Thank you for trying Sticky AMP!!

দখলদারদের পক্ষে সরকারি সংস্থা

রাজধানীর উপকণ্ঠে কামরাঙ্গীরচর এলাকায় নদীর তীর দখল করে নির্মিত কিছু স্থাপনা ভেঙে দেওয়া হয়েছিল, সেগুলোর পাশে নতুন করে আবারও স্থাপনা তৈরি হচ্ছে। গতকাল সকালে। ছবি: হাসান রাজা

ঢাকার কামরাঙ্গীরচরের নবাবচরে বুড়িগঙ্গা নদী দখল স্থায়ী রূপ নিচ্ছে। নদীর সীমানা নির্ধারণ বিষয়ে জেলা প্রশাসনের একটি প্রতিবেদনের কারণে এই অবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে। এর সঙ্গে রয়েছে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের চাপ এবং অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) উদ্যোগের অভাব।

বিআইডব্লিউটিএ ও জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান গত বছরের এপ্রিলে বুড়িগঙ্গার কামরাঙ্গীরচর এলাকা পরিদর্শন করেছিলেন। এ সময় তিনি নদীর যে ১৩টি জায়গায় অবৈধ স্থাপনা গড়ে উঠেছে, সেগুলো ভাঙার ঘোষণা দেন। এরপর ১০ জুলাই বিআইডব্লিউটিএ অভিযান চালিয়ে তিনটি স্থাপনার বাইরের দেয়ালের সামান্য অংশ ভেঙে দেয়। সাংসদ হাজি সেলিমের মালিকানাধীন একটি স্থাপনার সীমানাদেয়াল ভাঙা হয়।

জানা গেছে, এরপরই নবাবচরে নদীতীরের ভবনমালিকেরা জেলা প্রশাসনের কাছে সীমানা নির্ধারণের আবেদন জানালে একটি কমিটি করা হয়। কমিটি সিএস (ক্যাডেস্টাইল সার্ভে) ও আরএস (রিভাইস সার্ভে) রেকর্ড অনুযায়ী নদীর সীমানা নির্ধারণের প্রস্তাবসহ একটি প্রতিবেদন দাখিল করে। এরপরই অভিযান বন্ধ হয়ে যায়।

বিআইডব্লিউটিএর চেয়ারম্যান মোজাম্মেল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, জেলা প্রশাসন বর্তমানে শুধু সিএস ও আরএস অনুসারে জরিপ করে সীমানা খুঁটি বসাতে চাইছে। তারা চায় নদীর ওপরে নয়, নিচে খুঁটি স্থাপন করতে। এতে নদীর স্বার্থ রক্ষা পাবে না।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চারটি নদীর বিষয়ে ২০০৯ সালে দেওয়া হাইকোর্টের আদেশে সিএস ও আরএসের কথা বলা হয়েছে মূলত নদীর অবস্থান নির্ণয়ের জন্য। সীমানা চিহ্নিত হবে নদীর আকার অনুযায়ী। আদেশে নদীর সীমানা নির্ধারণে সবকিছু বিবেচনায় নেওয়ার নির্দেশনা রয়েছে। অথচ জেলা প্রশাসন প্রতিবেদনে শুধু সিএস ও আরএস মানচিত্র অনুসরণে জরিপ করতে চাইছে। এভাবে করা হলে বর্তমানে স্থাপিত খুঁটিগুলো ১০০ থেকে ২০০ ফুট নদীর দিকে নামিয়ে নিতে হবে।

জানতে চাইলে সদ্য যোগ দেওয়া জেলা প্রশাসক আবু সালে মো. ফেরদৌস খান বলেন, তিনি বিষয়টি খতিয়ে দেখবেন। তবে জেলা প্রশাসন অবশ্যই নদী রক্ষার স্বার্থে কাজ করবে।

এদিকে নবাবচরে নদীতীরের স্থাপনার মালিকেরা প্রথম আলোকে বলেছেন, নৌমন্ত্রী ও খাদ্যমন্ত্রীকে বোঝাতে সক্ষম হওয়ায় জুলাইয়ের পরে উচ্ছেদ অভিযান বন্ধ হয়।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে নৌমন্ত্রী শাজাহান খান প্রথম আলোকে বলেন, বাড়ির মালিকেরা এবং খাদ্যমন্ত্রী মাপজোখ করতে বলায় তখন উচ্ছেদ বন্ধ রাখা হয়।

আর খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম বলেন, ‘বাড়ির মালিকেরা অভিযোগ করেছিলেন, ঠিকভাবে মাপজোখ না করেই নদীর সীমানা নির্ধারণ করা হয়েছে। তাঁদের অভিযোগের ভিত্তিতেই নৌমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করেছিলাম। এখন যদি ভাঙতে চায়, ভেঙে দিক।’

স্থাপনা মেরামত ও বাড়ানোর উৎসব

নবাবচর এলাকাটি বুড়িগঙ্গা নদীর ঢাকা প্রান্তে। গত বৃহস্পতিবার সকালে এখানকার গুদারাঘাট-আশ্রাফাবাদ এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, নদীতীরে অনেকগুলো পাকা ভবন। আরও ভবন তৈরির জন্য প্রচুর ইট, বালু, রড, সিমেন্ট জড়ো করা হয়েছে। আগে তৈরি বাড়িগুলোর কোনোটায় সদ্য রং লাগানো হয়েছে। ‘ভাড়া হবে’ সাইনবোর্ডও ঝুলছে। এগুলোর কিছু নদীর সম্পূর্ণ ও কিছু আংশিক জায়গায় অবস্থিত।

এলাকাবাসী জানান, গত জুলাইয়ে উচ্ছেদ অভিযান চালানোর পর বেশির ভাগ বাড়ির লোকজন সরে গিয়েছিলেন। মাসখানেক আগে আবার সবাই ফিরে এসেছেন। ভেঙে দেওয়া স্থাপনা মেরামত করা হয়। আগের স্থাপনার সঙ্গে নতুন অংশও যুক্ত হয়।

এলাকা ঘুরে দেখা যায়, নদীর অস্থায়ী সীমানা খুঁটির ভেতরের জায়গায় স্থাপনা রয়েছে ঢাকা-৭ আসনের সাংসদ হাজি মো. সেলিমের মালিকানাধীন মদীনা ট্রেডিংয়ের রড-সিমেন্ট বিক্রির একতলা পাকা স্থাপনা ও স মিল। পাশের দোতলা ভবনের মালিক মো. সিরাজ নতুন অংশ যুক্ত করেছেন। মো. সিরাজ প্রথম আলোকে বলেন, তিনি নদীর এক ইঞ্চি জায়গাও নেননি।

গুদারাঘাট সড়কের পাশেই একটি ছয়তলা ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। উচ্ছেদ অভিযানের পর ভবনটি তালাবন্ধ ছিল। তবে মাসখানেক আগে ভবনটি সংস্কার করে রং লাগানো হয়। নিচতলায় কুসুম কনফেকশনারি নামে একটি দোকান। দোকানি বলেন, দুই লাখ টাকা আগাম দিয়ে ভাড়া নিয়েছেন। পাশেই নদীতীরে কেরামত আলী নামের এক ব্যক্তির আংশিক ভেঙে দেওয়া দোতলা ভবন ও সীমানাদেয়াল মেরামত হচ্ছে।

অপর একটি দোতলা ও একতলা ভবনে নকিয়া ফ্রুট ইন্ডাস্ট্রিজ ও বেল্ট সু-প্লাস্টিক অ্যান্ড রাবার ফ্যাক্টরি। দক্ষিণ মুন্সিহাটি নদীর পাড়ে আরেকটি দোতলা ভবনে দোকানপাট। পাশেই পারফেক্ট ডেলটা ফ্যাক্টরি নামে একটি প্লাস্টিক ও ইনসাফ ফ্রুটস এগ্রো বেজ ইন্ডাস্ট্রিজের কারখানা। এ ছাড়া নদীতীরে রয়েছে ১৪টি স মিল, মিষ্টির দোকান, ডেইরি ফার্ম, গুদামসহ অবৈধ স্থাপনা।

এদের সবার পক্ষ থেকে ভবনমালিক মো. সিরাজ ও মো. মাহবুব প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা বহু বছর ধরে এসব জায়গার খাজনা দিয়ে আসছেন। সুতরাং তাঁরাই জায়গার প্রকৃত মালিক।

তবে আইনজীবী মনজিল মোরসেদ এ বিষয়ে প্রথম আলোকে বলেন, অর্থনৈতিক স্বার্থেই জেলা প্রশাসন ভবনমালিকদের পক্ষ নিয়ে প্রতিবেদন তৈরি করেছে। এই প্রতিবেদন থাকলে চার নদী বিষয়ে যে মূল রায়, তা অকার্যকর হয়ে যাবে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, নবাবচরে নদীতীরের অন্তত আধা কিলোমিটার এলাকাজুড়ে নির্মিত স্থাপনাগুলোর নকশার অনুমোদন পর্যন্ত নেওয়া হয়নি। কামরাঙ্গীরচরের রসুলপুর থেকে বসিলা পর্যন্ত প্রায় ছয় কিলোমিটার এলাকায় নদীতীরে শত শত অবৈধ স্থাপনা রয়েছে। একইভাবে তুরাগ, বালু ও শীতলক্ষ্যার জায়গা বেদখলে রয়েছে।