Thank you for trying Sticky AMP!!

নজরুল স্মৃতিকেন্দ্রে 'স্মৃতি' নেই

কাজী নজরুল ইসলামের ব্যবহৃত সেই খাট। কাজির শিমলার দারোগা বাড়িতে নজরুল স্মৃতিকেন্দ্রে এটি সংরক্ষিত আছে। ছবি: অর্ণব সান্যাল

ভবনে ঢোকার পর ডান পাশেই দেখা গেল একটি খাট। তার গায়ে ধুলার পুরু স্তর। এতই ধুলো পড়েছে যে কাঠের তৈরি খাটের আসল রংই আর চেনা যাচ্ছে না। খাটের পায়াগুলো আবার ক্ষয়ে গেছে। খাটের একপাশে টাঙানো ফ্রেমে লেখা—এটি ব্যবহার করতেন জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম।


ময়মনসিংহের ত্রিশালের কাজির শিমলায় আছে নজরুল স্মৃতিকেন্দ্র। ২০০৮ সালে নজরুল ইনস্টিটিউট এটি স্থাপন করে। সেখানে এভাবেই রাখা আছে জাতীয় কবির ব্যবহৃত এই স্মৃতিচিহ্ন। কবির স্মৃতিবিজড়িত ত্রিশালে আছে মোট দুটি স্মৃতিকেন্দ্র। কিন্তু এগুলোতে কবির স্মৃতির দেখা পাওয়াই দুষ্কর। সম্বল বলতে ওই একটি খাট আর কিছু ছবি।

ঢাকা থেকে ময়মনসিংহ যাওয়ার পথে পড়ে ত্রিশাল। ময়মনসিংহের কাছাকাছি পৌঁছালে বাঁ পাশে দেখা যায় একটি সাইনবোর্ড। তাতে লেখা ‘নজরুল জাদুঘর’। সেই ভাঙাচোরা রাস্তা ধরে আরও এক কিলোমিটার ভেতরে গেলে দেখা মেলে সেই ‘জাদুঘরের’। তবে অকুস্থলের সাইনবোর্ডে জাদুঘরের বদলে লেখা স্মৃতিকেন্দ্র।

গেট দিয়ে ঢোকার পর ঘাসে ঢাকা রাস্তা পেরিয়ে ঢুকতে হয় স্মৃতিকেন্দ্রের দোতলা ভবনে। এর সামনে ও ভেতরে কোনো দর্শনার্থী চোখে পড়ল না। ঢোকার পরই চোখে পড়ে জাতীয় কবির ব্যবহৃত সেই খাট। কাঠের রং এখন প্রায় সাদাটে হয়ে গেছে।

১৯১৪ সালে ত্রিশালে এসেছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। ছিলেন প্রায় এক বছর। তাঁকে এখানে নিয়ে এসেছিলেন কাজী রফিজউল্লাহ। এই ব্যক্তি ছিলেন পেশায় দারোগা। প্রথম আলোর ঈদসংখ্যা-২০১৭তে ‘কবির উন্মেষ’ নামের রচনায় গোলাম মুরশিদ লিখেছেন, ভারতের আসানসোলের রানিগঞ্জে কিশোর নজরুলের দেখা পান রফিজউল্লাহ। তাঁর বাড়িতে গৃহভৃত্যের কাজ করতেন নজরুল।

ত্রিশালের বিচুতিয়া ব্যাপারী বাড়িতে অবস্থিত নজরুল স্মৃতিকেন্দ্র। ছবি: অর্ণব সান্যাল

পরে রানিগঞ্জ থেকে অন্য জায়গায় বদলি হন রফিজউল্লাহ। তাঁর বাড়ি ছিল ত্রিশালের কাজির শিমলায়। নজরুলকে সেখানকার দরিরামপুর হাই স্কুলে ভর্তি করে দেন তিনি। নজরুল সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছিলেন।

এবার আসি বর্তমানে। কথা হয় এই কাজির শিমলার নজরুল স্মৃতিকেন্দ্রের অফিস সহায়ক কাজী আজিজুল হকের সঙ্গে। তিনি আবার সেই রফিজউল্লাহর বংশধর। তিনি জানান, স্মৃতিকেন্দ্রে থাকা নজরুলের ব্যবহৃত খাটের গল্প।

কাজী আজিজুল হক বলেন, স্থানীয় এক জমিদারের কাছ থেকে কয়েকটি খাট কিনেছিলেন রফিজউল্লাহ। সেগুলোর একটি রাখা হয়েছিল তাঁর বৈঠকখানায়। সেখানেই থাকতেন নজরুল। আর সেই খাটটিই স্মৃতিকেন্দ্রে এনে রাখা হয়েছে।

তবে এখানে খাটটি ছাড়া আর বিশেষ কিছু চোখে পড়ল না। স্মৃতিকেন্দ্রের দোতলায় একটি পাঠাগার আছে। সেখানে আছে প্রায় পাঁচ হাজার বই। কিন্তু চেয়ারগুলো সবই খালি। নজরুল ইনস্টিটিউটের প্রশিক্ষণ সহকারী ও স্মৃতিকেন্দ্রের বই বিক্রির দায়িত্বে থাকা মো. ফয়জুল্লাহ রোমেল বলেন, পাঠাগারে বই পড়তে খুব বেশি কেউ আসে না। স্মৃতিকেন্দ্রে দর্শনার্থীও আসে কদাচিৎ। মাসে ২০-৩০ জনের বেশি হয় না।

মো. ফয়জুল্লাহ আরেকটি নজরুল স্মৃতিকেন্দ্রের খোঁজ দিলেন। ত্রিশালে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে সেটি অবস্থিত। তিনি বলেন, সেখানে গেলে নজরুলের স্মৃতিবাহী আরও কিছুর দেখা পাওয়া যেতে পারে। সেখানে বিচুতিয়া ব্যাপারী নামের এক ব্যক্তির বাসায় জায়গির থাকতেন নজরুল।

‘কবির উন্মেষ’ রচনায় গোলাম মুরশিদ লিখেছেন, রফিজউল্লাহর গ্রাম কাজির শিমলা থেকে দরিরামপুর স্কুলের দূরত্ব ছিল বেশ। রোজ সেই স্কুলে আসা-যাওয়া করা নজরুলের জন্য কঠিন ছিল। তাই স্কুলের কাছাকাছি একাধিক বাড়িতে জায়গির থাকতে হয়েছিল তাঁকে। স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করেছিলেন নজরুল। ১৯১৪ সালের শেষে ত্রিশাল ছেড়ে বর্ধমান চলে যান কবি।

বিচুতিয়া ব্যাপারী বাড়িতে নজরুল স্মৃতিকেন্দ্রের সংগ্রহ। ছবি: অর্ণব সান্যাল

আরেক স্মৃতিকেন্দ্রের উদ্দেশে যাত্রা

কাজির শিমলার স্মৃতিকেন্দ্র থেকে রওনা দিই বিচুতিয়া ব্যাপারী বাড়ির দিকে। ত্রিশাল বাসস্ট্যান্ড মোড় থেকে রিকশায় করেই যাওয়া যায় বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত। সেখান থেকে কিছুটা হাঁটার পর, ডান পাশের একটি গলিতে পাওয়া গেল বিচুতিয়া ব্যাপারী বাড়ি। সেখানেই আছে আরেকটি নজরুল স্মৃতিকেন্দ্র।

এই স্মৃতিকেন্দ্রটিও ২০০৮ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয়। দুই স্মৃতিকেন্দ্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. আক্তারুজ্জামান বলেন, এটিই মূল অফিস। এখান থেকেই দুই স্মৃতিকেন্দ্রের কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়।

এই কেন্দ্রের দোতলার একটি অংশে আছে পাঠাগার। আর আরেকটি অংশে আছে নজরুলের কিছু ছবি ও হাতে লেখা গান। সেগুলো ফ্রেমে বেঁধে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে বেশ উঁচুতে, দেখতেও কষ্ট হয়। হঠাৎ করে একটি পুরোনো গ্রামোফোন মেশিন দেখে ভাবলাম, এটি বোধ হয় জাতীয় কবির স্মৃতিধন্য। কিন্তু না। কর্তৃপক্ষ মারফত জানা গেল, এটি একটি ডামি, এমনিই সাজিয়ে রাখা হয়েছে।

সাজিয়ে রাখা কবির জীবনের বিভিন্ন সময়ের ছবি ও হাতে লেখা গানগুলোও অন্য উৎস থেকে প্রিন্ট করে পাওয়া। আসল নয়।

বেচুতিয়া ব্যাপারী বাড়ির এই নজরুল স্মৃতিকেন্দ্রে জাতীয় কবির স্মৃতিধন্য কোনো কিছুরই সরাসরি দেখা মিলল না। দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. আক্তারুজ্জামানকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, দর্শনার্থীদের প্রতিক্রিয়া কেমন? তাঁরা কি এখানে এসে সন্তুষ্ট হন?

জবাব দেওয়ার আগে একটু হাসলেন তিনি। বললেন, সারা দেশ থেকেই মানুষ ঘুরতে আসে এখানে। অনেকে শিক্ষাসফরে আসে। তবে কাছেই একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থাকায় সেখানকার শিক্ষার্থী বেশি আসেন। তিনি দাবি করেন, দর্শনার্থীরা এখানে এসে খুশিই হন।

স্মৃতিকেন্দ্র থেকে বের হয়ে দেখতে পেলাম একটি টিনের ঘর। নজরুলের ব্যবহৃত ঘরটি এখানেই ছিল। সেই ভিতের ওপরই উঠেছে নতুন ঘর। দর্শনার্থীরা এটিও দেখতে আসেন। এটি নজরুলের আসল ঘর নয়, কিন্তু নজরুল এখানে ছিলেন—সেই অনুভূতিই বোধ হয় সবাইকে আকর্ষণ করে।

কাজী নজরুল ইসলাম যে বাড়িতে থাকতেন, সেটি ছিল এখানেই। এখন একই ভিতের ওপর উঠেছে নতুন ঘর। ছবি: অর্ণব সান্যাল

নজরুল স্মৃতিকেন্দ্রের কর্মচারী আবদুস সাত্তার বলেন, ‘আসলে কেউ তো বুঝে নাই যে নজরুল এত বড় মানুষ হইয়া যাবেন। তাই কিছু সংরক্ষণও করা হয় নাই। পরিকল্পনাও তেমন ছিল না।’

তবে মো. আক্তারুজ্জামান বললেন, নজরুল ইনস্টিটিউটে নতুন প্রকল্প নেওয়ার কাজ চলছে। এর আওতায় এই স্মৃতিকেন্দ্রে একটি নতুন নজরুল কর্নার তৈরির কথা আছে। এই স্মৃতিকেন্দ্রগুলোরও সংস্কার করা হবে। এ ছাড়া নতুন প্রকল্পের আওতায় ঢাকায় থাকা জাতীয় কবির জাদুঘর থেকে কিছু দর্শনীয় জিনিস এখানে নিয়ে আসার পরিকল্পনা আছে।