Thank you for trying Sticky AMP!!

দীর্ঘমেয়াদি সমাধান খুঁজতে হবে

জঙ্গিবাদ এখন জাতীয় নিরাপত্তার সমস্যা। এটাকে সম্পূর্ণ নির্মূলের জন্য দলীয় রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে সমাধানের পথ খুঁজতে হবে। এখন পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ব্যবহার করে জঙ্গি সমস্যার সমাধানের পথে যাচ্ছে, সেটা সাময়িক। আমাদের সংবিধানসম্মত দীর্ঘ মেয়াদের সমাধান খুঁজতে হবে।

গতকাল বুধবার প্রথম আলো আয়োজিত ‘জঙ্গিবাদের বিপদ ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা এসব কথা বলেছেন। সবার কথা শুনে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, ‘এই মুহূর্তে জঙ্গিবাদকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে আমরা থমকে যাব। আমাদের মধ্যে হতাশা কাজ করবে। তাই আমরা এদের দমনের সর্বাত্মক চেষ্টা করছি। আমাদের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনাও রয়েছে।’

>
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান
প্রথম আলোর গোলটেবিল বৈঠক
জঙ্গিবাদকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে আমরা থমকে যাব। হতাশা কাজ করবে। তাই আমরা এদের দমনের সর্বাত্মক চেষ্টা করছি: স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর উপস্থিতিতে আলোচনায় অংশ নেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) সাখাওয়াত হোসেন, মানবাধিকার নেত্রী সুলতানা কামাল, মেজর জেনারেল (অব.) এ এন এম মনিরুজ্জামান ও এয়ার কমোডর (অব.) ইশফাক ইলাহী চৌধুরী, সংবিধান বিশেষজ্ঞ শাহদীন মালিক এবং বুয়েটের সাবেক শিক্ষার্থী কাশফিয়া নেহরীন ও মাদ্রাসার শিক্ষার্থী মো. জুবায়ের। বৈঠক সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম।

একদিকে সম্ভাবনাময় তরুণদের জঙ্গিবাদে ঝুঁকে পড়া এবং আরেকদিকে জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্ন। সমাধানের পথ কী—বন্দুকযুদ্ধ, নাকি আইনের শাসন? সাময়িক সমাধান না দীর্ঘ মেয়াদে মূলোৎপাটনের পরিকল্পনা? এসব বিষয় আলোচনায় উঠে আসে।

আর্থিক ধাক্কাটাও বড় বিষয়

শুরুতেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান জঙ্গিবাদের বিপদগুলো তুলে ধরে বলেন, ‘জঙ্গিদের হাতে যাঁরা মারা গেছেন, তাঁদের জন্য শোক তো রয়েছেই। আর্থিকভাবে যে ধাক্কাটা এসেছে, সেটাও বড় বিষয়। ঢাকার হোটেলগুলো যে ব্যবসা করত, জঙ্গি হামলার পরে তা কমে ১০ ভাগে নেমে এসেছে। দেশে পদ্মা সেতুসহ যেসব বড় উন্নয়নকাজ চলছে, সেগুলোর বিদেশি অংশীদারেরাও নিহত হয়েছেন। জাপানের আন্তর্জাতিক সংস্থা জাইকার কয়েকজন বিশেষজ্ঞ নিহত হয়েছেন। একজন ইতালিয়ান নাগরিক, যিনি ৩০ বছরের বেশি সময় ধরে এ দেশে রয়েছেন বাংলাদেশের বন্ধুর মতো, যিনি তৈরি পোশাকশিল্পের উন্নয়নে অবদান রেখে গেছেন, তিনিও নিহত হয়েছেন। বাংলাদেশের এগিয়ে যাওয়ার পথে আরও অনেক কিছুতেই বড় সংকট তৈরি হয়েছিল। তারপরও আমরা অনেকখানি কাটিয়ে উঠতে পেরেছি। জাপান দৃঢ়তার সঙ্গে বলেছে, উন্নয়নকাজ বাধাগ্রস্ত হবে না।’

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘এখন প্রশ্ন, কেন যুবকেরা এ পথে যাচ্ছে? আগে মাদ্রাসার ছেলেরা যেত, বলা হতো তাদের অনেক চাহিদা ছিল, তারা অনেক কিছু বুঝত না। কিন্তু সন্ত্রাসবাদের নবতম সংস্করণে তারা আপনার-আমার ছেলেমেয়েদের ধরেও টান দিচ্ছে। কেউ বলছেন, অভিভাবকেরা ঠিকমতো নজর রাখছেন না। কেউ বলছেন সংস্কৃতির চর্চা না করে প্রযুক্তির দিকে অতিরিক্ত ঝুঁকে পড়ার কারণে এ রকম হতে পারে। আমরা সবকিছু নিয়েই কাজ করছি। আমাদের মানতে হবে, দেশে স্কুলের সংখ্যা যত, মাদ্রাসার সংখ্যাও কম নয়। বিরাট সংখ্যার ছেলেমেয়ে মাদ্রাসায় পড়ে। এখন তারাও এই জঙ্গিবাদের বিরোধিতা করছে। ইমামেরা এটা নিয়ে কথা বলছেন। সরকারের পক্ষ থেকে মাদ্রাসাশিক্ষার সঙ্গে জড়িত লোকজন, হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টানদের ধর্মগুরুসহ সবার সঙ্গেই আলোচনা হচ্ছে। সবাই বলেছেন, এই হানাহানি কোনো সময় কোনো ধর্মেই গ্রহণযোগ্য নয়। ইসলাম একটি শান্তির ধর্ম। এখানে কোনো কারণ ছাড়া গাছের একটি পাতারও অনিষ্ট করা নিষেধ করা আছে।’

মন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোক্তা, শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলা হয়েছে। তাঁদের নজর এড়িয়ে যে ঘটনাগুলো ঘটেছে, সেগুলো নিয়েও কথা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীও সকলকে এগিয়ে আসার জন্য বলেছেন। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে এ সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য মানুষ একত্র হয়েছে। আমি সারা দেশে ঘুরে বেড়াচ্ছি। দেখেছি, ছোট শিশু থেকে শুরু করে বৃদ্ধ পর্যন্ত সকলে জঙ্গিবাদের প্রতিবাদ জানাতে আসছে। এটা যে জঘন্য অপরাধ, মানুষ সে কথা বলছে। আমি আশা করি, আমরা তাদের বোঝাতে সক্ষম হয়েছি। অনেকে পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে, বাসায় ফিরে এসেছে। যেসব জঙ্গি নিহত হয়েছে তাদের একজনেরও বাবা-মা তাদের কৃতকর্ম সমর্থন করেননি। তাদের লাশটিও নিতে আসেননি। হাসপাতাল থেকে চিঠি দিয়ে বলা হচ্ছে, তারা আর লাশ রাখতে পারছে না।’

সাখাওয়াত হোসেন

দীর্ঘ মেয়াদের পদক্ষেপ দৃশ্যমান হয়নি: সাখাওয়াত হোসেন
সাবেক নির্বাচন কমিশনার সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘জঙ্গিরা যখন হত্যা করা শুরু করল, তখন সরকারের পক্ষ থেকে বিষয়টিকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলা হয়েছিল। তবে আমি বলেছি একটা ধরন তৈরি হচ্ছে। বোঝা যাচ্ছিল, তাদের ধরনে পরিবর্তন আসছে। মাদ্রাসার দিকে নজর ছিল, তারা এখন সেটাতে নেই। ওসামা-পরবর্তী ও আইএস-পরবর্তী জঙ্গিবাদের কৌশলের মধ্যে পার্থক্য তৈরি হয়েছে। আমরা বুঝতে পারিনি। যখন আমাদের ছেলেমেয়েদের নিয়ে চলে গেল, হলি আর্টিজানের ঘটনা ঘটাল, তখন আমাদের টনক নড়ল। অথচ সাড়ে তিন বছর আগে যখন একজন ব্লগার (রাজীব হায়দার) হত্যায় নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা ধরা পড়ল, তখনই আমাদের বোঝা উচিত ছিল। জঙ্গিবাদ দমনের জন্য সরকার যা করছে, তা স্বল্প মেয়াদের পদক্ষেপ। দীর্ঘ মেয়াদের কোনো পদক্ষেপ এখনো দৃশ্যমান হয়নি।’

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর উদ্দেশে ব্রিগেডিয়ার (অব.) সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে একজন মুখপাত্র রাখুন, একটা সমন্বয় সেল খুলুন। না হলে পুলিশের আইজি এক কথা বলেন, আবার ডিআইজি এসে আরেক কথা বলেন, র‍্যাবের লোক আরেক দিকে বলেন। এটা যত দিন বন্ধ না হবে, তত দিন মানুষের সন্দেহ ঘুচবে না। আর জঙ্গিবাদের পাল্টা আদর্শের প্রচার করতে হবে সমাজের বিভিন্ন পর্যায়ের লোকজনকে দিয়ে। না হলে মানুষ ভাবে, এগুলো রাজনৈতিক বক্তব্য। মাঝে খুতবা নিয়ে একটা বিতর্ক হলো, বলা হলো অমুকে খুতবা তৈরি করেছে। তিনি বলেন, গুলশানের দিকে নিরাপত্তা দিয়ে একটা কঠিন ব্যাপার তৈরি করা হয়েছে। এদিকে রাস্তা বন্ধ, সেদিকে যেতে পারবেন না। কখনো কখনো অতি নিরাপত্তা মানুষের মধ্যে অনিরাপত্তার বোধ তৈরি করে।’

সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘পুলিশ অ্যাকশন’ হচ্ছে ঠিক আছে। মানুষ সচেতনও হয়েছে। কিন্তু এখন যে কার্যক্রমগুলো চলছে, তাতে হয়তো এক বছর চুপ থাকবে জঙ্গিরা। এদের আন্তর্জাতিক যোগাযোগ রয়েছে। দুই বছর পরে আবারও মাথা বের করবে। তাই দীর্ঘ মেয়াদের পরিকল্পনা নিয়ে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

সুলতানা কামাল

দেশে সুশাসনের প্রচণ্ড অভাব রয়েছে: সুলতানা কামাল
সুলতানা কামাল বলেন, ‘বাংলাদেশ জঙ্গিবাদ প্রসারের উপযোগী নয় কখনোই। আমরা আবেগ দিয়েই বলি, এ দেশের মানুষ সাম্প্রদায়িকতাকে প্রশ্রয় দেয়নি। সেই দেশের ছেলেরা এ রকম নৃশংস হত্যায় জড়াচ্ছে এটা আমরা ভাবতে পারি না। এর পেছনে সামাজিক, রাজনৈতিক ও আর্থসামাজিক বিষয় রয়েছে। একটা সময় ভাবা হতো, কেবল মাদ্রাসার ছেলেরা এর পেছনে জড়িত। তারা বদ্ধ পরিবেশে, বিচ্ছিন্ন, ক্ষুদ্রত্ব ও খণ্ডত্ব নিয়ে বড় হয়। তারা নিজেদের বৃহত্তর মানবিক সমাজের অংশ ভাবতে পারে না। এখন দেখা যাচ্ছে, অনেক ধনীর ছেলেরাও এতে জড়াচ্ছে। তারাও বিচ্ছিন্ন এবং খণ্ডত্ব নিয়ে বড় হচ্ছে। তারাও নিজেদের বৃহত্তর মানবিক সমাজের অংশ ভাবে না। হয়তো তারা এত ধনী যে, ভাবতে পারে না। তাদের বলা হয় এ পথে গেলে পরবর্তী জীবনে বেহেশত পাওয়া যাবে। এই চিন্তাকে আমরা ঢালাওভাবে সমাজে বাড়তে দিয়েছি ’৭৫-পরবর্তী সময়ে। এই ছেলেরা ধর্মনিরপেক্ষতা, নারী স্বাধীনতা, বহুত্ববাদ—এসবের ঘোর বিরোধী। অথচ এসবই ছিল স্বাধীনতার চেতনা। তারা নির্বিচারে মানুষ মারছে। একাত্তরেও এ রকম হত্যা করেছে পাকিস্তানিরা। তারা মানুষকে বার্তা দিতে চেয়েছে যে আমার মতো না হলে তুমি বাঁচবে না। অতি সংকীর্ণ স্বার্থবাদী সংস্কৃতি তাদের আক্রান্ত করেছে। শিক্ষা, পারিবারিক পরিমণ্ডল, সর্বোপরি দেশে সুশাসনের প্রচণ্ড অভাব রয়েছে।’

সুলতানা কামাল বলেন, ‘যাঁরা জীবন দিয়ে মানুষের নিরাপত্তা রক্ষা করছেন, তাঁদের প্রতি সম্মান রেখেই বলছি, পুলিশ এখন বাহিনী হিসেবে মানুষের অনাস্থার মধ্যে চলে গেছে। একজন অপরাধের শিকার মানুষ ভাবতে পারে না যে পুলিশের কাছে গেলে তিনি এর সমাধান পাবেন। গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে গুলশান-বনানী-বারিধারায় জঙ্গিবাদ ছড়িয়েছে। রাজনীতিকেরা আপসকামিতার রাজনীতি করছেন। বিভিন্ন শ্রেণি–পেশার মধ্যে জঙ্গিবাদের সমর্থক তৈরি হয়েছে। যার কারণে এ পরিস্থিতিতে আমরা ভীত হয়ে পড়ছি।’

ইশফাক ইলাহী চৌধুরী

সুচারু শুদ্ধি অভিযান চালাতে হবে: ইশফাক ইলাহী
ইশফাক ইলাহী চৌধুরী বলেন, জঙ্গিবাদের বিষয়টাকে অত্যন্ত সরলীকরণ করে দেখার চেষ্টা হয়েছে। তত দিনে এটা অনেক ভেতরে চলে গেছে। যদি বিএনপি-জামায়াতের বিষয়টা না আসত, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নাও হতো, জামায়াত এতটা উগ্র পরিস্থিতি তৈরি না করত, তবু জঙ্গিবাদ আসতে পারত। সমাজের নানা স্তরে জঙ্গিবাদ ঢুকে গেছে। সুচারু শুদ্ধি অভিযান চালাতে হবে। একেকটা সেরা ছেলে ও পথে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। এরা মাদ্রাসার একটা ছেলের চেয়ে অনেক বেশি ক্ষতিকর হতে পারে।

ইশফাক ইলাহী বলেন, হেফাজতে ইসলামের ১৩ দফা বাংলাদেশে তালেবানি শাসনের দলিল। মাদ্রাসায় যে বাংলা বই দেওয়া হয়েছে, সেগুলোতে সব অদ্ভুত বিকৃতি রয়েছে। শুধু বই দিলে হবে না, এগুলো পর্যালোচনা করতে হবে।

শাহদীন মালিক

চিন্তার পথটা বন্ধ হয়ে গেছে: শাহদীন মালিক
আইনজীবী শাহদীন মালিক বলেন, ‘মানুষের মধ্যে জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে একটা অভূতপূর্ব জাগরণ হয়েছে। আমি মনে করি, জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে এটা একটা বড় যুদ্ধ জয়। ১৯৯১-পরবর্তী সরকারগুলো ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করে দিয়ে জঙ্গিদের ধারণাগুলোকে দাঁড়াতে সুযোগ দিয়েছে। ছাত্ররাজনীতির চর্চা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এর মাধ্যমে ভালো কাজ করার জায়গাগুলো আমরা বন্ধ করে দিয়েছি। ডাকসু, চাকসু নির্বাচন বন্ধ হয়ে গেছে, এর বিকল্প কোনো ব্যবস্থাও রাখা হয়নি। যার কারণে চিন্তার পথটা বন্ধ হয়ে গেছে। আশির দশকে যাঁরা ছাত্ররাজনীতি করেছেন, তাঁরা এখনো এ দেশের রাজনীতিতে সক্রিয়। এর পরে অরাজনৈতিক লোকজন দেশের নেতৃত্বে আসবেন। এ জন্য দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে আমি শঙ্কিত।’

তিনি বলেন, কঠোর হাতে দমনপদ্ধতি প্রথমে কাজে দিলেও পরে ভোঁতা হয়ে যায়।

শাহদীন মালিক বলেন, কিছু মৌলিক বিষয় কোনো অবস্থাতেই এড়িয়ে যাওয়া যায় না। যেসব দেশ সংবিধান বন্ধ করে সমাধান চেয়েছে, তারাই ব্যর্থ হয়েছে। যেসব দেশ বিচারবহির্ভূত হত্যার মাধ্যমে সমাধান খুঁজেছে, ১৫–২০ বছর পরে সেগুলোতে হানাহানি বেড়েছে, মারাত্মক অবস্থা তৈরি হয়েছে। সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণা অনুযায়ী যুদ্ধাবস্থাতেও কিছু বিষয় মেনে চলতে হয়। আজ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হচ্ছে। কারণ, তাঁরা ওই সময় এমন কিছু করেছিলেন, যেটা যুদ্ধাবস্থাতে করাটা অপরাধ। জঙ্গিবিরোধী অভিযানের সময়ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে আইন মেনে চলার বিষয়টা মাথায় রাখতে হবে। কারণ, এটাই সন্ত্রাসী ও পুলিশের মধ্যে তফাত। সন্ত্রাসীরা আইন মানে না, যা-তা করে, পুলিশ আইন মেনে চলে, এটা নিশ্চিত করতে হবে।

এ এন এম মনিরুজ্জামান

এটা জাতীয় নিরাপত্তাজনিত সমস্যা: মনিরুজ্জামান
বাংলাদেশ পিস অ্যান্ড সিকিউরিটিজ স্ট্যাডিজের সভাপতি অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল এ এন এম মনিরুজ্জামান বলেন, ‘এটা একটা জাতীয় নিরাপত্তাজনিত সমস্যা। সে জন্য সংকীর্ণ রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে জাতীয় নিরাপত্তার জন্য সমাধানের পথ খুঁজতে হবে। সমস্যাটা কোনোভাবেই শুধু দলের বা সরকারের নয়, এটা পুরো রাষ্ট্রের সমস্যা, সমাজের সমস্যা। এ জন্য সমাজের মানুষের ব্যাপকভিত্তিক অংশগ্রহণে সংলাপ প্রয়োজন। বর্তমানের কিছু পদক্ষেপে আমরা সাময়িক কিছু সুফল পাচ্ছি। এই সুফল খুব সাময়িক, এটা বেশি দিন ধরে রাখা যাবে না। বড় অভিযানে প্রবণতা থাকে আইন ভাঙার। দু-চারটা জঙ্গি বা কিছুসংখ্যক নেতাকে সরিয়েই জঙ্গিবাদ দমন করা যাবে না। যার কারণে ২০০৭ সালে বাংলা ভাই আর তাঁদের সহযোগীদের ফাঁসি হয়ে যাওয়ার অনেক বছর পরেও তারা আরও প্রবল ও প্রকটভাবে আবির্ভূত হয়েছে।’

মনিরুজ্জামান বলেন, ‘আমরা সন্ত্রাস দমনের অবকাঠামো গড়ে তুলতে পারিনি। সন্ত্রাসবাদ একটা দীর্ঘ প্রক্রিয়ার ফলাফল মাত্র। তাই শুধু এর ফলাফলটা না দেখে এর প্রক্রিয়াটা বুঝতে হবে। এটা কোনো পুলিশিং সমস্যা নয়, ব্যাপকভিত্তিক সামাজিক সমস্যা। যারা জঙ্গিবাদের দীক্ষা নিয়েছে, তাদের সেই বিষমুক্ত করতে হবে। সবাইকে তো আর “ক্রসফায়ারে” দেওয়া যাবে না। কারাগারে নজরদারি বাড়াতে হবে। সেখানেও জঙ্গিবাদের বীজ বোনা চলছে। নিচের সারির জঙ্গিরা কারাগার থেকে জঙ্গিনেতা হয়ে বের হচ্ছে। তাদের অনুসারীও তৈরি হচ্ছে। শহুরে তরুণসমাজের প্রধান সমস্যা, ইন্টারনেটের মাধ্যমে জঙ্গিবাদীদের সংস্পর্শে আসা। বর্তমানে ইন্টারনেটের ওপর যে নজরদারি রয়েছে, তা এ ধরনের জঙ্গিবাদ রোধে সক্ষম নয়। এটাকে রাজনৈতিক নজরদারি বলা যায়।’

মো. জুবায়ের

গণগ্রেপ্তারে সমাধান নয়: জুবায়ের
কুমিল্লা আলিয়া মাদ্রাসার ছাত্র মো. জুবায়ের বলেন, এখন এমন অবস্থা তৈরি হয়েছে যে একজন তরুণ হঠাৎ করে ধূমপান ছেড়ে মসজিদে গেলে অভিভাবকদের বুকের কাঁপুনি শুরু হয়ে যায়। অথচ সব বাবা-মাই চান তাঁদের সন্তান ভালো কাজ করুক। এই জঙ্গিবাদের কারণে ধর্মের ভিত্তিটাই ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। তবে মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের যদি নির্বিচারে দূরে সরিয়ে দেওয়া হয়, এর ফল ভালো হবে না। এখন শহুরে উচ্চবিত্ত ছেলেরাও এর সঙ্গে জড়াচ্ছে। যার কারণ, সব ধর্মেই স্বর্গের বর্ণনা খুবই লোভনীয়। যখন এ ধরনের তরুণের সামনে কেউ স্বর্গে যাওয়ার ‘মেগা অফার’ নিয়ে আসে তখন তরুণেরা নিজেদের সামলাতে না পেরে ভুল কাজটি করে বসে। তবে এসবের সমাধান গণগ্রেপ্তারে নয়। যুক্তরাষ্ট্রে কখনো গণগ্রেপ্তারের কথা শোনা যায় না। নিজের অভিজ্ঞতার বর্ণনা করে জুবায়ের বলেন, গণগ্রেপ্তারের সময় আমাদের মতো সাধারণ মানুষকে খুবই আতঙ্কে থাকতে হয়।

কাশফিয়া নেহরীন

শিক্ষা ও সুশিক্ষার তফাত বুঝতে হবে: কাশফিয়া
বুয়েটের সাবেক শিক্ষার্থী কাশফিয়া নেহরীন বলেন, এ দেশে মাদ্রাসা, সাধারণ শিক্ষা ও ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষার্থীদের মধ্যে কোনো যোগাযোগ নেই। মাদ্রাসাছাত্ররা জানেই না, ইংরেজি মাধ্যমের স্কুলগুলোতে কী হয়। ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষার্থীদেরও মাদ্রাসা সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই।
তরুণদের মধ্যে কোনো আদর্শিক বিষয় নেই উল্লেখ করে কাশফিয়া বলেন, ‘সেই মগজই ধোলাই করা সম্ভব, যেটা খালি। মাথায় আদর্শিক বিষয় থাকলে তা ধোলাই করা কঠিন। হামলা হয়েছে বলে সব রেস্তোরাঁ বন্ধ করে দেওয়া হলো, তাহলে তো হলো না। মাথাব্যথা হলে তো মাথা কেটে ফেলার দরকার নেই, চিকিৎসা করাতে হবে। পরিবার থেকেও জঙ্গিবাদের শিক্ষা শুরু হতে পারে। যখন পরিবারের কেউ বিশ্বাস করে, চাঁদে কাউকে দেখা যাচ্ছে, তখন কি আমিও সেটা বিশ্বাস করব? আমার শিক্ষা কী বলে। শিক্ষা ও সুশিক্ষার তফাতটা বুঝতে হবে, সুশিক্ষা দিতে হবে।’

সহযোগিতা চাইলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী

সবশেষে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বক্তাদের তোলা বিভিন্ন বিষয়ের ব্যাখ্যা দেন। গণগ্রেপ্তার সম্পর্কে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, পুলিশকে বিভিন্নভাবে কাজ করতে হয়। গণগ্রেপ্তারের সময় যারা ধরা পড়েছে, তাদের বেশির ভাগই পরোয়ানাভুক্ত আসামি। জঙ্গিদের ধরতে গেলে তারা যখন সামনে পড়ে, তখন তাদের তো আর পুলিশ না ধরে রেখে আসতে পারে না।

মন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ খুবই একটা ভালো পরিস্থিতিতে আছে যে এখানে তরুণদের সংখ্যা বেশি। আপনারা যত কথাই বলেন না কেন, এর পেছনে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক একটা ষড়যন্ত্র রয়েছে। সেটা কি আপনারা একটু বিশ্লেষণ করে দেখবেন? জঙ্গিবাদবিরোধী দীক্ষা (ডির‍্যাডিকালাইজেশন) সম্পর্কে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, এ জন্য চিন্তা করা হচ্ছে। পুলিশে কাউন্টার টেররিজম ইউনিট করা হয়েছে।

কিছু জটিলতা রয়েছে উল্লেখ করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, মুফতি হান্নানের ফাঁসির রায় হলেও আইনি জটিলতায় এত দিনেও তা কার্যকর হচ্ছে না। ভয়ংকর অপরাধীরাও জামিনে বেরিয়ে আরও ভয়ংকর কিছু করার চেষ্টা করছে।

পুলিশের সমালোচনার বিষয়ে মন্ত্রী বলেন, ‘পুলিশের একটা রূপ দেখেছেন। কিন্তু এখন পরিবর্তনও হচ্ছে। তবে ধীরে। পুলিশের অপরাধ নেই তা বলছি না। আমাদের হাতে তো জাদুর কাঠি নেই যে রাতারাতি সব পাল্টে ফেলা যাবে। আগে দেখা যেত ঘটনাস্থলে পুলিশ বা ফায়ার সার্ভিস যেতে দেরি করত। এখন কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই যায়।’

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘আপনারা মুখপাত্রের কথা বলেছেন। অনেক সময় অতি উৎসাহী হয়ে অনেকে অনেক কিছু বলেন। আমরা পুলিশকে বলেছি, একজনকে কথা বলার জন্য। আমরা আপনাদের সহযোগিতা চাই, আপনারা দিকনির্দেশনা দেবেন। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা চলছে। আমরা অবশ্যই পারব। তবে আমাদের হাতে যে জাদুর কাঠি নেই। একটু সময় তো লাগবেই।