Thank you for trying Sticky AMP!!

তেজস্ক্রিয় বর্জ্য নিয়ে সরকার উদ্বিগ্ন

রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের তেজস্ক্রিয় জ্বালানি বর্জ্য (স্পেন্ট ফুয়েল) রাশিয়ার ফেরত নেওয়া অনিশ্চিত হয়ে পড়ায় সরকার উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে। কারণ, পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের তেজস্ক্রিয় জ্বালানি বর্জ্য খুবই বিপজ্জনক। এর সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা একটি উচ্চমাত্রার বিশেষায়িত বিষয়। এটা করার সামর্থ্য বাংলাদেশের নেই।

যদিও ২০১১ সালে রাশিয়া ও বাংলাদেশের মধ্যে সই হওয়া সমঝোতা স্মারকে (এমওইউ) তেজস্ক্রিয় জ্বালানি বর্জ্য ফেরত নেওয়ার বিষয়টি উল্লেখ ছিল। তবে গত বছরের ২৫ ডিসেম্বর সই হওয়া চূড়ান্ত চুক্তিতে (জেনারেল কন্ট্রাক্ট) বিষয়টি সেভাবে উল্লেখ করা হয়নি।

রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিষয়ে গত রোববার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে এক সভা অনুষ্ঠিত হয় বলে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সূত্রে জানা গেছে। বৈঠকের প্রথম পর্বে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সচিব মো. আবুল কালাম আজাদ সভায় উপস্থিত ছিলেন।

সভার একটি সূত্র প্রথম আলোকে বলে, গত রোববার সকালে বৈঠকের প্রথম পর্বে রূপপুর ছাড়াও সরকারের গৃহীত ও বড় প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়ন-প্রক্রিয়া কীভাবে সুষ্ঠু ও নির্বিঘ্ন করা যায়, সে বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব ও সাবেক অতিরিক্ত সচিবদের মতামত নেওয়া হয়। দুপুরে এই পর্ব শেষ হওয়ার পর রূপপুর প্রকল্পের শুরু থেকে বর্তমান পর্যন্ত কার্যক্রম পর্যালোচনা করা হয়। এই কাজে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব রফিকুল ইসলামের সহায়তা নেওয়া হয়। সেখানে প্রকল্পের শুরুর পর্যায়ে রাশিয়ার সঙ্গে কী কী আলোচনা হয়েছিল, সে আলোচনার বিষয়বস্তু কোথায় লিপিবদ্ধ আছে, সে বিষয়ে সাবেক সচিবের কাছ থেকে সুনির্দিষ্ট তথ্য নেওয়া হয়।

সূত্র জানায়, মন্ত্রণালয়ের বর্তমান কোনো কর্মকর্তা কিংবা রূপপুর প্রকল্পের কোনো কর্মকর্তাকে সেখানে ডাকা হয়নি। গত রোববার সন্ধ্যা ছয়টায় এই পর্যালোচনা সভা শেষ হয়। সেখানে প্রকল্পের বিভিন্ন পর্যায়ে রাশিয়ার সঙ্গে অনুষ্ঠিত আলোচনা, সিদ্ধান্ত ও তার বাস্তবায়ন সম্পর্কে একটি ‘পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশন’ তৈরি করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলোর ধারণা, সরকারের নীতিনির্ধারক মহলকে বিষয়টি বিস্তারিতভাবে অবহিত করার জন্য এটি করা হয়েছে।

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি সূত্র জানায়, তেজস্ক্রিয় জ্বালানি বর্জ্য ফেরত নেওয়ার বিষয়ে সাধারণ চুক্তির ৮ নম্বর অনুচ্ছেদের ২ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, আলাদা একটি চুক্তিতে উভয় পক্ষ যেসব শর্তে একমত হবে, সেই অনুযায়ী তেজস্ক্রিয় জ্বালানি বর্জ্য ফেরত নেওয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে। রাশিয়ার সঙ্গে আলাদা সেই চুক্তির খসড়া তৈরি হয়েছে এবং সেটি নিয়ে উভয় পক্ষের মধ্যে আলোচনা চলছে। সেই আলোচনায় বাংলাদেশ তার আগের অবস্থান বজায় রাখলেও রাশিয়ার অবস্থান কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে। রাশিয়ার বর্তমান অবস্থান হচ্ছে তেজস্ক্রিয় জ্বালানি বর্জ্য পরিবহনযোগ্য হওয়ার পর রাশিয়া তা নিয়ে পরিশোধন করবে। এরপর তা বাংলাদেশে ফেরত পাঠাবে এবং তারপর থেকে তা বাংলাদেশকেই সংরক্ষণ করতে হবে।

অপরদিকে সরকার চাইছে মূল চুক্তিতে যেভাবেই উল্লেখ করা হোক না কেন, আলাদা চুক্তিটিতে যেন তেজস্ক্রিয় জ্বালানি বর্জ্য রাশিয়ার ফেরত নেওয়ার বিষয়টি স্পষ্টভাবে উল্লিখিত হয়। অবশ্য সে ক্ষেত্রেও পারমাণবিক চুল্লি থেকে বর্জ্য অপসারণের পর ৩০০ দিন বাংলাদেশকেই সংরক্ষণ করতে হবে।

পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা হয় ইউরেনিয়াম-২৩৫। পারমাণবিক চুল্লিতে এই জ্বালানি শতভাগ ব্যবহৃত হয় না। যেটুকু অবশিষ্ট থাকে, সেটাকেই বলে তেজস্ক্রিয় জ্বালানি বর্জ্য। এটি উচ্চমাত্রায় তেজস্ক্রিয়তা ছড়ায়। তাই পারমাণবিক চুল্লি থেকে তেজস্ক্রিয় জ্বালানি বর্জ্য অপসারণ করার পর তা বিশেষ ব্যবস্থায় ৩০০ দিন সংরক্ষণ করতে হয়। এরপর তা পরিশোধন করে পুনরায় কিছু পরিমাণে ব্যবহার করা যায়। ব্যবহারের পর আবার যে বর্জ্য তৈরি হয়, তা-ও দীর্ঘকাল ধরে বিশেষ ব্যবস্থায় সংরক্ষণ করতে হয়।

বিশেষজ্ঞরা বলেন, এই সংরক্ষণ ও পরিশোধনব্যবস্থা গড়ে তোলা বিপুল ব্যয়সাপেক্ষ ও উচ্চতর প্রযুক্তিনির্ভর। তেজস্ক্রিয় জ্বালানি বর্জ্য সঠিকভাবে সংরক্ষণ করা না গেলে তা থেকে ছড়িয়ে পড়া তেজস্ক্রিয় বিকিরণ অনেক বছর ধরে মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীর জন্য ক্ষতির কারণ হয়।

জানতে চাইলে পরমাণু শক্তি কমিশনের সাবেক প্রধান প্রকৌশলী আবদুল মতিন প্রথম আলোকে বলেন, তেজস্ক্রিয় জ্বালানি বর্জ্য অত্যন্ত সুরক্ষিত ব্যবস্থায় সংরক্ষণ করতে হয়। এ জন্য এমন একটি বিচ্ছিন্ন স্থান প্রয়োজন হয়, যেখানে কখনো কোনোভাবে পানি যাবে না। সাধারণত মাটির অনেক নিচে জলাধার তৈরি করে সেখানে শক্তিশালী কংক্রিট দিয়ে ঘিরে তেজস্ক্রিয় বর্জ্য সংরক্ষণ করতে হয়। অনেক বছর ধরে তার ধারেকাছে কোনো মানুষের আনাগোনা চলে না। যদিও একসময় এই জ্বালানি পুনরায় ব্যবহার করা যায়, কিন্তু এর সংরক্ষণব্যবস্থা গড়ে তোলা আলাদা একটি বিশেষায়িত স্থাপনা নির্মাণ ও সংরক্ষণ করার মতো। এতে যেমন ব্যয় আছে, তেমনি আছে ঝুঁকি।

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সূত্র জানায়, বাংলাদেশের পক্ষ থেকে চেষ্টা করা হচ্ছে তেজস্ক্রিয় জ্বালানি বর্জ্য ফেরত নেওয়ার বিষয়ে রাশিয়ার অবস্থান পরিবর্তন করানোর। এই চেষ্টা সফল হলে তেজস্ক্রিয় জ্বালানি বর্জ্য সরবরাহের বিষয়ে যে চুক্তি হবে, সেখানে তা অন্তর্ভুক্ত হবে। অন্যথায় বাংলাদেশ বড় রকমের সমস্যায় পড়বে।

১ লাখ কোটি টাকার বেশি ব্যয়ের এই প্রকল্প ২০০৯ সালে গ্রহণ করা হয়। রাশিয়ার প্রযুক্তি এবং ঋণ সহায়তায় প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হচ্ছে। আগামী ডিসেম্বরে পাবনা জেলার ঈশ্বরদী উপজেলার রূপপুরে এটির নির্মাণ-পর্ব শুরু হওয়ার কথা।

এই পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ৫০ বছর ধরে ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে। কেন্দ্রের ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার প্রথম ইউনিটটি ২০২৩ সালে এবং দ্বিতীয় ইউনিটটি ২০২৪ সালে পরীক্ষামূলকভাবে চালু করার লক্ষ্যে কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। প্রথম ও দ্বিতীয় ইউনিটে বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরুর লক্ষ্য যথাক্রমে ২০২৪ ও ২০২৫ সালের অক্টোবরে।

দক্ষ জনবল তৈরির সুপারিশ

রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের নির্মাণ ও পরিচালনার জন্য দক্ষ জনবল তৈরির সুপারিশ করেছে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। গতকাল বুধবার সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত কমিটির বৈঠকে এই সুপারিশ করা হয়। বৈঠক শেষে কমিটির সদস্য ইমরান আহমেদ সাংবাদিকদের বলেন, দেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র হবে রূপপুর। এটি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য দক্ষ জনবল দরকার। সে জন্য নিয়োগ পাওয়া জনবলের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। তাঁদের বেতন-ভাতা আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী হতে হবে। রাশিয়া থেকে যাঁরা প্রশিক্ষণ নিয়ে আসবেন, তাঁরা এসেই যদি রূপপুরে কাজ শুরু করেন, তাতে ঝুঁকি থেকে যাবে। তাঁরা যেখানে প্রশিক্ষণ নেবেন বা নিচ্ছেন, সেখানেই কোনো প্রকল্পে কাজ করে এলে অভিজ্ঞতা বাড়বে এবং ঝুঁকি কমে যাবে।

কমিটির বৈঠকের কার্যপত্র থেকে জানা গেছে, প্রকল্প ব্যবস্থাপনার কাজে দক্ষতা বাড়ানোর জন্য ইতিমধ্যে ভারতে ৫৫ জন কর্মকর্তার ‘ফাউন্ডেশন কোর্স অন নিউক্লিয়ার এনার্জি’-বিষয়ক প্রশিক্ষণ শেষ হয়েছে। এ বছরের ডিসেম্বর নাগাদ আরও ৩০-৩৫ জন কর্মকর্তাকে প্রশিক্ষণের জন্য পাঠানো হবে। রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য ২০১৬ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন পর্যায়ে ২ হাজার ৫৩৫ জনের জনবল প্রয়োজন হবে। তাঁদের মধ্যে ১ হাজার ৪২৪ জনকে রাশিয়ায় প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। ইতিমধ্যে বিদ্যুৎকেন্দ্রের নকশা ও নিরাপত্তার জন্য ৪৭ জন শিক্ষার্থীকে রাশিয়ায় নিউক্লিয়ার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ওপর উচ্চশিক্ষার জন্য পাঠানো হয়েছে।

কমিটির সভাপতি আ ফ ম রুহুল হকের সভাপতিত্বে বৈঠকে কমিটির সদস্য ইমরান আহমেদ, আয়েন উদ্দিন ও নুরুল ইসলাম মিলন অংশ নেন। বিশেষ আমন্ত্রণে উপস্থিত ছিলেন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমন্ত্রী ইয়াফেস ওসমান।