Thank you for trying Sticky AMP!!

দুর্যোগে গভীর ভরসা

দক্ষিণাঞ্চলে ঘূর্ণিঝড়ের সময় আশ্রয়কেন্দ্রগুলো বহু মানুষের সহায়। ছবি: প্রথম আলো

একবার এক অর্থমন্ত্রী তাঁর আঞ্চলিক স্বতঃস্ফূর্ত ভাষায় বলেছিলেন, মঙ্গা আবার কী? জীবনে কখনো এসব শব্দ শুনিনি। তাঁর অঞ্চলে মঙ্গার প্রতিশব্দ নিদান। দুটি আলাদা শব্দ হলেও একই পরিস্থিতি নির্দেশ করে। সে সময় এ রকম বাতচিৎ নিয়ে অনেক মশকরা হয়েছে। রাজনৈতিক টীকা-টিপ্পনী, তীর্যক কথন সম্পাদকীয়—সবই হয়েছিল ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায়। তখন কে জানত আসলেই একদিন আসবে, যেদিন এ দেশের মানুষ মঙ্গাকে প্রায় জাদুঘর আর অতীত গবেষণার বিষয়ে পরিণত করবে?

বন্যা, খরা, নদীভাঙন—এসবের আছড় না থাকলেও বৃহত্তর রংপুর আর তার আশপাশের জেলাগুলোয় এই কিছুদিন আগেও মঙ্গার আগমনের কোনো উপলক্ষ লাগত না। মধ্য সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর না আসা পর্যন্ত ‘জামাল মিয়ারা লাল নীল রঙের কুড়িটি গাই’ (জামালপুর, লালমনিরহাট, নীলফামারী, রংপুর, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা) নিয়ে খুবই দুশ্চিন্তার মধ্যে থাকতেন। চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষের সবচেয়ে নিষ্ঠুর সময় ছিল সেপ্টেম্বর-অক্টোবর-নভেম্বর। ২০০৯ সালে একটি আন্তর্জাতিক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের করা এক মাঠ জরিপে দেখা যায়, শুধু গাইবান্ধা, নীলফামারী, কুড়িগ্রাম আর লালমনিরহাটের প্রায় ৫ লাখ ৩৭ হাজার ৪০০ পরিবার বছরের একটা বড় সময় চরম খাদ্য সংকট বা মঙ্গার মধ্যে দিন গুজরান করত।

এই জরিপের আওতায় জামালপুর আর রংপুর জেলাকে নেওয়া হয়নি। এই জরিপ এবং আগের বিভিন্ন গবেষণা ও পরিস্থিতি পর্যালোচনামূলক প্রতিবেদন অনুযায়ী মঙ্গার সময় জামালপুর আর বৃহত্তম রংপুর জেলাগুলোর প্রায় ৭৭ শতাংশ পরিবারই অর্ধপেটে অথবা অনাহারে থাকত। ২০১৩ সালে এসে দেখা যায় মঙ্গার মাসগুলোতে ৭৪ শতাংশ পরিবারই কমবেশি তিন বেলা খেতে পাচ্ছে। গড় আয় বেড়েছে প্রায় ১২০ শতাংশ।

সরকার পরিচালিত নানা সামাজিক নিরাপত্তামূলক কার্যক্রমের একটা ইতিবাচক প্রভাব মঙ্গাপীড়িত এলাকায় অস্বীকার করা যায় না। তবে মঙ্গা জয়ের ক্ষেত্রে প্রযুক্তিগত উন্নয়নেরও বেশ জোরালো ভূমিকা আছে। মরা কার্তিকে এখন ধানখেতে পাকা ধানের সুবাস ছড়ায়। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট ও আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট বর্ষালি বা ব্রি৫৬, ৫৭ নামে নতুন জাতের ধান খুবই সফলভাবে উদ্ভাবন ও সম্প্রসারণের কাজ সম্পন্ন করেছে। এসব ধান কমবেশি ১০০ দিনের মধ্যে কাটার উপযুক্ত হয়ে যায়। পরবর্তী সময়ে ব্রি৬২ এবং অতিসম্প্রতি ব্রি৭২ আশ্বিনের শেষেই কাটা হচ্ছে। জমি একটু উঁচু হলে বোরো আবাদের আগে কৃষক আরেকটি ফসল করছেন। ফলে মঙ্গার মাসগুলোতেও এখন ফসল আর কাজের সুযোগ থাকছে।

মঙ্গাকে ছুটি দেওয়ার ক্ষেত্রে লক্ষ্যনির্ভর ক্ষুদ্রঋণেরও একটা বড় ভূমিকা আছে। পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন এ ক্ষেত্রে মোট সাফল্যের অন্তত ১৩ শতাংশের দাবিদার হতে পারে। ২০০৮ থেকে ২০১৩ সাল—এই ছয় বছরে বহত্তর রংপুর জেলার ৫ হাজার ৬০০ পরিবারের ওপর ধারাবাহিক নিবিড় পর্যবেক্ষণ করে সেখানে মানুষের আয় বৃদ্ধিতে নানা ধরনের পদক্ষেপ নেয় এই সংস্থা। অবশ্য সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মসূচি ও বেসরকারি উন্নয়ন সংগঠনগুলোর অবদানও অস্বীকার করা যাবে না।

মঙ্গা আমাদের সবচেয়ে পুরোনো নিয়মিত দুর্যোগগুলোর একটি। এটি প্রতিরোধে সাফল্যের পাশাপাশি দেশে সার্বিক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনাতেই পরিবর্তনের হাওয়া দেখতে পাই আমরা। এ ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চাপ, তাদের ধৈর্যের সঙ্গে লেগে থাকার চর্চার পাশাপাশি রাষ্ট্রের সদিচ্ছারও একটা ভূমিকা আছে। রাষ্ট্রের দীর্ঘমেয়াদি দর্শন বা ভিশন ২০২১-এ দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে লক্ষ্য হচ্ছে, প্রাকৃতিক পরিবেশগত বা মানবসৃষ্ট দুর্যোগের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে দেশের জনগণ, বিশেষ করে দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর দুর্ভোগের মাত্রা মানবিক সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনা এবং যেকোনো বড় দুর্যোগ মোকাবিলা করতে সক্ষম ও দক্ষ জরুরি সাড়াদানব্যবস্থা গড়ে তোলা।

এই দর্শনের বাস্তব রূপ দেওয়ার জন্য দুটি লক্ষ্যভিত্তিক মিশন ঠিক করা হয়েছে। প্রথমত, ত্রাণনির্ভর কর্মসূচি থেকে বেরিয়ে এসে ঝুঁকি হ্রাসমূলক কর্মকাণ্ডের প্রতি নজর দেওয়া এবং দ্বিতীয়ত, দরিদ্র ও ঝুঁকিতে থাকা জনগোষ্ঠীর ঝুঁকির মাত্রা কমানোর জন্য তাদের সক্ষমতা বৃদ্ধি ও খাদ্য নিরাপত্তা বিধান। এসব লক্ষ্য অর্জনের জন্য দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা আইন ২০১২-এর মাধ্যমে সাবেক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ব্যুরো এবং ত্রাণ ও দুর্যোগ পুনর্বাসন অধিদপ্তরকে একীভূত করে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠা করা হয়। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার জনশক্তিতে এখন পানিসম্পদ, পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন এবং আইসিটি বিশেষজ্ঞ অন্তভু‌র্ক্ত করা হয়েছে।

প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো বদলে ফেলার পাশাপাশি আইনগত ও তাত্ত্বিক কাঠামো গড়ে তোলারও প্রক্রিয়া চলছে। সম্পূর্ণ ত্রুটিমুক্ত না হলেও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা আইন, ২০১২; দুর্যোগবিষয়ক স্থায়ী আদেশাবলি (১৯৯৭ সংশোধিত-২০১০); পাঁচ বছর মেয়াদি জাতীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা; বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন কৌশল ও কর্মপরিকল্পনা-২০০৯; ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ; রক্ষণাবেক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা নীতিমালা-২০১১; খসড়া দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা নীতিমালা-২০১৫ তৈরি হয়েছে। এ ছাড়া মাঠপর্যায়ে ঝুঁকি নিরূপণ এবং এর ওপর ভিত্তি করে কর্মপরিকল্পনা তৈরির একটা নির্দিষ্ট গাইডলাইন ব্যবহৃত হচ্ছে।

বাংলাদেশের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে বিস্ময়কর অর্জন ছিল উপকূলীয় এলাকায় গড়ে তোলা সমাজভিত্তিক ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচি সিপিপি। মূলত স্বেচ্ছাসেবকদের নিয়ে গড়ে তোলা এই কর্মসূচি ঘূর্ণিঝড়ে মানুষের জানমাল বাঁচানোর ক্ষেত্রে সবচেয়ে সফল প্রচেষ্টা হিসেবে তামাম দুনিয়ার দৃষ্টি কাড়ে। ১৯৭৩ সালে তৎকালীন রেডক্রস আর বাংলাদেশ সরকার যৌথভাবে এই কর্মসূচি গড়ে তোলে। তার আগে ১৯৭০ সালের ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় গোর্কির পর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অনুরোধে লিগ অব রেডক্রস অ্যান্ড রেড ক্রিসেন্টের (এখন আইএফআরসি) ডেলিগেট ক্লাস হেগস্ট্রম বিধ্বস্ত দক্ষিণাঞ্চল ঘুরে দেখে ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচির রূপরেখা পেশ করেছিলেন। ফেব্রুয়ারি ১৯৭২ সালে পেশ করা এই রূপরেখা তৎকালীন সরকারপ্রধানের অনুমোদন পায় ১৯৭৩ সালের ১ জুলাই। বর্তমানে ১৩টি উপকূলীয় জেলার ৪০টি উপজেলায় প্রায় ৫৫ হাজার স্বেচ্ছাসেবক (১৮ হাজার ৪২০ জন নারী স্বেচ্ছাসেবক) ঘূর্ণিঝড়ের খবর পৌঁছানো থেকে শুরু করে নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়ে যাওয়া এবং দুর্যোগ-পরবর্তী উদ্ধারে ও ত্রাণ বণ্টনে আদর্শ ভূমিকা পালন করে আসছে। এখন পৃথিবীর নানা দেশ বাংলাদেশের সিপিপির আদলে সমাজভিত্তিক সাইক্লোন প্রস্তুতির কাজে হাত দিয়েছে।

মাঠপর্যায়ে সংগঠিত স্বেচ্ছাসেবক জনশক্তির পাশাপাশি আগাম সতর্কীকরণ ও পূর্বাভাসের ক্ষেত্রে প্রযুক্তিগত উন্নয়নের কারণে এখন সাইক্লোনের অনেক আগে ক্ষেত্রবিশেষে প্রায় ৫৬ ঘণ্টা আগে সম্ভাব্য দুর্যোগের এলাকা সম্পর্কে কম-বেশি নিশ্চিত করে বলা সম্ভব হচ্ছে। একইভাবে বন্যা পূর্বাভাসের খবরাখবর পৌঁছানোর গতি বেড়েছে। চমকপ্রদ উন্নতি ঘটেছে নদীভাঙনের পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণের ক্ষেত্রেও। পানি উন্নয়ন বোর্ডের সহযোগী ট্রাস্ট সংস্থা সিইজিআইএস (সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড জিওগ্রাফিক্যাল ফরমেশন সার্ভিসেস) এই কাজটি করছে প্রায় ১০ বছর ধরে। এদের পূর্বাভাস ৯০ ভাগ ক্ষেত্রে যথাযথ প্রমাণিত হয়েছে। মানুষ ছয়-সাত মাস আগে যদি জানতে পারে তার চাষের জমি, খেত, বাড়ি, মাঠ, ফসল হারিয়ে যাবে নদীগর্ভে, তাহলে সহজেই সে তা সরিয়ে নেওয়ার মতো সম্পদের একটা সুরাহা করতে পারে। আগে থেকে ঠিক করতে পারে ঘর-জমি চলে গেলে সে কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে। সিইজিআইএস তথ্য বিশ্লেষণ করে বলে দিতে পারে ঝুঁকি কোন অঞ্চলে বেশি, কোথায় মাঝারি আর কোথায় কম। তবে মানুষের কাছে পৌঁছানোর অবকাঠামো তাদের নেই। এখানে একটা সমন্বয়ের প্রয়োজন। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় উন্নত প্রযুক্তির মাধ্যমে দুর্যোগের আগাম তথ্য আদান-প্রদানের ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে—ইন্টারঅ্যাকটিভ ভয়েস রেসপন্স (আইভিআর) প্রযুক্তিতে সেলফোনের মাধ্যমে যে কেউ ১০৯৪১ নম্বরে ফোন করে আবহাওয়ার সর্বশেষ তথ্য জানতে পারেন। এ রকম আরও নতুন নতুন প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে দুর্যোগ-সম্পর্কিত তথ্যের আদান-প্রদানকে দ্রুত ও সহজ করে তোলার কাজ চলছে। যেমন সম্ভাব্য জলমগ্নতার মানচিত্র (ইনানডেশন ম্যাপ), ভূমিকম্পের ঝুঁকি মানচিত্র ইত্যাদি।

বাংলাদেশের মানুষ দুর্যোগের সঙ্গে বসবাস করেই বেঁচে আছে। জলে ভাসতে ভাসতে সে জলের মধ্যেই চাষাবাদের কথা ভাবতে পারে। ভাসমান সবজিখেত, নার্সারি এখন বিশ্ব ঐতিহ্য। দুর্যোগের সঙ্গে বাজি রেখে এগিয়ে যাওয়ার মানসিকতাকে আমরা যে নামেই ডাকি না কেন, মানুষের এই কৌশলকে আমাদের স্বীকার করতেই হবে।

গ্রামবাংলায় বর্গীদের আসার অনেক আগেই ধর্মগোলার চল ছিল। সেখানে কৃষকেরা উদ্বৃত্ত ধানের একটা অংশ জমা রাখতেন দুর্দিনের জন্য। সামাজিক সেই ব্যবস্থা নতুন রূপে আবার ফিরে আসছে সামাজিক মূলধন হিসেবে। নওগাঁর মহাদেবপুরের নারীদের উদ্যোগে সোনাদীঘি গ্রামে গড়ে উঠেছে ‘খাদ্য ব্যাংক’। মহাজনদের এখন ছুটি দিয়েছে এই ব্যাংক। খুলনার বটিয়াঘাটার কিষানিরা সিডর ও আইলাবিধ্বস্ত লবণাক্ত আঙিনায় সবজি আর লবণসহিষ্ণু জাতের ধান চাষ করে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন। দক্ষিণাঞ্চলের দুঃখ চিংড়িঘের ঘিরে মানুষ এখন সবজি চাষ করছে।

লালমনিরহাটের ধরলা নদীতে সদর উপজেলার মোগলহাট ইউনিয়নের ঝুমকা গ্রামের নারী-পুরুষ মিলে বান ঠেকানোর বাঁধ বেঁধেছে কোনো সরকারি সাহায্য ছাড়াই। প্রান্তিক মানুষের এসব প্রয়াসের খবর আমরা খুব একটা রাখি না। আমাদের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার এটাই এখন বড় চ্যালেঞ্জ। দুর্যোগ মোকাবিলায় ঐতিহ্যগত জ্ঞানের মর্ম আমরা বুঝতে চাই না। কারও মনে প্রশ্ন জাগে না সিডরের ভয়ংকর থাবা থেকে একশ্রেণির জলদাস বেঁচে গেল কীভাবে? কেন তাদের নৌকা ডুবল না?

মানুষ আর সমাজকে বাদ দিয়ে নোট প্যাড চেয়ার ফাইল দিয়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার সফল পরিকল্পনা প্রণয়ন বা বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। সবই হনুজ দুরস্ত থেকে যায়, মানুষ যদি গোড়াতে না থাকে।

গওহার নঈম ওয়ারা: দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা িবশ্লেষক