Thank you for trying Sticky AMP!!

নানামুখী ঘাটতিতে ভুগছে মাধ্যমিক শিক্ষা

শিক্ষার্থীদের তুলনায় শিক্ষক কম। প্রাথমিক চিকিৎসায় ঘাটতি। সৃজনশীলের প্রশিক্ষণ দুর্বল। কম্পিউটার থাকলেও ব্যবহারে পিছিয়ে।

সুনামগঞ্জ শহরে অবস্থিত সরকারি এস সি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়টি মাধ্যমিক স্কুল হিসেবে যাত্রা শুরু করে ১৯৪০ সালে। বিদ্যালয়টিতে এখন মোট শিক্ষার্থী প্রায় ১ হাজার ২০০। বিদ্যালয়টির লেখাপড়া হয় দুই পালায় (শিফট)। কিন্তু শিক্ষকের ৫২টি পদের মধ্যে আছেন ৩০ জন। ফলে শিক্ষার্থীদের পাঠদান করাতে গিয়ে অনেক চাপে থাকতে হয় শিক্ষকদের।

ঢাকার সেগুনবাগিচা হাইস্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ৫৮ বছর আগে। এখন প্রায় ৮০০ শিক্ষার্থী পড়ে। গড়ে প্রতি ৬০ শিক্ষার্থীর জন্য একটি বাথরুম আছে। অথচ থাকার কথা গড়ে ৪০ জনের জন্য একটি বাথরুম।

শুধু এই দুটি বিদ্যালয়েই নয়, সরকারের একটি প্রতিবেদন বলছে, শ্রেণিকক্ষ, বিজ্ঞানাগার, প্রাথমিক চিকিৎসা, স্যানিটেশন ব্যবস্থাসহ নানা ক্ষেত্রে ঘাটতি রয়েছে দেশের মাধ্যমিক স্তরের (সরকারি-বেসরকারি) শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। শিক্ষার মান উন্নয়নের নানা দিকেও ঘাটতি রয়েছে। শিক্ষার্থীদের তুলনায় পর্যাপ্ত শিক্ষক নেই। সৃজনশীল পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীদের মুখস্থ করার পরিবর্তে আত্মস্থ করার প্রবণতা বাড়লেও এ বিষয়ে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ খুব একটা কাজে আসছে না।

বিভিন্ন দাতা সংস্থার সহায়তায় দেশের মাধ্যমিক শিক্ষার উন্নয়নে বর্তমানে ‘সেকেন্ডারি এডুকেশন সেক্টর ইনভেস্টমেন্ট প্রোগ্রাম (সেসিপ)’ নামের একটি কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে সরকার। দেশের সব মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এই কর্মসূচির আওতাভুক্ত। এই কর্মসূচির সবল ও দুর্বলতা পর্যালোচনা করেছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি)। গত জুন মাসে প্রকাশিত এই প্রতিবেদনে দেশের মাধ্যমিক শিক্ষার মোট ১৮টি দুর্বলতার দিক তুলে ধরা হয়েছে। বিপরীতে ১৩টি সবল দিকের কথাও বলা হয়েছে। প্রতিবেদনে ১৪ ধরনের সুপারিশ করা হয়েছে।

কর্মসূচিটি বাস্তবায়ন করছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি)। প্রকল্পটির মোট ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ৩ হাজার ৮২৬ কোটি টাকা। ২০১৪ সালের জানুয়ারি থেকে কর্মসূচিটি শুরু হয়েছে। গত ডিসেম্বরে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও করোনার কারণে প্রকল্পের মেয়াদ এক বছর বেড়েছে।

দেশের আট বিভাগের আটটি জেলা থেকে দুটি করে উপজেলা নিয়ে মোট ১৬টি উপজেলার ৩২টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সমীক্ষা করেছে আইএমইডি। সমীক্ষায় ৬৪০ জন শিক্ষার্থীকে নমুনা হিসেবে নেওয়া হয়। এ ছাড়া শিক্ষক, অভিভাবক, ব্যবস্থাপনা কমিটি এবং কর্মকর্তাদের মতামত নেওয়া হয়েছে।

আইএমইডি বলছে, কর্মসূচিটির সক্ষমতা ও দুর্বলতা খুঁজে বের করে সম্ভাব্য ঘাটতি ও চ্যালেঞ্জগুলো বিশ্লেষণ করা হয়েছে এই প্রতিবেদনে। এর মাধ্যমে পরবর্তী পদক্ষেপ নেবে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। প্রতিবেদনে আশঙ্কা প্রকাশ করে বলা হয়, বিদ্যমান গাইড বই এবং টিউশনি এই কর্মসূচির উদ্যোগ ব্যাহত করতে পারে। এ ছাড়া করোনার প্রাদুর্ভাবের কারণেও কর্মসূচির কর্মপরিকল্পনা ব্যাহত হতে পারে।

মাউশির মহাপরিচালক সৈয়দ গোলাম ফারুক মাধ্যমিক শিক্ষার সংকটের কথা অস্বীকার করেননি। সম্প্রতি তিনি বলেন, ওই কর্মসূচির বাকি মেয়াদে ঘাটতিগুলো পূরণের চেষ্টা করা হবে। সৃজনশীল পদ্ধতির বিষয়ে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণটি জোরদার হচ্ছে। শিক্ষকসংকট নিরসনেও নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে।

শিক্ষকের ঘাটতি

মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পর্যাপ্ত শিক্ষক না থাকার তথ্য উঠে এসেছে প্রতিবেদনে। সুনামগঞ্জের এস সি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হাফিজ মো. মাশহুদ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, দীর্ঘদিন ধরে প্রয়োজনের তুলনায় শিক্ষকস্বল্পতা রয়েছে। এতে শিক্ষকদের ওপর বাড়তি চাপ থাকে।

মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) সূত্রমতে, বর্তমানে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষকের ৭৬ শতাংশ পদই শূন্য। আর সহকারী শিক্ষকের পদ আছে ১০ হাজার ৯০৪ জন। এর মধ্যে ২০ শতাংশের বেশি পদ শূন্য। অবশ্যইতিমধ্যে সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি) প্রায় ২ হাজার ১৫৫ জনকে বাছাই করে নিয়োগ দিতে সুপারিশ করেছে। মাউশি জানিয়েছে, এখন নিয়োগের প্রক্রিয়া চলছে।

ঢাকার সেগুনবাগিচা হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক এ কে এম ওবাইদুল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদের বিদ্যালয়ে প্রাথমিক স্তর থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত প্রায় ৮০০ শিক্ষার্থীর জন্য মোট শিক্ষক আছেন ২৪ জন। এর মধ্যে এমপিওভুক্ত শিক্ষক ১১ জন, যাঁরা সরকার থেকে বেতন বাবদ আর্থিক অনুদান পান। বাকিদের টাকা বিদ্যালয়ের আয় থেকে দিতে হয়। বিদ্যালয়টিতে মোট ৩০ জন শিক্ষকের প্রয়োজন।

মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে জেন্ডার সমতা আনার বিষয়েও আইএমইডির প্রতিবেদনে জোর দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ শিক্ষাতথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য দিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, বর্তমানে দেশের সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ৩১ শতাংশ এবং বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ২৫ শতাংশ নারী শিক্ষক আছেন।

আইসিটি শিক্ষায় সমস্যা

এখন ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি (আইসিটি) বিষয় বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঢাকা বিভাগের প্রায় সব বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা কম্পিউটার ব্যবহার করতে পারে। কিন্তু অন্য বিভাগের প্রায় সব বিদ্যালয়ে কম্পিউটার থাকলেও ব্যবহারের ক্ষেত্রে অনেকে পিছিয়ে। চট্টগ্রাম বিভাগের বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থীরা (২৫ শতাংশ) সবচেয়ে কম কম্পিউটার ব্যবহার করতে পারে। অন্যান্য বিভাগের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে রাজশাহীর ৭৩ শতাংশ, রংপুরের ৬০ শতাংশ, সিলেটের ৫৪ শতাংশ, বরিশালের ৪৯ শতাংশ, ময়মনসিংহের ৪৬ শতাংশ এবং খুলনার ৩৯ শতাংশ শিক্ষার্থী কম্পিউটার ব্যবহার করতে পারে।

কীভাবে আইসিটি ক্লাস নেওয়া হয় তারও তথ্যে উঠে এসেছে প্রতিবেদনে। ৩৬ দশমিক ২৯ শতাংশ শিক্ষার্থী বলেছে, শুধু পাঠ্যবই পড়ানো হয়। প্রায় ২৪ শতাংশ শিক্ষার্থী বলেছে, ব্যবহারিক ও তত্ত্বীয় (থিওরি) ক্লাস একসঙ্গে হয়। ৩৬ শতাংশ শিক্ষার্থী জানিয়েছে, ব্যবহারিক ও তত্ত্বীয় ক্লাস আলাদাভাবে হয়।

সৃজনশীল পদ্ধতি ভালো, প্রশিক্ষণে গলদ

বর্তমানে সাধারণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতেও সৃজনশীল পরীক্ষা পদ্ধতি চালু হয়েছে। সৃজনশীল পদ্ধতি হচ্ছে একটি বিষয় মুখস্থ না করে পুরোপুরি আত্মস্থ করা, নিজের মতো করে বিষয়টাকে ধারণ করে প্রয়োগ করা। সমীক্ষায় অংশ নেওয়া শিক্ষকেরা মনে করেন, সৃজনশীল পদ্ধতির কারণে শিক্ষার্থীদের পড়ালেখার মান, পরীক্ষায় পাসের হার ও নকলের প্রবণতা কমেছে। নিজেদের প্রকাশ করার প্রবণতাও বেড়েছে। সমীক্ষায় অংশ নেওয়া ৮০ শতাংশের বেশি শিক্ষার্থীর কাছে সৃজনশীল সহজ।

মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষকদের সৃজনশীল প্রশ্নসহ বিভিন্ন ধরনের বিষয়ভিত্তিক প্রশ্ন প্রণয়নে দুর্বলতা রয়েছে বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

এর আগে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকদের পাঠদানসহ বিভিন্ন বিষয়ে মাউশির পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, ৪৪ দশমিক ৭৫ শতাংশ বিদ্যালয়ের শিক্ষক এখনো ঠিকভাবে সৃজনশীল পদ্ধতিতে প্রশ্ন করতে পারেন না।

আইএমইডির প্রতিবেদন বলছে, সৃজনশীল পরীক্ষা পদ্ধতি বাস্তবায়নে শিক্ষকদের দক্ষতা বৃদ্ধিতে কয়েকটি ধাপে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ১২ দিনের প্রধান প্রশিক্ষক (মাস্টার ট্রেইনার) এবং পরে সব শিক্ষককে তিন দিনের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। মাস্টার ট্রেইনার প্রশিক্ষণ অনেকটা কার্যকর হলেও তিন দিনের প্রশিক্ষণগুলো কাজে আসছে না। আবার প্রশিক্ষণ কার্যক্রম বাস্তবায়ন করার ক্ষেত্রে শিক্ষকদের আন্তরিকতার অভাব রয়েছে।

সেগুনবাগিচা হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক এ কে এম ওবাইদুল্লাহর পরামর্শ, এই প্রশিক্ষণ কার্যকর হচ্ছে কি না, তা যাচাই করে দেখার ব্যবস্থা থাকা দরকার। তাঁদের বিদ্যালয়ে নিজেদের উদ্যোগে এই কাজ করা হয়।

বর্তমানে সহায়ক পুস্তক বা অনুশীলন বইয়ের নামে মূলত নোট-গাইডেরই ব্যবহার হচ্ছে। গত বুধবার রাজধানীর সেগুনবাগিচা এলাকার একটি বিদ্যালয়ে এই প্রতিবেদককে একজন শিক্ষক টেবিলের ওপর রাখা কিছু বই দেখিয়ে বলেন, এগুলো ইংরেজি ব্যাকরণের বই, একটি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান দিয়ে গেছে। তবে এখনো খুলে দেখা হয়নি। এ রকমভাবে গাইড বই কিনতে উদ্বুদ্ধ করে বিভিন্ন প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান।

অবকাঠামোগত সংকট

আইএমইডির প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশের ৪৮ শতাংশ বিদ্যালয়ে প্রাথমিক চিকিৎসাব্যবস্থা নেই। অথচ সব প্রতিষ্ঠানেই প্রাথমিক চিকিৎসাব্যবস্থা থাকা উচিত। অর্ধেকের বেশি (৫২ শতাংশ) শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে খাওয়ার পানির জন্য ফিল্টারের ব্যবস্থা নেই। আর ১২ শতাংশ বিদ্যালয়ে এখনো টিউবওয়েল নেই। বিদ্যালয়ের পানির ট্যাংক পর্যবেক্ষণের জন্য স্টিলের মই নেই ৭০ শতাংশ বিদ্যালয়ের।

অন্যদিকে ৯১ শতাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মাঠ রয়েছে। এতে শিক্ষার্থীরা খেলাধুলার সুযোগ পায়।

সুনামগঞ্জের এস সি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জানালেন, তাঁদের স্যানিটেশন ব্যবস্থা যা আছে, তা পর্যাপ্ত নয়। এ জন্য আবেদন করা হয়েছে, যা প্রক্রিয়াধীন আছে।

উপবৃত্তির টাকা যথেষ্ট নয়

ঝরে পড়া রোধে উপবৃত্তিসহ বিভিন্ন উদ্যোগ কাজে দিচ্ছে। তবে সমীক্ষায় অংশ নেওয়া ৮৫ দশমিক ৪৭ শতাংশ শিক্ষার্থী মনে করেন, উপবৃত্তির টাকা তাদের খরচ চালানোর জন্য যথেষ্ট নয়। এ ছাড়া প্রায় ৬০ শতাংশ শিক্ষার্থী জানিয়েছে, তাদের বিদ্যালয়ে কাউন্সেলিং কর্মসূচি চালু আছে। পরামর্শক দল মনে করে, বাকি বিদ্যালয়গুলোতেও কাউন্সেলিং কর্মসূচি চালু করা উচিত, যাতে ঝরে পড়ার হার শূন্যের কোটায় চলে আসে।

মাধ্যমিক শিক্ষার সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধূরী প্রথম আলোকে বলেন, আইএমইডির প্রতিবেদনে মাধ্যমিকের যেসব সমস্যার কথা উঠে এসেছে, সেগুলো তাঁরাও বিভিন্ন সময়ে বলে আসছেন এবং তাঁদের মাঠপর্যায়ের গবেষণাতেও তা উঠে এসেছে। এখন সরকারের উচিত হবে সঠিক কর্মপরিকল্পনা করে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া। এ জন্য প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ সঠিকভাবে ব্যবহার করতে হবে।