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মো. আতিয়ার রহমান বলেন, পানি বণ্টন চুক্তি না হওয়ায় শুষ্ক মৌসুমে শুকিয়ে চৌচির হয়ে পড়ে তিস্তা নদী। জেগে ওঠে অসংখ্য চর। এই চরে কৃষকেরা চাষবাদ শুরু করেছেন।

লালমনিরহাট জেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে ছোট-বড় অনেক নদী। কিন্তু কালক্রমে নদী ভরাট হয়ে পানি শুকিয়ে মরুভূমিতে পরিণত হয়েছে জেলার জনপদ। বন্ধ হয়ে গেছে নদীকেন্দ্রিক ব্যবসা-বাণিজ্য, চাষাবাদ। আর পানি না থাকায় দুর্দিন চলছে মৎস্যজীবীদের। তিস্তা, ধরলা, রতনাই, স্বর্ণামতী, সানিয়াজান, সাঁকোয়া, মালদহ, ত্রিমোহিনী, সতী, গিরিধারী, ছিনাকাটা, ধলাই, ভেটেশ্বরসহ ছোট-বড় ১৩টি নদী জেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে।

লালমনিরহাট, নীলফামারী, রংপুর ও গাইবান্ধা জেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে কুড়িগ্রামে চিলমারী বন্দর হয়ে ব্রহ্মপুত্র নদের সঙ্গে মিশেছে তিস্তা। নদীটির দৈর্ঘ্য প্রায় ৩১৫ কিলোমিটার হলেও বাংলাদেশ অংশে রয়েছে ১৬৫ কিলোমিটার।

দেশের অন্যতম সেচ প্রকল্প লালমনিরহাটের হাতীবান্ধার তিস্তা ব্যারাজ অকার্যকর হওয়ার উপক্রম। তিস্তা নদীর ওপর নির্মিত রেলসেতু, সড়কসেতু ও নির্মাণাধীন দ্বিতীয় তিস্তা সড়কসেতু দাঁড়িয়ে আছে তিস্তার ধু ধু বালুচরের ওপর। হেঁটেই পার হচ্ছে অনেকে। ঢেউহীন তিস্তায় রয়েছে শুধুই বালুকণা।

বালুচরে দিগন্তজুড়ে সবুজের মাঠে এখন ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন কৃষকেরা। আলু, ভুট্টা, মরিচ, মসুর ডাল, মিষ্টিকুমড়া, চিনাবাদাম, পেঁয়াজ, রসুন, তরমুজ, তামাকসহ বিভিন্ন ফসল ফলানোর ধুম পড়েছে তিস্তায়। ছবি: সংগৃহীত

তিস্তা ব্যারাজ সেচ প্রকল্প সূত্র জানায়, বর্তমানে তিস্তায় পানি রয়েছে সাড়ে তিন হাজার কিউসেক। প্রকল্প এলাকায় সেচ দেওয়া এবং নদীর প্রবাহ ঠিক রাখতে তিস্তা ব্যারাজ পয়েন্টে প্রয়োজন ২০ হাজার কিউসেক পানি।

শুধু সেচ প্রকল্প চালাতেই প্রবাহমাত্রা থাকা প্রয়োজন ১৪ হাজার কিউসেক এবং নদীর অস্তিত্ব রক্ষার জন্য চার হাজার কিউসেক পানি। কিন্তু তিস্তায় প্রয়োজনীয় পানি মিলছে না। শুষ্ক মৌসুমে বোরো আবাদের সময় ব্যারাজ পয়েন্টে কয়েক বছর ধরে পাওয়া যায় মাত্র ৫০০ কিউসেক পানি।

ব্যারাজের সব কটি জলকপাট বন্ধ রেখে সেচ প্রকল্পে পানি সরবরাহ করায় নদীর ভাটিতে আর প্রবাহ থাকছে না।

নীলফামারী জেলার ডালিয়া ও লালমনিরহাট জেলার দোয়ানীতে প্রায় এক হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে তিস্তা সেচ প্রকল্প চালু হয় ১৯৯৮ সালে। নীলফামারী, রংপুর ও দিনাজপুর জেলার ১২টি উপজেলার ৯১ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ দিতে পারার কথা এই প্রকল্পে। কিন্তু এটা শুরুই হয় ৭৯ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ দিয়ে। এরপর ক্রমাগত সেচের আওতা কমেছে।

পানি উন্নয়ন বোর্ড ডালিয়া ডিভিশনের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী হাফিজুর রহমান বলেন, ‘তিস্তার পানিপ্রবাহ ধরে রাখার চেষ্টা করছি। উজান থেকে পানি কম আসায় এবার সেচযোগ্য জমির আওতা কমানো হচ্ছে।’