Thank you for trying Sticky AMP!!

তিস্তা নদীর বৃত্তান্ত

বাংলাদেশ–ভারত সম্পর্কে তিস্তার ক্ষত অনেক দিনের। ১৯৯৬ সালে গঙ্গার পানিবণ্টন চুক্তি হওয়ার পর থেকে এই সমস্যা সমাধানের একটা আশা উঁকি দিয়েছিল। তখন থেকে এ নিয়ে দুদেশে যত কথা হয়েছে তার অর্ধেক পানি (হিসাবটা কিউবিক মিটারে) এলেও তিস্তাপাড়ের মানুষের বৃন্তান্তটা অন্য রকম হতে পারত।
আর ঢাকা, দিল্লি বা কলকাতায় বসে যাঁরা সংবাদমাধ্যমের জন্য তিস্তা নিয়ে কাজ করেন তাঁদের অনেকের নদীটি দেখারই সৌভাগ্য হয়নি। ফলে সংবাদমাধ্যমকে অন্যের মুখে ঝাল খেতে হয়েছে। আর বর্তমান বিশ্বে পানি এমন এক জটিল সমস্যা যে এর কোনো সরলরৈখিক সমাধান নেই। খোদার ওপর খোদকারি করার মতো প্রকৃতির ঘাড়ে রাজনৈতিক বিভাজন বা সিদ্ধান্তের কোপ নেমে আসায় নদী বা মিষ্টি পানিকে ঘিরে সমস্যা আরও জটিল হয়েছে। সহজ ভূগোলের তিস্তাও তাই এ রকম জটিল রাজনৈতিক পাশা খেলার মারপ্যাঁচে পড়ে দুর্বিষহ করে তুলেছে বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গের লাখ লাখ মানুষের জীবন। আবহমানকাল ধরে চলা চিরচেনা জীবনে ছন্দপতনের সুর সর্বত্র।
আমরা জানি, তিস্তা একটা আন্তর্জাতিক নদী এবং এর সমাধান বাংলাদেশ ও ভারত সরকারের হাতে। এর সঙ্গে জড়িয়ে গেছে পশ্চিমবঙ্গ সরকারও। ঢাকার অভিযোগ ন্যায্য পানি না পাওয়ার, অন্যদিকে পশ্চিমবঙ্গ সরকার বলেই চলেছে, পানি নেই তো দেব কোত্থেকে? দুপক্ষের এই চাপানউতোরে হারিয়ে যেতে বসেছে মানুষের দুর্ভোগ। তাই প্রথম আলোর পক্ষ থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, তিস্তায় পানি আছে না নেই, তা সরেজমিন করার। ঠিক হয়, প্রথম আলোর সাংবাদিকেরা ভারত ও বাংলাদেশে তিস্তার উৎস থেকে ব্রহ্মপুত্রে বিলীন হওয়া পর্যন্ত গতিপথ ধরে চলবেন, দেখবেন, স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলবেন, ছবি তুলবেন। পাশাপাশি ঢাকায় ও নয়াদিল্লিতে নীতিনির্ধারকেরা কী ভাবছেন তাও তুলে ধরা হবে। থাকবে নদীবিশেষজ্ঞদের কথা। সবকিছু এক করে বিশেষ ক্রোড়পত্রের মাধ্যমে তা পাঠকদের জানিয়ে দেবে প্রথম আলো।
সেই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রথম আলোর কলকাতা প্রতিনিধি অমর সাহা ফটোসাংবাদিক ভাস্কর মুখার্জিকে সঙ্গী করে যাত্রা করলেন উত্তরমুখে। শিলিগুড়ি গিয়েই প্রশ্ন, ‘আরে ভাই, তিস্তার উৎস তো সিকিমের অনেক উঁচুতে, যাব ক্যামনে?’ উত্তর দিলাম, ‘যতদূর পারেন যান।’ পরের জবাব, ‘সিকিমে যেতে পারমিশন লাগে। তবে সেটা কোনো ব্যাপার না।’ বললাম, ‘তিস্তা যেখান থেকে পশ্চিমবঙ্গে ঢুকেছে সেখান থেকে দ্যাখেন।’ ‘আমরা কী নিচ থেকে দেখতে দেখতে যাব?’ উত্তর, ‘না, ওপর থেকে শুরু করবেন, সেখান থেকে গজলডোবা আসবেন, তারপর পারলে গজলডোবা থেকে তিস্তা ধরে সীমান্তের দিকে এগোবেন।’ এভাবেই এগিয়ে চলে তিস্তা পারের বৃত্তান্ত।
এদিকে লালমনিরহাটের দহগ্রাম থেকে চলতে শুরু করেন প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি শিশির মোড়ল, সঙ্গে পাটগ্রাম প্রতিনিধি এ বি সফিউল আলম। পাটগ্রামের দহগ্রামে তিস্তা বিনা পাসপোর্টে অনুপ্রবেশ করেছে বাংলাদেশে। প্রথম আলোর পাঠকেরা জানেন, শিশির মোড়ল মূলত স্বাস্থ্য বিষয়ে লিখে থাকেন। একেবারে ভিন্ন একটি বিষয়ে তাঁকে দায়িত্ব দিয়ে প্রথম আলোর সম্পাদক চেয়েছিলেন, পাঠককে একটু সরেজমিনের অন্য রকম স্বাদ দিতে। প্রকাশের পর বলা যায়, তাঁর সিদ্ধান্ত যথাযথ ছিল। সফি খান আর সফিউলকে নিয়ে শিশির হেঁটে, মোটরবাইকে, নৌকায় করে শত শত মাইল পাড়ি দিয়ে শুধু তথ্যই সংগ্রহ করেননি, নিজের মোবাইল ফোন ব্যবহার করে দারুণ দারুণ ছবিও তুলেছেন। 
এদিকে ঢাকায় প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি রাহীদ এজাজ তিস্তা নিয়ে কথা বলেন পানিসম্পদমন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদের সঙ্গে। দিল্লি থেকে সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায় লেখেন বিশ্লেষণ। এর মধ্যে তিস্তার দুরবস্থা নিয়ে প্রখ্যাত লেখক ও এই নদীপাড়ের বাসিন্দা দেবেশ রায়ের একটি লেখা খুঁজে পাই। ২০১৩ সালের ১৯ মার্চ আনন্দবাজার পত্রিকায় ‘তিস্তাকে তিস্তায় ফিরিয়ে দেওয়া হোক’ শিরোনামে প্রকাশিত উপসম্পাদকীয়টি পুনঃপ্রকাশের জন্য যোগাযোগ করি সম্পাদক অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে। অনুমতি মেলে। পেয়ে যাই নদীবিশেষজ্ঞ কল্যাণ রুদ্রের মন্তব্য।

সব পাওয়ার পর একটাই চিন্তা ছিল কীভাবে এটা পাঠকের সামনে উপস্থাপন করা হবে। তখন একটাই ভাবনা কাজ করেছিল, পাঠক যেন খুব সহজেই একনজর দেখে তিস্তার বিষয়টি বুঝতে পারে। এই ভাবনাকে পত্রিকার বিশেষ মলাটের প্রথম পাতায় সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তোলেন গ্রাফিকস বিভাগের মো. জহিরউদ্দিন। 
সব শেষ করার পর যথারীতি এই চার পাতার গন্তব্য ছিল সম্পাদক মতিউর রহমানের কাছে। প্রশ্ন উঠল, মূল শিরোনাম কী হবে? সমাধান দিলেন ব্যবস্থাপনা সম্পাদক সাজ্জাদ শরিফ। আর শিরোনামটি একেবারে শেষ মুহূর্তে ভিন্ন ফন্টে করিয়ে আনলেন মার্কিন নাগরিক জেকব টমাসের কাছ থেকে। অবশেষে জন্ম নিল ‘তিস্তা একটি নদীর নাম’।