Thank you for trying Sticky AMP!!

দুই ভাগনির জন্য ৫ কেজি চকলেট কিনেছিলেন মেহেদী

মেহেদী হাসান

সংসারের হাল ধরতে সুদে নেওয়া ঋণের টাকায় লেবাননে পাড়ি জমান মেহেদী হাসান। তাঁর গ্রামের বাড়িজুড়ে এখন শুধুই মাতম। ছেলের শোকে তিন দিন ধরে পানি ছাড়া কিছুই খাচ্ছেন না মা ইনারা বেগম। প্রায়ই তিনি মূর্ছা যাচ্ছেন ও অচেতন হয়ে পড়ছেন। তাঁকে চিকিৎসক দেখাতে হাসপাতালে নেওয়া দরকার। কিন্তু অভাবগ্রস্ত পরিবারের সেই টাকাও নেই। একমাত্র উপর্জনকারী মেহেদীর মৃত্যুতে তাঁর পরিবার এখন অথই দরিয়ায়।

লেবাননের বৈরুত বন্দরে গত মঙ্গলবার বাংলাদেশ সময় রাত ১০টার দিকে শক্তিশালী বিস্ফোরণে নিহত তিন বাংলাদেশির মধ্যে একজন মেহেদী হাসান। তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলার মাছিহাতা ইউনিয়নের ভাদেশ্বরা গ্রামের তাজুল ইসলাম ভূঁইয়ার বড় ছেলে। তিন ভাই ও এক বোনের মধ্যে মেহেদী ছিলেন সবার বড়। ছোট বোন জিয়াসমিন আক্তার হ্যাপির (২২) চার বছর আগে সদর উপজেলার জাঙ্গাল গ্রামের দুবাইপ্রবাসী মাহবুব আলমের সঙ্গে বিয়ে হয়। ছোট ভাই সামিরুল ইসলাম (১৩) স্থানীয় গাউছুল আজম আবুল উলুইয়া সুন্নিয়া দাখিল মাদ্রাসায় ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র এবং আরেক ছোট ভাই সাইমন ইসলাম (৫) স্থানীয় একটি কিন্ডারগার্টেন স্কুলে নার্সারিতে পড়ে। মেহেদীর লেবাননে যাওয়ার ছয় বছর আগে তাঁর বাবা তাজুল ইসলাম বাহরাইনে যান। সেখানে তিনি নির্মাণকাজ কাজ করতেন। একপর্যায়ে অসুস্থতার জন্য দেশে চলে আসেন তাজুল। এখন তিনি তেমন কোনো কাজ করতে পারেন না।

বৃহস্পতিবার বিকেলে মাছিহাতা ইউনিয়নের ভাদেশ্বরা গ্রামে সরেজমিনে দেখা যায়, গ্রামের লোকজন এসে মেহেদীর পরিবারের সদস্যদের সান্ত্বনা দিচ্ছেন। ঘরের ভেতরে ও উঠানে স্বজন এবং প্রতিবেশীরা বসে আছেন। এরই মধ্যে মেহেদীর মা ইনারা অচেতন হয়ে পড়লে স্বজনেরা তাঁকে বারান্দায় নিয়ে মাথায় পানি ঢালা শুরু করেন। এরপর মেহেদীর একমাত্র বোন জিয়াসমিন বারান্দার সিঁড়িতে বসে কান্না শুরু করেন। যে স্বজনই আসছেন, তাঁকে জড়িয়ে ধরে আহাজারি করে যাচ্ছেন তিনি। বোনের কান্না কোনোভাবেই থামানো যাচ্ছে না।

পরিবার জানায়, দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেন মেহেদী। ২০১৪ সালে ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় সংসারের হাল ধরতে সুদের ওপর পাঁচ লাখ টাকা ঋণ নিয়ে লেবাননে পাড়ি জমান তিনি। এরই মধ্যে দীর্ঘ ছয় বছরের সুদের ওপর ঋণের পাঁচ লাখ টাকার মধ্যে তিন লাখ টাকা পরিশোধ করা হয়েছে। ঋণের আরও দুই লাখ টাকা পরিশোধের এখনো বাকি আছে। প্রতি এক লাখ টাকার জন্য ছয় মাস পরপর সুদ হিসেবে সাড়ে ১৩ মণ চাল দিতে হয়। ঋণের বাকি দুই লাখ টাকা ও এর সুদ পরিশোধের কোনো সামর্থ্য আর থাকল না। গত মার্চ মাসে ছুটিতে দেশের আসার কথা ছিল মেহেদীর। এ জন্য দুই ভাগনির জন্য পাঁচ কেজি চকলেটও কিনেছিলেন তিনি। পরে করোনা পরিস্থিতির কারণে আর দেশে আসা সম্ভব হয়নি।

মেহেদীর চাচাতো ভাই সাইফুল ইসলাম, সারওয়ার হোসেন ও প্রতিবেশী সাজিম ভূঁইয়া প্রথম আলোকে জানান, কোনোভাবেই তাঁরা মেহেদীর মৃত্যু মেনে নিতে পারছেন না। শান্ত, নম্র, ভদ্র ও বিনয়ী স্বভাবের ছিলেন মেহেদী। গ্রামে কোনো দিন কারও সঙ্গে তাঁর ঝগড়া হয়নি। বিশ্বাসই হচ্ছে না তিনি আর নেই।

নিহত মেহেদীর ছোট বোন জিয়াসমিন আক্তার বলেন, ‘আমার দুই বছরের মেয়ে মাহিয়া আক্তার ও দুই মাসের মেয়ে মিম আক্তারের নাম রেখেছিল মেহেদী ভাই। কাজে যাওয়ার আগে প্রতিদিন বেলা ১১টা থেকে দুপুর ১২টার মধ্যে ভাই আমাকে ফোন করত। আজ দুদিন পার হলো ভাইয়ের কোনো ফোন আসেনি।’ কান্নায় ভেঙে পড়ে তিনি আরও বলেন, ‘আমার দুই মেয়ের জন্য পাঁচ কেজি চকলেট, পুতুল, শ্যাম্পু, সাবান—কত কিছু কিনে রেখেছিল ভাই। কিন্তু দুই মেয়ে ও আমার স্বামীকে না দেখেই চলে গেল সে।’

মেহেদীর বাবা তাজুল ইসলাম বলেন, তাঁর শরীরের ডান পাশে ব্যথা। প্রায় সময়ই অবশ লাগে। এ জন্য বাহরাইন থেকে দেশে ফিরে এসেছেন তিনি। পুরো সংসারের খরচ ছেলেই চালাতেন। তিনি বলেন, ‘দেড় বছর আগে সাড়ে ১৩ শতক জায়গা সাড়ে তিন লাখ টাকা বিক্রি করে ঋণ পরিশোধ করা হয়েছে। আরও দুই লাখ টাকা ঋণ আছে। তাঁর সঙ্গে সুদ, সংসারের খরচ। কীভাবে এসব পরিশোধ করব জানি না। সংসারের হাল ধরার আর কেউ রইল না।’

আরও পড়ুন
১২ বছর আগে ছেলেকে দেখাই হলো শেষ দেখা